ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সন্তান প্রসবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াই যেন এখন অস্বাভাবিক

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৬ মে ২০১৭

সন্তান প্রসবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াই যেন এখন অস্বাভাবিক

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি বারডেম হাসপাতালে তামান্না হকের প্রথম কন্যাসন্তান জন্ম নেয় সিজারিয়ান ডেলিভারির মাধ্যমে। কারণ হিসেবে তিনি বললেন, বাধ্য হয়েই সিজারিয়ান ডেলিভারিতে সম্মতি দিয়েছেন। কোন উপায় ছিল না। আমার শিশুটি অপরিণত বয়সে অর্থাৎ আট মাসের সময় জন্ম নিয়েছে। ফলে পরিবারের সকল সদস্যের সম্মতিতে তিনি অস্ত্রোপচারের কথা বললেন। তিনি জানান, চিকিৎসক যখন বললেন, অস্ত্রোপচারে দেরি হলে শিশুর ক্ষতি হতে পারে, তখন তাদের রাজি হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। এর আগে তার অন্য বোনেরও হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু জন্ম নিয়েছে। শুধু তামান্না নয়, দেশের অনেক নারী নিজ ও পরিবারের সদস্যদের ইচ্ছায় কেউবা চিকিৎসকের কথায় বিশ্বাস করে বা প্ররোচনায় পড়ে সিজারিয়ানের মাধ্যমে শিশু প্রসব করছেন। সারা দেশের সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালেই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু জন্ম বাড়ছে। এতে শীর্ষে রয়েছেন শিক্ষিত ধনী শ্রেণীর যুবতীরা। দেশে মা ও শিশু স্বাস্থ্যের অনেক উন্নতি হলেও অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে ‘সিজারিয়ান ডেলিভারি’র সংখ্যা। মাতৃস্বাস্থ্যে বেশ উন্নতি হলেও কিছু বিষয়ে নতুন করে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবার সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী মাতৃমৃত্যুর হার লাখে ১৯৪ জন। ২০০১ সালে যা ছিল ৩২২ জন। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রসবের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার মাতৃস্বাস্থ্যের জন্য স্বাভাবিক। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশে এ অস্ত্রোপচারের হার সরকারীভাবে ২৩ ভাগ। বেসরকারী হিসেবে প্রায় ৫৫ ভাগ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ২০১৫ সালের তথ্য বলছে, হাসপাতালে সেবা নেয়া প্রতি ১০০ জনে ৬০ জন নারী সিজারিয়ানের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। এর মধ্যে গড়ে ৩৬ জনের বেসরকারী হাসপাতালে এবং ২৪ জনের সরকারী হাসপাতালে সিজারিয়ান হয়। ৪ মে জাতীয় সংসদে প্রসবের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় সিজার বন্ধের দাবি জানিয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন সংসদ সদস্য নূরজাহান বেগম মুক্তা। জাতীয় সংসদে ৭১ বিধিতে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নোটিস উত্থাপন করে তিনি এ দাবি জানান। সংরক্ষিত আসনের এই এমপি বলেন, ইদানীং উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, দেশে সন্তান প্রসবের ক্ষত্রে স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের পরিসংখ্যান অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আশঙ্কাজনক। বর্তমানে বেসরকারী হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ৮০ শতাংশ সন্তান প্রসব হচ্ছে সিজারের মাধ্যমে, যাকে আমি ‘এলার্মিং’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি। বিশেষ করে পরিবারগুলো যত ধনী হচ্ছে তত বাড়ছে সিজারিয়ানের হার, মেডিক্যাল ইন্ডিকেশন মেনে চললে ধনী-দরিদ্র সবক্ষেত্রে এর হার এক হতো। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে প্রচারিত ‘স্বাস্থ্য বুলেটিন ২০১৫’-এর তথ্য উত্থাপন করে তিনি সংসদে বলেন, ‘দেশের উপজেলাতে সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের সংখ্যা প্রায় ৮ গুণ বেড়েছে। ২০১৩ সালে দেশের বেসরকারী হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোতে সন্তান প্রসবের জন্য ১ লাখ ৬৬ হাজার ৭২১ জন প্রসূতি মা ভর্তি হন। এর মধ্যে ৪৮ হাজার ৮৬৮ ছিল স্বাভাবিক প্রসব, আর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম হয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৪৩ শিশুর। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১০০ প্রসূতির মধ্যে শতকরা ৮০ জনেরই স্বাভাবিক প্রসব করানো যেত। এই এমপি বলেন, এই পরিস্থিতিতে মা ও শিশুকে রক্ষা করার জন্য অপ্রয়োজনীয় সিজার বন্ধ করা প্রয়োজন। সে জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রতি দশজন নারীর ছয়জনই সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, এই হার প্রতিবছর বাড়ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেয়ার হার বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ২ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক এ্যান্ড হেলথ সার্ভের তথ্যানুযায়ী, সরকারী হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারী হাসপাতাল বা ক্লিনিকে