ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রি. জে. ওয়াজি হত্যাকাণ্ড

কেয়ারটেকার আহাদ দায় স্বীকার করলেও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৬ মে ২০১৭

কেয়ারটেকার আহাদ দায় স্বীকার করলেও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সাত মাস পেরিয়ে গেলেও সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ওয়াজি আহমেদ চৌধুরীর আলোচিত হত্যার মামলার চার্জশীট দাখিল হয়নি। যদিও বাড়ির কেয়ারটেকার আবদুল আহাদ হত্যার দায় স্বীকার করে ইতোমধ্যেই আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে আহাদ গুলশানে একটি ফ্ল্যাটের কার পার্কিংয়ে মারামারিকে কেন্দ্র করে হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটায় বলে স্বীকার করেছে। নিহতের ছোট ছেলে ফুয়াদ আহমেদ চৌধুরীর ধারণা, আহাদের জবানবন্দিতে গুলশানের মারামারির সঙ্গে জড়িতদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে হয়ত হত্যাকা- সম্পর্কে আরও অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ পেতে পারত। কারণ আহাদের একার পক্ষে একজন মানুষকে গলায় রশি পেঁচিয়ে, হাত-পা খাটের সঙ্গে বেঁধে শ্বাসরোধে হত্যা করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তবে কাফরুল থানার ওসি শিকদার মোঃ শামীম হোসেন জনকণ্ঠকে বলেছেন, জবানবন্দীতে নাম প্রকাশ পাওয়া সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আহাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর পরেও মামলাটির তদন্ত চলার কারণ সম্পর্কে তিনি কোন কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। গত বছরের ৫ অক্টোবর দুপুরে রাজধানীর মহাখালী ডিওএইচএসের ৪ নম্বর সড়কের ১৪৮ নম্বর চারতলা নিজ বাড়ির দ্বিতীয়তলা থেকে নৃশংসভাবে খুন হওয়া সেনা কর্মকর্তা ওয়াজি আহমেদ চৌধুরীকে (৭৬) বাড়ির ভাড়াটিয়াদের সহযোগিতায় উদ্ধার করেন নিহতের ছোট ছেলে ফুয়াদ আহমেদ চৌধুরী। এ ঘটনায় নিহতের ভাতিজা রেশাদ আহমেদ চৌধুরী গত বছরের ৬ অক্টোবর বাদী হয়ে রাজধানীর কাফরুল থানায় বাড়ির গৃহকর্মী আবদুল আহাদকে (৩৫) সন্দেহভাজন প্রধান আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। নিহতের ছোট ছেলে ফুয়াদের কথা স্পষ্ট বোঝা না যাওয়ার কারণে তারই চাচাত ভাই রেশাদ আহমেদ চৌধুরী মামলাটি দায়ের করেন। বাড়ির অন্যান্য ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়ারা জানান, ঘটনার সময় আলিয়া ও মাজেদা নামের দুই গৃহপরিচারিকা এবং আবদুল আহাদ (৩৫) বাসায় থাকলেও লাশ উদ্ধারের সময় তাদের কেউ ছিল না। মামলার অভিযোগে বলা হয়, হত্যার পর বাড়ি থেকে একটি ৪২ ইঞ্চি দেয়াল টেলিভিশন, দামী মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, স্যামসাং ট্যাব ও নগদ টাকা খোয়া গেছে। