ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাফল্য-ব্যর্থতার দুই বছর পূর্তি দুই সিটি কর্পোরেশনের

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৬ মে ২০১৭

সাফল্য-ব্যর্থতার দুই বছর পূর্তি দুই সিটি কর্পোরেশনের

মশিউর রহমান খান ॥ নাগরিকদের কাক্সিক্ষত সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাসহ রাজধানীবাসীর সার্বিক উন্নয়নে আরও শৃঙ্খলা আনতে চারশত বছরের অধিক পুরান ঢাকাকে দুই ভাগ করে বর্তমান সরকার। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) নামে পৃথক হওয়া দেশের বৃহত দুই সিটি কর্পোরেশন জনপ্রতিনিধি দিয়ে পরিচালনার লক্ষ্যে সরকারের নির্দেশে গত ২ বছর আগে ২৮ এপ্রিল দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২০১৫ সালের ৬ মে রাজধানীবাসীর আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে নির্বাচিত দুই মেয়র শপথ নেন। এরই ধারাবাহিকতায় নাগরিকদের কাছে নির্বাচনকালীন তাদের দেয়া ইশতেহার ও বিভিন্ন ওয়াদা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে। বর্তমান সরকারের সর্বোচ্চ সহায়তায় প্রথমবারের মতো নির্বাচিত দুই মেয়র আনিসুল হক ও মোহাম্মদ সাঈদ খোকন শপথ গ্রহণের ২ বছর পূর্ণ করে আজ তিন বছরে পা দিয়েছেন। নির্বাচিত হওয়ার আগে দীর্ঘদিন নির্ধারিত প্রশাসক দিয়ে কোনমতে রাজধানীবাসীর চাহিদা পূরণ করে চলছিল এই মেগা সিটি ঢাকার প্রশাসকগণ। নাগরিক সমস্যার নানাবিধ যন্ত্রণায় জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে কারও কাছে বিচার চাওয়ারও পথ ছিল না। এমন অবস্থা থেকে নাগরিকদের রেহাই দিতে নানা আশ্বাসের মধ্য দিয়ে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কাজ শুরু করেন দুই মেয়র। বসবাস উপযোগী ও বর্তমান রাজধানীর চেহারা পাল্টে দিয়ে নতুন রাজধানী শহর ও বিশ্বের কাছে মেগা সিটি হিসেবে ঢাকাকে গড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন দুই মেয়র। কিন্তু কতটুকুই সফল হয়েছেন তারা। দুই মেয়র নির্বাচনের আগে ও পরে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনও পর্যন্ত রাজধানীর গণপরিবহন, রাস্তাঘাট, জলাবদ্ধতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পার্ক ও খেলার মাঠ দখলমুক্ত করা, যানজট নিরসনসহ বেশকিছু ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারেননি। বেশকিছু কাজের দৃশ্যমান উন্নয়ন করলেও এর প্রকৃত সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী। কিছু কিছু এলাকায় জনদুর্ভোগ আগের চেয়ে বেড়েছে বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিযোগিতায় বিগত দুই বছরে কোন কোন ক্ষেত্রে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এগিয়ে রয়েছে আবার কিছু ক্ষেত্রে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এগিয়ে রয়েছে। আইনগত ও প্রশাসনিক কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে দুই মেয়র অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কিছু ভাল ও জনকল্যাণমূলক কাজ করতে পারছেন না। তবে সবুজায়ন কাজের অংশ হিসেবে দুই মেয়রই বৃক্ষরোপণ কাজ করছেন। ভেজালবিরোধী অভিযান, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, হকার উচ্ছেদ উল্লেখযোগ্য অর্জন। আর ব্যর্থতা হিসেবে অসহনীয় যানজট, দুই সিটিতেই সামান্য বৃষ্টিতেই ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি, অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে মাসের পর মাস ফেলে রাখা, মেয়রের সঙ্গে সেবা সংস্থার সমন্বয় না