তুলনামূলকভাবে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের হার অনেক বেশি। সরকারী হাসপাতালে প্রসবসেবা বাড়ানোর মাধ্যমে বেসরকারী হাসপাতাল বা ক্লিনিকে সিজারিয়ান অপারেশনের হার কমানোর জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। বেসরকারী হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোর বিরুদ্ধে প্রসূতিসেবা-বাণিজ্যের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ পাওয়া গেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ একদিকে সিজার অপারেশনে এক ঘণ্টারও কম সময় লাগা তার ওপর টাকার পরিমাণ বেশি হওয়ায় সিজারেই আগ্রহ অধিকাংশ চিকিৎসক ও হাসপাতালের। অন্যদিকে, নরমাল ডেলিভারিতে টাকার পরিমাণ কম তার ওপর একজন রোগীর পেছনে একজন চিকিৎসককে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দিতে হয়। সরকারীর তুলনায় বেসরকারী হাসপাতাল সিজারিয়ানের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াকে উদ্বেগজনক বলে মনে করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। বর্তমানে প্রাকৃতিকভাবে সন্তান জন্মদানের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটিই যেন এখন অস্বাভাবিক ঘটনা। দুই সন্তানের এক মা আজমেরি তাবাসসুম বললেন, সুনির্দিষ্ট কোন কারণ ছাড়াই অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই তাকে সিজারিয়ান করা হয় রাজধানীর একটি বেসরকারী হাসপাতালে। প্রথম সন্তান সিজারিয়ান ডেলিভারি হওয়ায় তার দ্বিতীয় সন্তানের ডেলিভারিও হয়েছে সিজারের মাধ্যমে। এখন তিনি শারীরিকভাবে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি। কোন ভারি কাজ করতে পারেন না। এছাড়া কোমরে মাঝে মাঝেই ব্যথা করে বলে জানালেন তিনি। গত এক যুগে এই সংখ্যা ৩১ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেয়া শিশুর সংখ্যা ৩৪ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। ‘ন্যাশনাল লো বার্থ ওয়েট সার্ভে-২০১৫’ শীর্ষক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। ২০০৩-০৪ সালে সিজারিয়ানের মাধ্যমে জন্ম নেয়া শিশুর সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১৫-১৬ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ। একই সময়ে স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেয়া শিশুর সংখ্যা ৯৬ দশমিক ৩ থেকে কমে ৬২ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সিজারিয়ানের মাধ্যমে জন্ম নেয়া শিশুর সংখ্যা বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তবে দেশে জন্মগত কম ওজনের শিশুর সংখ্যা কমায় স্বস্তি প্রকাশ করা হয়েছে। ২০০৩-০৪ সালের সার্ভেতে কম ওজনের নবজাতকের সংখ্যা ছিল ৩৬ শতাংশ। এক যুগ পর তা কমে ২২ দশমিক ৬ শতাংশে পৌঁছেছে। কম ওজন নিয়ে জন্ম নেয়া শিশুর মৃত্যুঝুঁকি ৪ গুণ বেশি। এসব শিশুর বেশিরভাগ মেয়ে এবং এরা বস্তি এলাকার। হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি রোগ বিদ্যা বিভাগের বিভাগীয়প্রধান অধ্যাপক রওশন আরা বেগম এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, ‘অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমা দেশগুলোতে অস্ত্রোপচারের সংখ্যা কম। অথচ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এর হার বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। আমাদের দেশে শতকরা ৬২ শতাংশ প্রসব এখনও বাড়িতে হয়। তবে বেসরকারী হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে ১০০ ভাগ প্রসবই সিজারিয়ানের মাধ্যমে হয়ে থাকে।’ ক্লিনিকগুলোতে মূলত ধনি শ্রেণীরাই যায় বেশি। আর সেখানে তাদের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে। প্রসূতি মা ও পরিবারের সিদ্ধান্তেই বেশিরভাগ সিজার করা হয়ে থাকে। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, একসময় এই হাসপাতালে সবই নরমাল ডেলিভারি হতো। কিন্তু এখন প্রায় সব ডেলিভারি হচ্ছে রোগীসহ তার পরিবারের সিদ্ধান্তে, সেখানে আমাদের কী করার আছে। আর বেশিরভাগ বেসরকারী ক্লিনিকের মালিক বসেই আছেন পয়সা উপার্জন করার জন্য, তারা রোগীদের নানাভাবেই মোটিভেট করে অপারেশন করার জন্যÑএটা অস্বীকার করার উপায় নেই।’ সিজারিয়ান ডেলিভারি মাতৃস্বাস্থ্যের জন্য সুখকর ফল বয়ে আনে না। চিকিৎসকরা বলছেন, সিজারিয়ান ডেলিভারি হলে একজন মায়ের পরবর্তী সন্তানেরও সিজারিয়ান ডেলিভারির প্রয়োজন হবে। সিজারের সময় প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিজারের পর মাকে রক্ত দিতে হয়। হার্টের সমস্যা হলে সিজার করলে জটিলতা বাড়ে। ইনফেকশন হতে পারে মায়ের। সেই সঙ্গে মায়ের যদি ডায়াবেটিস থাকে তাহলে ক্ষত স্থান শুকাতে সমস্যা হয়। অনেক ক্ষেত্রে একাধিকবার সেলাইয়ের প্রয়োজন পড়ে। দক্ষ চিকিৎসকের হাতে না পড়লে যেমন সন্তানের নানা সমস্যা হতে পারে তেমনি চিকিৎসকের অসাবধানতায় প্রয়োজন না থাকলেও অন্য অঙ্গ কাটা পড়তে পারে। প্রসাবের থলিতে ক্যাথেটার প্রবেশ করানোর কারণে সেখানে ইনফেকশন হতে পারে। সিজার করা হলে রক্ত জমাটের একটা ব্যাপার আছে। যদি ফুসফুসে রক্ত জমাট বাঁধে তাহলে এটা প্রাণনাশের কারণ হতে পারে।
×