ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জয়পুরহাটের আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবনমান পাল্টে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৬ মে ২০১৭

জয়পুরহাটের আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবনমান পাল্টে যাচ্ছে

আনোয়ার রোজেন, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থেকে ফিরে ॥ গ্রামটির বুক চিড়ে চলে গেছে রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে যতদূর চোখ যায় শুধু ধানক্ষেত, সবুজের সমারোহ। প্রত্যন্ত এ গ্রামের নাম ছাতিনালী। প্রকৃতি এখানে সবুজের অভাব রাখেনি। কিন্তু অভাব আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখতে চায় গ্রামের আদিবাসী মানুষগুলোকে। আছে অভাবের জাল ছিন্ন করার লড়াইও। হতদরিদ্র এ মানুষগুলোর লড়াইয়ের ‘হাতিয়ার’ হয়ে উঠেছে বর্তমান সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচী। কর্মসূচীর আওতায় দারিদ্র্য জয়ের স্বপ্ন দেখছেন এখানকার আদিবাসীরা। নিজেদের অধিকার বিষয়ে সচেতন হচ্ছেন তারা। মালি (৩৫) তাদেরই একজন। হতদরিদ্র পরিবারের গৃহিণী রিতা। স্বামী নিখিল মালি সেলুন কর্মী (৪৫)। সাড়ে তিন শতাংশের ভিটেটুকু ছাড়া আর কোন স্থাবর সম্পত্তি নেই নিখিলের। সংসারে ৪ কন্যা সন্তান। রিতার কথায়, আদিবাসী হওয়ায় তাদের অভাব-অভিযোগ এত দিন কেউ আমলে নেয়নি। তারা সমাজে গুরুত্বও পায়নি। সেলুন কর্মী স্বামী বেশির ভাগ সময় অসুস্থ থাকেন। উপার্জন না থাকায় দিনের পর দিন স্বামী সন্তান নিয়ে না খেয়ে থেকেছেন। মাঠে কৃষি কাজ থেকে শুরু করে অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসারের হাল ধরার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নিয়মিত কাজ পেতেন না। তাই অভাবও পিছু ছাড়ছিল না। একদিন স্থানীয় এক এনজিও কর্মীর মাধ্যমে রিতাসহ গ্রামের অন্য হতদরিদ্র আদিবাসীরা সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচী সম্পর্কে জানতে পারেন। জানতে পারেন আদিবাসী হিসেবে তাদের প্রাপ্য অধিকারের কথা। এরপর তারা সবাই স্থানীয় আওলাই ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে যোগাযোগ করেন। ইউপি কার্যালয় থেকে রিতার চাহিদা মেনে ৪০ দিনের কর্মসূচীর কাজ দেয়া হয়। এ কাজ করে রিতা পান ৭ হাজার টাকা। রিতার গ্রামীণ সংসারে এ টাকার গুরুত্ব অনেক। রিতা বললেন, তিন বেলা খাবার খাইতে কেমন লাগে, ভুইলা গেচিলাম। এই টাকা খাওনের কষ্ট দূর করসে। দুই মেয়ে এখন স্কুলে যায়। সরকারের শিক্ষা উপবৃত্তির টাকাও পায়। ৪০ দিনের কর্মসূচীর কাজ নিয়ে কিছুটা হলেও নিজের অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়েছেন রিতা। রিতার মতো গ্রামের আদিবাসী নারী বিথী মালিও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচীর আওতায় ৪০ দিনের কর্মসূচীর কাজ নেন। বললেন, সরকার যে আমাদের জন্য এত সুযোগ-সুবিধা চালু করেছে তা জানতাম না। এখন নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জানি। সেই অনুযায়ী সুবিধাও পাই। অতিদরিদ্রতা কমিয়ে আনার মাধ্যম হিসেবে সরকার ব্যাপক আকারে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশ হতদরিদ্র। সপ্তম-পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়ও আদিবাসী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সর্বোচ্চ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। সেই হিসেবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে আদিবাসীদের প্রবেশাধিকার সহজ হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ন্যাশনাল হাউসহোল্ড ইনকাম এ্যান্ড এক্সপেনডিচার সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সরকারী সেবা সম্পর্কে অজ্ঞতাসহ নানা কারণে দরিদ্র ও দুস্থ মানুষের বড় একটি অংশের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীতে প্রবেশাধিকার নেই। স্বল্প আয়, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, শিক্ষার অভাব এবং অধিকার ও বরাদ্দ সম্পর্কে সচেতন না