ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্মরণ ॥ শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার

প্রকাশিত: ০৪:১২, ৭ মে ২০১৭

স্মরণ ॥ শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার

আদর্শকে আত্মিকভাবে নিজের মধ্যে প্রয়োগ করতে হলে প্রয়োজন হয় মহাত্যাগের। আর যারা সেই মহাত্যাগের উৎস হিসেবে কাজ করে তাঁরা হয়ে ওঠেন কালোত্তীর্ণ মহাপুরুষ। সেই মহাপুরুষদের মধ্যে ধ্রুবতারার মতো আজও আমাদের মননে ও চেতনায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার। যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মতোই রাজনৈতিক কবি আর রাজনৈতিক কবি ছিলেন বলেই তিনি সব শ্রেণী, পেশা, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষদের সেতুবন্ধন রচনা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। যার কখনো মৃত্যু নেই। মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে তিনি আজও জনমানুষের মধ্যে মিশে আছেন। এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারকে। কারণ তিনি ছিলেন পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক একজন রাজনীতিবিদ। কর্মী থেকে তিনি জননন্দিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি মহাপুরুষে। তাঁর রাজনীতির মূল দর্শন ছিল মানুষ ও মানুষের প্রতি ভালবাসা। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১দফা দাবি উপস্থাপন করেন। এই ১১ দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার বৈষম্যের পটভূমিতে একদিকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবির বাস্তবায়ন এবং অন্যদিকে আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান। এই আন্দোলন একসময় গণআন্দোলনে রূপ নেয়। শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার প্রত্যক্ষভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। মিছিল, মিটিংসহ আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি স্বৈরাচারী আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলনের সময় তিনি আবার প্রত্যক্ষ করলেন গুলিবিদ্ধ ছাত্রনেতা আসাদের নিথর দেহ। পরবর্তীতে এই গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। আন্দোলন ও শিক্ষা কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ¯œাতক ডিগ্রী লাভ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এর মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার আহ্বান জানান। সেই উদাত্ত আহ্বানে অনুপ্রাণিত হয়ে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার আগে তিনি পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে আটক হন এবং নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। এই আহত অবস্থাও শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারকে স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে বিরত রাখতে পারেনি। এর পেছনে ছিল বঙ্গবন্ধুর দর্শন, দেশপ্রেম, স্বাধীনতার চেতনা ও বাঙালীর সর্বজনীন মুক্তি। ফলে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে। ভারতের দেরাদুনের তান্দুয়া থেকে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে ডাঙ্গা, পুবাইল, টঙ্গী, ছয়দানাসহ বিভিন্ন স্থানে গেরিলাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এই প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি আক্রমণের কৌশল ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার মনোবল বাড়ানোর কাজও করে চলেছিলেন। তিনি ১৯৮৩ সাল, ১৯৮৪ সাল, ১৯৮৭ সাল, ১৯৮৮ সাল, ১৯৯০ সাল, ১৯৯৫ সাল ও ২০০১ থেকে ২০০৪ সাল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক পটভূমিতে যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তা আজও আমাদের গর্বিত করে। তিনি এমন একজন নেতা যিনি শ্রমজীবী মানুষের অধিকারও যে রাজনীতির একটি দর্শন হতে পারে তা প্রমাণ করেছেন। তাঁর ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দর্শন নিয়ে গবেষণা করেছিলেন তিনি। তাঁকে বিকশিত করেছিলেন। আর এই বিকাশের পরিক্রমা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সম্প্রসারিত হোক এই আমাদের প্রত্যাশা। তিনি তাঁর সন্তানদের বলতেন, ‘দেখ, সাংসদ-পুত্র হয়ে তোমরা যেন কখনও দম্ভ করো না। ধনী দরিদ্র সকলকে সমান চোখে দেখবে। সকলের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। মানুষের উপকার করবে। দম্ভ যদি কিছু করার থাকে তবে তা করবেন তাঁরা, যাঁরা তোমার বাবাকে ভোট দিয়ে সাংসদ বানিয়েছেন।’ এই আদর্শকে ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন তাঁরই সুযোগ্য সন্তান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোঃ জাহিদ আহসান রাসেল, এমপি। এটি প্রমাণ করে আদর্শের কখনও মৃত্যু হয় না। আদর্শকে ধারণ করে এগিয়ে যায় আগামীর প্রজন্ম। এই মহান মানুষটির ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে গাজীপুরে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হবে তা সকলেই অন্তরে লালন ও ধারণ করে। কেননা ইতিহাস তাঁকে তৈরি করেনি, তিনিই ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। খুনীরা শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা করেনি, তারা হত্যা করেছে স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী একজন নেতাকে। যার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দর্শন বাস্তবে রূপায়িত হতো। ‘কাঁদো বাঙালী কাঁদো’ এই অশ্রুসিক্ত বেদনার ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে আমাদের আজ শোককে শক্তিতে পরিণত করতে হবে। সেই আলোকিত দিনটির আশায় আমাদের প্রতীক্ষা। লেখক : শিক্ষাবিদ
×