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়ে রিমান্ড শেষে আহাদ হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। আহাদের বাড়ি থেকে নিহত ওয়াজি আহমেদের ঘর থেকে খোয়া যাওয়া টেলিভিশন ও ল্যাপটপ উদ্ধার হয়। এ ব্যাপারে নিহতের ছোট ছেলে ফুয়াদ আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, আমার ধারণা আহাদের একার পক্ষে তার পিতাকে এভাবে হত্যা করা অসম্ভব। হত্যাকা-ের সঙ্গে আরও কেউ জড়িত থাকতে পারে। হতে পারে এটি গভীর কোন ষড়যন্ত্র। গুলশানে তাদের মালিকাধীন একটি ফ্ল্যাটের কার পার্কিংয়ের সূত্র ধরে তার সঙ্গে বাড়ির ম্যানেজার শাহ আলমের নেতৃত্বে কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মীর সঙ্গে তার মারামারি হয়। তারা আমাকে মারধর করে। মারধরের সময় আবদুল আহাদ আমার সঙ্গে ছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সে আমাকে মারধরের হাত থেকে রক্ষা করার কোন উদ্যোগ নেয়নি। যা খুবই রহস্যজনক। এ নিয়ে আহাদের সঙ্গে আমার পিতার ঝগড়া হয়। তারই সূত্র ধরে ক্ষিপ্ত হয়ে আহাদ আমার পিতাকে হত্যা করে বলে জানা গেছে। হত্যার পর আহাদ আমার ও পিতার রুম ছাড়াও আরও একাধিক রুমের সামনে তালা মেরে দেয়। ড্রয়িং রুমে থাকা বিশাল টেলিভিশন, ল্যাপটপ, বাসার আলমারির তালা ভেঙ্গে টাকা-পয়সা নিয়ে মহাখালী ডিওএইচএসের মতো সুরক্ষিত এলাকা থেকে পালিয়ে যায়। এমন বিষয়টিও রহস্যজনক। আমার ধারণা, আহাদ সহযোগীদের সঙ্গে আগে থেকেই পিতাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। হত্যার পর বহনযোগ্য মালামাল নিয়ে হত্যাকারীরা পালিয়ে যায়। একাই একজন মানুষকে হত্যার পর নিহতের বাড়ি থেকে মালামাল টাকা-পয়সা লুট করে তা নিয়ে ঠা-া মাথায় দিব্যি পালিয়ে যাওয়া রীতিমতো রহস্যজনক। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আহাদ জবানবন্দীতে ডিওএইচএস থেকে বিশাল টেলিভিশন, ল্যাপটপ নিয়ে রিক্সায় করে সে রাতে বের হয়। এরপর বাসে করে সিলেট চলে যায় বলে স্বীকার করে। অভিযোগ উঠেছে, যে রশি দিয়ে আবদুল আহাদ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে, তা নিহতের বাসার নয়। যদিও ঘটনার পর সেগুলো নিহত ওয়াজি আহমেদের বাসার বলে জানিয়েছিল তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগ রয়েছে, রশিগুলো গুলশানের ওই বাসা থেকে আনা। যা পরিকল্পিত হত্যাকা-ের ইঙ্গিত দেয়। হত্যার মাস্টারমাইন্ড এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়েছে। ওয়াজি আহমেদকে হত্যার ধরন সম্পর্কে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহযোগী ্যাপক ডাঃ সোহেল মাহমুদ জনকণ্ঠকে বলেন, ওয়াজি আহমেদ চৌধুরীর গলায় রশি পেঁচিয়ে পা বেঁধে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে আলামত পাওয়া গেছে। নিহতের শরীর থেকে ডিএনএর আলামত সংগ্রহ করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা কাফরুল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হাফিজ আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ডিএনএর নমুনা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে। ডিএনএ রিপোর্ট পাওয়ার জন্য সিআইডির সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। পাশাপাশি মামলাটির গভীর তদন্তও অব্যাহত আছে। তদন্তে বিশেষ কোন কিছু তথ্য না পাওয়া গেলে দ্রুত মামলাটির চার্জশীট দাখিল করা হবে। নিহতের ছেলের ধারণার বিষয়টি মাথায় রেখে অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে জিজ্ঞাসাবাদে উল্লেখযোগ্য কোন তথ্য মেলেনি। প্রসঙ্গত, নিহত সেনা কর্মকর্তা ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান। নিহতের স্ত্রী ছিলেন আতিয়া চৌধুরী। বড় ছেলে নাবিদ আহমেদ চৌধুরী (৪৪) পরিবারের সঙ্গে আমেরিকায় বসবাস করেন।
×