থাকা ও জবাবদিহিতা না করা, যানজট নিরসন, পরিবহন খাতের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসার করা, মশক নিধন, বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ন্ত্রণ, মাংস, ও ফুটপাথসহ সব ধরনের হোটেল রেস্তরাঁর খাবারের মান নিয়ন্ত্রণে তেমন কোন ভূমিকাই পালন করতে দেখা যায় না। সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ ও নগর কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজ বাস্তবায়নে নির্বাচিত কমিশনারগণ কর্তৃক বাধা প্রদান উল্লেখযোগ্য। সরকার দুই মেয়রকে পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদায় দিয়ে কর্পোরেশনের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট ২৬টি সেবা সংস্থার সমন্বয়ের দায়িত্ব দিলেও কার্যকর তেমন কোন কিছুই চোখে পরছে না। সকল সংস্থাকে নিয়ে প্রতি তিন মাসে কমপক্ষে একবার বৈঠক করার কথা থাকলেও গত এক বছরে এ পর্যন্ত উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন একটি করে মাত্র ২টি বৈঠক করতে পেরেছেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী এসব বৈঠকে সকল সেবাদানকারী সংস্থার প্রধানগণ স্বশরীরে উপস্থিত থেকে নাগরিক সমস্যার সমাধানের কথা থাকলেও মন্ত্রী পদমর্যাদার মেয়রদের যেন তারা পাত্তাই দিচ্ছেন না। ফলে সমন্বয়হীনতায় ব্যাহত হচ্ছে নাগরিক সেবা। যার সরাসরি কুফল ভোগ করছেন নাগরিকগণ। তবে সার্বিকভাবে নাগরিক চাহিদার প্রথমার্ধের ২ বছরে অর্ধেকও পূরণ করতে পারেননি এই দুই সিটি মেয়র। এমনকি ওয়াদার শতভাগ কোন প্রকল্পের কাজই তারা শেষ করে দেখাতে পারেননি। ফলে সার্বিক কর্মকা- সম্পাদনে মোট পাঁচ বছরের মধ্যে দুই বছর বা মোট সময়ের শতকরা ৪০ ভাগ সময় চলে গেলেও দৃশ্যমান নির্দিষ্ট কিছু খাত ছাড়া তেমন উন্নয়ন চোখে পরছে না। বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ ও পরিবেশ দূষণ রোধসহ কোন দূষণ রোধে কোন প্রকার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেননি তারা। তবে পরিবর্তনের আভাস মিলছে তাদের উন্নয়ন কর্মকা-ে। বিশ্লেষকদের মতে, রাজধানীতে বসবাসকারীদের সেবা প্রদানে সরকারের ৫৬টি সেবা সংস্থার সমন্বয় করতে না অন্যতম সমস্যা ও দুই মেয়রের প্রধান ব্যর্থতা। শুধুমাত্র একটি কারণেই নাগরিক চাহিদা পূরণে প্রতিনিয়তই উন্নয়ন কর্মকা-ে থমকে যাচ্ছেন দুই মেয়র। এর বাইরে নির্বাচনকালীন ওয়াদা হিসেবে ‘নগর সরকার’ চালু করা বা এর কোন উদ্যোগও চালু করতে সক্ষম হয়নি কেউ। উন্নত বিশ্বের প্রায় সব দেশে নাগরিক জীবনে চলার পথে প্রয়োজনীয় সকল সমস্যার সমাধান নগর ভবন থেকে করা হলেও এক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা প্রতিফলিত রয়েছে। সরকারের সব সেবা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে কঠোর নির্দেশনা জারি করলেও এসব সেবাদানকারী সংস্থাকে দুই মেয়র কয়েক দফা চেষ্টা করেও কোন কূলকিনারা করতে পারছেন না। তবে উন্নয়ন কর্মকা- সম্পাদনে মেয়রদের গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ ও বৃহত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে আগামী ৩ বছরে রাজধানীর চেহারা পাল্টে যাবে। দুই মেয়রের মতে, সরকারের পাশাপাশি রাজধানীবাসী সহায়তা করলে চলমান কর্মকা- তথা নানা উদ্যোগ ও রাজধানীর উন্নয়নে নেয়া সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে উন্নত বিশ্বের মতো সবুজ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, স্মার্ট, আর বসবাস উপযোগী যানজটমুক্ত আধুনিক নতুন ঢাকা গড়তে পারবেন বলেই তাদের বিশ্বাস।
×