ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্রজয়ন্তী কাল, রাষ্ট্রপতি যাচ্ছেন ॥ পতিসরে ব্যাপক আয়োজন

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৭ মে ২০১৭

রবীন্দ্রজয়ন্তী কাল, রাষ্ট্রপতি যাচ্ছেন ॥ পতিসরে ব্যাপক আয়োজন

নিজস্ব সংবাদদাতা, নওগাঁ, ৬ মে ॥ বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ১৫৬তম জন্মবার্ষিকী সোমবার। বাঙালীর জীবনের এই স্মরণীয় দিনটি ঘিরে সকল জরাজীর্ণ পেছনে ফেলে নতুন বছরের আগমনের সঙ্গে বিশ্বকবির জন্মতিথিকে নতুনচিত্তে ভাবার জন্য ধুয়েমুছে প্রস্তুত করা হয়েছে তার নিজস্ব জমিদারির সদর দফতর পতিসরের কাছারিবাড়ি। সাজানো হয়েছে অপরূপ বর্ণিল সাজে। প্রতিবছরের ধরাবাধা অনুষ্ঠানমালার চেয়ে এবারের কর্মসূচীর মাত্রা অন্যরকম। এবারই প্রথমবারের মতো কবিগুরুর জন্ম বার্ষিকীর মূল উৎসব পালিত হচ্ছে এই পতিসরে। এবার এখানে আসবেন রাষ্ট্রপতি এ্যাডভোকেট মোঃ আবদুল হামিদ। তার সঙ্গে থাকবেন সরকারের মন্ত্রী, এমপি, উর্ধতন কর্মকর্তাসহ দেশবরেণ্য শিল্পী, সাহিত্যিক ও রবীন্দ্র ভক্তরা। নাচ, গান আর কবির রচিত কবিতা আবৃত্তি করে উদযাপনের আয়োজন করা হয়েছে বিশ্বকবির জন্মোৎসব। সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এ উপলক্ষে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামার নূর এবারের অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। কবির জন্মদিনের এই উৎসবের আমেজ গ্রাম-বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম দিন উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এবারও কবিগুরুর নিজস্ব জমিদারি তার স্মৃতি বিজড়িত নওগাঁর পতিসর কাচারি বাড়ি প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয়েছে নানা উৎসবের। প্রতিবছরই এইদিনে পতিসরে নামে রবীন্দ্র ভক্তের ঢল। পরিণত হয় মানুষের মহা-মিলন মেলায়। সরকারীভাবে ১ দিনের কর্মসূচী নিলেও এ মিলনমেলা স্থানীয়ভাবে চলে প্রায় সপ্তাহ জুড়ে। দূর-দূরান্ত থেকে কবি ভক্তরা ছুটে আসেন তাদের প্রিয় কবির পতিসর কাচারি বাড়ি প্রাঙ্গণে। একে অপরের সান্নিধ্যে এসে স্মৃতি চারণে লিপ্ত হন কবিভক্তরা। কবি গুরুর ১৫৬তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এবার ব্যাপক প্রস্তুতি হাতে নেয়া হয়েছে। বিশ্বকবির জমিদারির পতিসর পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। কাচারি বাড়িতেই কবিগুরুর ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। পতিসরে নাগর নদের পাড়কে মনোমুগ্ধকর করে তোলা হয়েছে। দীর্ঘদিনেও পতিসরের তেমন উল্লেখযোগ্য কোন উন্নয়ন না হলেও স্থানীয় এমপি মোঃ ইসরাফিল আলমের আন্তরিক প্রচষ্টায় এবার যেন উন্নয়নের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। কবিগুরুর নিজস্ব জমিদারি এলাকা কালিগ্রাম পরগনার সদর দফতর এই পতিসর। আর এই পতিসর নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার মনিয়ারি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ মাধুর্যঘেরা কবির স্মৃতি বিজড়িত পতিসর আজও সাহিত্যের অঙ্গনে স্বাড়ম্বরে বিরাজিত। কবির যখন ভরা যৌবন এবং কাব্য সৃষ্টির প্রকৃষ্ট সময়, তখন তিনি বিরাজ করেছেন এই পতিসরে। প্রতিবছর কবির এই জন্মদিনে বহু দূর থেকে ভক্তরা ছুটে আসেন। তাদের প্রিয় কবির স্মৃতি বিজড়িত পতিসর কাচারি বাড়ি প্রাঙ্গণে যেন কবিভক্তদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। নওগাঁ জেলা সদর থেকে রানীনগর হয়ে ৩৬ কিলোমিটার ও আত্রাই উপজেলা সদর হয়ে ৫৫ কিলোমিটার আঁকাবাঁকা অপ্রশস্ত পাকা সড়ক চলে গেছে নিঝুম-নিস্তব্ধ-নিভৃত পল্লী, কবিগুরুর কাচারি বাড়ি জেলার আত্রাই উপজেলার মনিয়ারি ইউনিয়নের পতিসর গ্রামে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম দিন উপলক্ষে প্রতিবছরই এখানে বসে মানুষের মিলন মেলা। সপ্তাহখানেক জুড়ে চলে সেখানে রবীন্দ্র মেলা। এ সময় স্থানীয় ও এলাকাবাসীদের বাড়িতে ভিড় জমায় দূর-দূরান্ত থেকে আসা কবি ভক্ত, আত্মীয়-স্বজন, অতিথিবৃন্দ। একে অপরের সান্নিধ্যে এসে স্মৃতি চারণে লিপ্ত হয়, ফেলে আসা পুরনো দিনের কথায়। গ্রামের মানুষ মেয়ে-জামাইকে নাইওরে আনে এই উৎসবে। ঘরে ঘরে পড়ে যায় পিঠা-পায়েসসহ উন্নত মানের খাবার তৈরির ধুম। