ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

আসিয়ানের পঞ্চাশ বছর

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ৭ মে ২০১৭

আসিয়ানের পঞ্চাশ বছর

২০১৭ সালে আসিয়ান বা এ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ এশিয়ান নেশানসের পঞ্চাশ বছর পূরণ হয়েছে। ১৯৬৭ সালে শীতল যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৫টি রাষ্ট্র যথা- ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর নিয়ে আসিয়ান গঠিত হয়। ১৯৭৯ সালে কম্বোডিয়া আসিয়ানের সদস্য হয় এবং পরে ব্রুনাই (১৯৮৪), লাওস (১৯৯০), ভিয়েতনাম (১৯৯৬) ও মিয়ানমার (১৯৯৭) আসিয়ানে যোগ দিলে এর সদস্যপদ ১০-এ উন্নীত হয়। আসিয়ানভুক্ত দেশসমূহের সামগ্রিক (ভূমি) আয়তন ৪.৪ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার, যা পৃথিবীর মোট স্থল এলাকার শতকরা ৩ ভাগ। এসব দেশের মোট জনসংখ্যা ৬২৫ মিলিয়ন, যা সারা পৃথিবীর জনসংখ্যার শতকরা ৮.৮ ভাগ। ২০১৫ সালে এসব দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদ ২.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে হিসাব হয়েছে। সমকালে আসিয়ান পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম রফতানি উৎসারণ এলাকায় উন্নীত হয়েছে। রফতানি মূল্যের পরিমাপে আসিয়ান অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহের স্থান ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঠিক নিচে। আসিয়ান দেশসমূহে পৃথিবীর ২২৭টি বৃহত্তম কোম্পানির কেন্দ্র অবস্থিত এবং এসব দেশে সারা পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ মাছ উৎপাদিত হয়। পাম তেল ও প্রাকৃতিক রাবার উৎপাদনে আসিয়ান দেশসমূহ পৃথিবীতে প্রথম, চাল উৎপাদনে দ্বিতীয় এবং সারা পৃথিবীর প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের নিলয় হিসেবে আসিয়ানভুক্ত দেশসমূহ দ্বিতীয়। সমকালে অবাধে রূপান্তরক্ষম বিদেশী মুদ্রার এক-তৃতীয়াংশ আসিয়ান দেশসমূহে মজুদ আছে। সারা পৃথিবীর সমুদ্রবাহিত পণ্যসামগ্রীর এক-তৃতীয়াংশে আসিয়ান দেশসমূহ থেকে উৎসারিত হয়। ঠিক তেমনি কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনে আসিয়ান দেশসমূহ সারা পৃথিবীতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে আছে। সামুষ্টিক হিসাবে ক্রয় শক্তির নিরিখে আশিয়ান দেশসমূহের সমকালীন মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ১৬০ যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিঙ্গাপুরের (৯০৭২৪ ডলার) আর সবচেয়ে কম ভিয়েতনামের (৬৯২৫ ডলার)। ১৯৬৭ সালে ব্যাংককে গৃহীত আসিয়ান ঘোষণাপত্রে এই জোটভুক্ত দেশসমূহের ৭টি লক্ষ্য যথাÑ ১. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, ২. আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা, ৩. সাধারণ আর্থিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা ও সহায়তা, ৪. প্রশিক্ষণ ও গবেষণায় সহকারিতা, ৫. কৃষি ও শিল্পের উন্নততর ব্যবহারে সহযোগিতা, ৬. দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সম্পর্কিত বিশ্লেষণ ও বীক্ষণ প্রসারণ এবং ৭. এসব উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা সকল সদস্য দেশের জন্য অনুসরণীয় বলে বিবৃত হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্থাপন ও পরিচালন অনুসরণ করে আসিয়ানভুক্ত দেশসমূহ ১৯৯২ সালে সাধারণ কার্যশীল অগ্রাধিকারসম্পন্ন শুল্ক পরিকল্প (ঈড়সসড়হ ঊভভবপঃরাব চৎবভবৎবহঃরধষ ঞধৎরভভ- ঈঊচঞ) গ্রহণ করে। এই পরিকল্প অনুযায়ী বিশ্ববাজারে এই এলাকার প্রতিযোগিতামূলক উৎপাদনের সুবিধা বৃদ্ধিকরণের লক্ষ্যে এসব দেশ পর্যায়ক্রমে নিজেদের মধ্যে আমদানি ও রফতানির ওপর আরোপিত সকল শুল্ক কমিয়ে দেয়ার লক্ষ্য ঘোষণা করে। এই পরিকল্প বাস্তবায়নের ফলপ্রসূতা বিশ্লেষণ করে ১৯৯২ সালের ২৮ জানুয়ারি সদস্য দেশসমূহ আসিয়ান মুক্ত বাণিজ্য এলাকা (আসিয়ান ফ্রি ট্রেড এরিয়া - আফটা) চুক্তিতে উপনীত হয়। চুক্তির মোড়কে এই সময়ে এসব সদস্য দেশের পারস্পরিক আমদানি-রফতানি খাতে আরোপনীয় শুল্ক