হওয়ায় সমতলের আদিবাসী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েরও এ কর্মসূচীর আওতায় আসার হার কম। তবে এ চিত্র ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্তির হার বাড়ানোর পাশাপাশি সমতলের আদিবাসীদের জীবনমান পাল্টাতে সরকারের উদ্যোগ বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছে আন্তর্জাতিক এনজিও সংগঠন ওয়ার্ল্ড ভিশন। পল্লীশ্রী এবং পামদো নামের স্থানীয় দুই এনজিওর সহযোগিতায় তারা বাস্তবায়ন করছে ইভিপিআরএ প্রকল্প। এর মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর নয়টি খাতে অতিদরিদ্র মানুষের প্রবেশাধিকার বাড়ানো, তাদের সচেতন করা এবং কর্মসূচীর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হচ্ছে। খাতগুলো হচ্ছেÑ বয়স্কভাতা, আর্থিকভাবে অসচ্ছল প্রতিবন্ধীদের ভাতা, বিধবা-স্বামী পরিত্যক্তা ও দুস্থ নারী ভাতা, স্তন্যধাত্রী দরিদ্র নারীদের মাতৃত্বকালীন ভাতা, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা উপবৃত্তি, কাবিখা, ভিজিডি এবং ভিজিএফ কর্মসূচী। এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সম্প্রতি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার আদিবাসী অধ্যূষিত ছাতিনালী, লক্ষ্মীকূল, কামদিয়া গ্রাম ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীতে এখানকার আদিবাসীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। সেবা পাওয়ায় ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছে আদিবাসীদের জীবনমান। লক্ষ্মীকূল এবং কামদিয়া গ্রামে ৪৫-৫০ আদিবাসী পরিবার রয়েছে। তাদের কারোরই নিজস্ব জমি নেই। ঘরে বিদ্যুত নেই। গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই করুণ। সবচেয়ে কাছের বাজারটির অবস্থান গ্রাম থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে। তবে এসবের কোন কিছুই হতদরিদ্র গৃহিণী আন্না কুজোর (২৭) ভিজিডি কার্ড পাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তিনি জানান, এত দিন তারা সরকারের কোন সুযোগ-সুবিধা পেতেন না। এমনকি ভিজিডি কার্ড কি তাও জানতেন তা। এনজিও কর্মীদের কাছ থেকে সরকারের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে অবগত হয়ে ইউনিয়ন পরিষদে আবেদন করে ভিজিডি কার্ড পেয়েছেন। একই কথা জানালেন বয়স্কভাতাভোগী ডেভিড কুজো (৮০)। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওলাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক ম-ল জনকণ্ঠকে বলেন, প্রত্যন্ত জনপদ হিসেবে আমার ইউনিয়নে সাধারণ হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যাই বেশি। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় বিভিন্ন খাতে চলতি অর্থবছরে ইউনিয়নের তিন হাজারের বেশি হতদরিদ্র মানুষ ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পেয়েছেন। এর মধ্যে আদিবাসীও রয়েছেন। এ কর্মসূচীর বরাদ্দের ৩০ শতাংশ আদিবাসীদের জন্য রাখা হয়েছে কর্মসূচীর। আদিবাসীরা আগের চেয়ে এখন অনেক অধিকার সচেতন হয়েছেন। সরকারী সেবা নিতে তারা আগ্রহী। প্রকৃত ভাতাভোগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে এনজিওগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। সরকার প্রতিবছর এ কর্মসূচীতে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়াচ্ছে। আশা করছি, আগামী অর্থবছরে আরও বেশি সংখ্যক আদিবাসীকে কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। ওয়ার্ল্ডভিশনের ইভিপিআরএ প্রকল্প কর্মকর্তা শান্তনু কুমার সাহা জনকণ্ঠকে জানান, সরকারের কর্মসূচী কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা এ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে আদিবাসীদের অধিকার সচেতনতা তৈরিতে তারা কাজ করছেন। পামদোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হৈমন্তী সরকার দেবী জনকণ্ঠকে বলেন, আমি নিজে আদিবাসী এবং আমার অধিকার বিষয়ে সচেতন। কেবল সচেতনতার অভাবে আদিবাসীরা যাতে বঞ্চনার শিকার না হন সেটি নিশ্চিত করা জরুরী।
×