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজরিত পতিসরে এবার কবির ১৫৬তম জন্ম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ইতোমধ্যে নওগাঁ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত প্রস্তুতি সভায় এখানে সরকারীভাবে ১ দিনব্যাপী কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। পতিসরে ১ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান মালার মধ্যে রয়েছে, বেলা ২টা ৩০ মিনিটে রবীন্দ্র কাচারী বাড়ির দেবেন্দ্র মঞ্চে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, “মানুষের ধর্মঃ রবীন্দ্র নাথ ও সমকালীন প্রাসঙ্গিতা” শীর্ষক স্মারক আলোচনা অনুষ্ঠান, নাটক , আবৃত্তি, নাচ-গানসহ মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্মারক বক্তব্য রাখবেন, অধ্যাপক ড. হায়াৎ মামুদ। আলোচনার পর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দেশী ও বিদেশী পর্যটক ও রবীন্দ্র গবেষকদের নিরাপদে রাত যাপন ও গবেষণার স্বার্থে পতিসরে ৫ কক্ষ বিশিষ্ট অত্যাধুনিক “বঙ্গবন্ধু স্মৃতি নীড়” নামে দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। জানা গেছে, ১৯৩৭ সালে ২৭ জুলাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাজার হাজার প্রজাকে কাঁদিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে পতিসর তথা বাংলাদেশ থেকে শেষ বিদায় নিয়েছিলেন। সে সময় তিনি প্রজাদের উদ্দেশে বলেছেন, “সংসার থেকে বিদায় নেয়ার পূর্বে তোমাদের দেখার ইচ্ছা ছিল, তা আজ পূর্ণ হলো। তোমরা এগিয়ে চল-জনসাধারণের জন্যে সবার আগে চাই শিক্ষা-এডুকেশন ফাস্ট, সবাইকে শিক্ষা দিয়ে বাঁচাও। বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর নওগাঁর আত্রাইয়ের এই পতিসরে এসে তাঁর কাচারি বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা নাগর নদকে নিয়ে লিখেছিলেন, ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’। এছাড়াও তাঁর বিখ্যাত কবিতা “তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে”, “দুই বিঘা জমি”, “সন্ধ্যা”সহ অসংখ্য সাহিত্য কর্ম রচনা করেছেন এই পতিসরের কাচারি বাড়িতে বসে। কবিগুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তার পুরস্কারের অর্থ তিনি এই পরগনার প্রজাদের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার জন্য ৭৫ হাজার টাকা তৎকালীন সময়ে এখানে স্থাপিত কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন। এই প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকার প্রজাদের মাঝে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে কবি ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে পতিসরে এসে তার পুত্র রথীন্দ্রনাথের নামে কালিগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশন স্থাপন করেন এবং এই প্রতিষ্ঠানের নামে ২শ’ বিঘা জমি দান করেন। তথ্য অনুসন্ধানে অন্তত এটুকু নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, কবিগুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর ছিলেন মহান ও উদার মনের মানুষ। এই পরগনাসহ দেশের জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে তিনি অন্তর দিয়ে ভালবাসতেন।
×