শতকরা ৪ ভাগে কমিয়ে আনা হয়েছে। এই চুক্তি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন হলে এসব দেশে সদস্য দেশসমূহ হতে আমদানীয় পণ্যসামগ্রীর ওপর সকল প্রকার শুল্ক উঠে যাবে। ১৯৯৭ সালের ২৮ মার্চ আসিয়ানভুক্ত সকল দেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত এলাকা বলে ঘোষণা করে। এই চুক্তি ২০০১ সালে ২১ জুন ফিলিপিন্স কর্তৃক অনুসমর্থিত হলে এ এলাকায় সকল প্রকার পারমাণবিক অস্ত্রের উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়। ২০০৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর আসিয়ানভুক্ত সকল দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্প্রদায়ের মতো আর্থিক ও রাজনৈতিক এলাকায় রূপান্তরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। ১৯৯৭ সালে আসিয়ান চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে মিলিতভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য গ্রহণ করে। এর পরে এই লক্ষ্যের আওতায় ভারত, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও রাশিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০০৬ সালে আসিয়ানকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পর্যবেক্ষকের স্বীকৃতি দেয়া হয়। সমকালে ১৬টি দেশ সংবলিত এলাকায় আসিয়ানের নেতৃত্বে বিস্তৃত আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তির আওতায় একটি নতুন মুক্ত বাণিজ্য এলাকা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে এক সঙ্গে কাজ চলছে। ২০১৫-এর মধ্যে এই প্রক্রিয়া অনুযায়ী তারা আসিয়ান অর্থনৈতিক কমিউনিটির মোড়কে একটি সাধারণ বাজার স্থাপন করেছে। ২০১৬-এর মধ্যে এ সকল দেশ তাদের মধ্যে শূন্য আমদানি শুল্ক স্থাপনের লক্ষ্য ঘোষণা করে। ২০১৬-এর ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামা সানিল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্র ও আসিয়ানের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত করেন। এই সম্মেলনের মাধ্যমে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা সংবলিত করে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সংশ্লিষ্ট খাতে একটি বিস্তৃত সংগঠন গঠনের ডাক দেয়া হয়। এর ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে প্রস্তাবিত আন্তঃপ্রশান্তীয় অংশীদারিত্ব (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ-টিপিপি) স্থাপন ও প্রসারণ সহজতর করার সমষ্টিগত উদ্যোগ প্রতিভাত হয়। ফলত ইউরোপের ইউরোর আদলে এসব দেশে সাধারণ মুদ্রা হিসেবে আসিয়ান মুদ্রা ইউনিট (এসিইউ) প্রচলনের পদক্ষেপ নেয়া হয়, আসিয়ানভুক্ত দেশসমূহের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা সম্প্রসারিত করে ২০২০ সালের মধ্যে আর্থিক ক্ষেত্রে অধিকতর সংহতি স্থাপনের রূপরেখা গ্রহণ করা হয়, সম্মিলিতভাবে মূলধন বাজার উন্নয়নের লক্ষ্য গ্রহণ করে মূলধন হিসাব রক্ষাকরণে ও আর্থিক পরিষেবা প্রক্রিয়ার উদারীকরণ লক্ষ্য হিসেবে অনুসরণ করার জন্য সবাই একমত হন। একই সময়ে একক বিমান চলাচলের বাজার সৃষ্টি ও পরিচালনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং অন্যান্য আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা বিস্তৃত করার জন্য কার্যক্রম শনাক্ত করা হয়। ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত আসিয়ান দেশসমূহের শীর্ষ সম্মেলনে আসিয়ান দেশসমূহের পারস্পরিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা অধিকতর বিস্তৃত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অবশ্য দক্ষিণ চীন সাগর ও উত্তর কোরিয়ার সমকালীন অবস্থান বিষয়ে তারা সম্মিলিতভাবে সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়নি। এই ৫০ বছরে আসিয়ান সংগঠন হিসেবে সদস্য দেশসমূহের জন্য কতিপয় দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেÑ ১. প্রতিরক্ষা বিষয়ক শিল্পসমূহের সহযোগিতাকে ভিত্তি করে সদস্য দেশসমূহের বাইরে থেকে অস্ত্রের আমদানি কমানো, ২. আসিয়ান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের নীলনকশা গ্রহণ করে সদস্য দেশসমূহের মানবসম্পদ উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা ও কুশল বিস্তৃতকরণ, সামাজিক ন্যায়বিচার ও অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং ৩. পরিবেশগত ভারসাম্য বাড়ানো, সদস্য দেশসমূহের মধ্যে উন্নয়নের ব্যবধান দূরীকরণ এবং সর্বোপরি আসিয়ান পরিচিতি গ্রহণ ও বিস্তৃতকরণের ওপর জোর দেয়া। সাম্প্রতিক বীক্ষণে দেখা গেছে যে, সদস্য দেশসমূহের বাইরে থেকে অস্ত্র আমদানি এসব দেশ প্রান্তিক মাত্রায় কমাতে সক্ষম হয়েছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের নীলনকশার মোড়কে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড অন্যান্য সদস্য দেশের তরুণদের বৃত্তি ও সহায়ক দিয়ে আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। এর বাইরে সামাজিক ন্যায়বিচার ও অধিকার নিশ্চিতকরণে কোন সফল সমন্বিত পদক্ষেপ এসব দেশ গ্রহণ করতে এখনও সক্ষম হয়নি। এসব দেশের মধ্যে ফিলিপিন্স ও মিয়ানমার সবচেয়ে পেছনে রয়েছে বলে বলা হয়। একটি সদস্য দেশ ভিয়েতনাম এখনও একদল বিশিষ্ট রাজনৈতিক কাঠামোর আওতায় শাসিত হচ্ছে। জলবায়ু অনুকূল রাখার লক্ষ্যে আসিয়ান দেশসমূহ প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে নিক্ষেপ না করা, সাগরে বসবাসরত স্তন্যপায়ী প্রাণীসমূহ ও মৎস্যের বিভিন্ন প্রজাতির সংরক্ষণ এবং বিলুপ্তির পথে দৃষ্ট গাছ-গাছড়ার প্রতিরক্ষণ এবং বনরাজি রক্ষাকরণে সদস্য দেশসমূহ যথা প্রয়োজন পদক্ষেপ নিতে একমত হয়েছে। জাতিসংঘ বিদিত প্রতিবেদন অনুযায়ী আসিয়ান দেশসমূহের বয়স্ক সাক্ষরতার হার উঁচু পর্যায়ের অর্জন দেখিয়েছে। সিঙ্গাপুরে এই সাক্ষরতার হার শতকরা ৯৫, ফিলিপিন্সে শতকরা ৯৮, মালয়েশিয়ায় শতকরা ৯৬ এবং মিয়ানমারে শতকরা ৯২ ভাগ। সবচেয়ে কম লাওসে- শতকরা ৭৩ ভাগ ও কম্বোডিয়ায়- শতকরা ৭৮ ভাগ। সাক্ষরতার নিরিখে পেছনে পড়া এই দুই দেশকে ওপরে টেনে আনার কার্যক্রম এ জোট গ্রহণ করেছে। আসিয়ান সুসংহত ও বিস্তৃত করার এই উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে কতিপয় তথ্য ও প্রতিক্রিয়া পার্শ¦বর্তী দেশের জনগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। এক. আসিয়ানের জনগণের সমকালীন উপযোগ এই ৫০ বছর পূর্তি পরবর্তী ৫০ বছরের জন্য এসব দেশের মধ্যে সংহতি ও একাত্মতা আরও বৃদ্ধি করবে বলে প্রক্ষেপিত হচ্ছে এবং এই লক্ষ্যে ইন্দোনেশিয়া কেন্দ্র হিসেবে ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যাচ্ছে (দ্রষ্টব্য: রবি ভেলোর-সানডে টাইমস, সিঙ্গাপুর, ২৩ এপ্রিল)। দুই. প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চীন কর্তৃক উত্তরোত্তর রাজনৈতিক, সামাজিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তারণ আসিয়ান দেশসমূহের দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যক্রমে প্রান্তিক বিভাজন আনতে পারে। এই বিভাজন দূর করার জন্য আসিয়ান নেতাদের অধিকতর ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দক্ষিণ চীন সাগর এবং উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়াকেন্দ্রিক মতবিরোধ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে যাতে আসিয়ানভুক্ত দেশসমূহে অনৈক্যের ফাটল সৃষ্টি না করতে পারে সেজন্য এসব দেশের নেতৃত্বকে সচেতন থাকতে হবে। তিন. ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীনে যুক্তরাষ্ট্র আন্তঃপ্রশান্তীয় অংশীদারিত্ব (টিপিপি) থেকে দূরে সরে আসবে বলে ঘোষণা দিয়েছে, উত্তর আমেরিকার মুক্ত বাণিজ্য এলাকা (নাফটা) সঙ্কুচিত করবে বলে জানিয়েছে এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা কর্তৃক মুক্ত বাণিজ্য প্রসারণের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার প্রতিকূলে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ও ব্রিক্সিট বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে আসিয়ান দেশসমূহকে অধিকতর সচেতনভাবে পৃথিবীব্যাপী মুক্ত বাণিজ্য প্রসারণে একমত হয়ে এগিয়ে যেতে হবে। উল্লেখ্য, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অংশীদারিত্বের কাঠামো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প ঘোষিত আশঙ্কিত প্রত্যাহার এসব দেশে চীনের প্রভাব বিস্তারণের প্রতিকূলে যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিম পৃথিবীর অবস্থান স্তিমিত করবে বলে বলা চলে। চার. আসিয়ান গত ৫০ বছর ধরে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শক্তিশালী অর্থনৈতিক সংগঠনে উন্নীত হয়েছে সেই প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশকে এই উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের সঙ্গে আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক সম্প্রসারণ ও সুবিস্তৃতকরণের পথে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের বাণিজ্য প্রসারণ ও বহুমুখীকরণের পরিধি এখনও বিস্তৃত রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে অধিকতর সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য বিশেষত উন্নয়নধর্মী বাণিজ্যকে এই লক্ষ্যের পথে বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপালকে দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। আসিয়ান জোটভুক্ত দেশসমূহের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কে ও লেনদেন বিস্তৃত করার সুচিন্তিত কার্যক্রম নিয়ে এই উপমহাদেশের সকল দেশকে এগিয়ে যেতে হবে। আসিয়ানের লক্ষ্য ও কার্যাবলী বিশ্লেষণ করলে কতিপয় দুর্বলতা দৃষ্ট হয়। প্রথমে বলা চলে যে, আসিয়ান দেশসমূহে বিশেষত মিয়ানমারে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র উন্নয়নে ফলদায়ী তেমন কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। মিয়ানমারে উন্মুক্ত ও প্রচ্ছন্ন সামরিক শাসক কর্তৃক জনগণের অধিকার রক্ষাকরণ এবং তাদের ওপর নির্যাতনের প্রতিকূলে আসিয়ান জোট চোখে পড়ার মতো কোন পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়নি। এও বলা চলে যে, আসিয়ানের সদস্য দেশসমূহ রাজনৈতিক কাঠামোর বিভিন্নতার কারণে তাদের ঐক্য অধিকতর দৃঢ় করতে সক্ষম হয়নি। উদাহরণত এজন্য তারা একদিকে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মাঝে এবং অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মাঝে বিদ্যমান সীমান্ত বিরোধ মেটাতে সক্ষম হয়নি। তেমনি থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সীমান্ত বিরোধ এবং ফিলিপিন্সে কতিপয় রাজনীতিবিদ কর্তৃক উত্থাপিত স্বাধিকারের অধিকার সম্পর্কিত দাবির কোন সুরাহা এখনও করা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত একই কারণে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের বিপরীতে ফিলিপিন্স কর্তৃক উত্থাপিত অধিকার বিষয়ক দাবি বা বিরোধ মেটানোর লক্ষ্যে আসিয়ান জোট কোন পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়নি। সমুদ্র হতে চীনের বিশাল আকারের ভূমি পুনরুদ্ধারের কার্যক্রম বিষয়ে এবং এক্ষেত্রে একদিকে মিয়ানমার ও লাওস এবং অন্যদিকে অন্যান্য সদস্য দেশ অবস্থান নেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কোন একক সমাধানমূলক মত এই জোটের তরফ থেকে উত্থাপিত হতে পারেনি। এই জোট সমবেতভাবে তাদের স্ব-স্ব দেশে কার্যরত রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের বিদিত দুর্নীতি দমন সম্পর্কে কোন ঐকমত্যভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে পারেনি। আসিয়ান জোটের উল্লেখিত ক্ষেত্রে অপারগতা কিংবা শ্লথ গতি সম্পর্কে সচেতন থেকে এই উপমহাদেশে অর্থনৈতিক জোট সৃষ্টি এবং সম্পর্ক বাড়ানোর লক্ষ্যে আমাদের অধিকতর দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। বিশেষত অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে আসিয়ানের সদস্য দেশসমূহের মিলিত প্রচেষ্টা থেকে এই উপমহাদেশের বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কাকে (সম্ভবত মালদ্বীপকে সঙ্গে নিয়ে) অধিকতর সচেতন হতে হবে। লেখক : সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও আমলা
×