ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এসএসসির খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি সংস্কারে ইতিবাচক ভবিষ্যত দেখছেন বিশেষজ্ঞরা

পাসের হারে বড় ধাক্কা লাগলেও গুণগত পরিবর্তন আসবে

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৬ মে ২০১৭

পাসের হারে বড় ধাক্কা লাগলেও গুণগত পরিবর্তন আসবে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি সংস্কার করে নম্বর বণ্টনে কঠোরতা অবলম্বনের ফলে এসএসসিতে পাসের হারে বড় ধরনের ধাক্কা লাগলেও এ উদ্যোগে ইতিবাচক ভবিষ্যত দেখছেন শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সৃজনশীল প্রশ্নে বেশি নম্বর পাওয়ার সুবিধা আর খাতা মূল্যায়নে লাগামহীন উদারতার কারণে সাফল্যের বিস্ফোরণ ঘটলেও মান হয়ে উঠেছিল প্রশ্নবিদ্ধ। খাতা মূল্যায়নে পদ্ধতিগত দুর্বলতার কারণে একদিনে পাসের হার চলে যাচ্ছিল শতভাগের দিকে, অন্যদিকে সর্বোচ্চ গ্রেড জিপিএ-৫ বাড়ছিল পাল্লা দিয়ে। এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরী ছিল বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। নতুন পদ্ধতিকে যথাযথ ও সময়োপযোগী অভিহিত করে তারা বলেছেন, এর ফলে শিক্ষায় গুণগত পরিবর্তন আসবে। বিশেষজ্ঞরা একই সঙ্গে বলেছেন, আমরা বহু বছর ধরেই বলে আসছি, পরীক্ষা পদ্ধতি ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হবে। প্রকাশিক ফল প্রমাণ করে উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ বলে যে ধারণা ছিল, সেটাই বাস্তব। তবে নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্রের মডেল তৈরি করাকে অনেকে ‘বাটখারা’ অভিহিত করে বলেছেন, এটা হচ্ছে অস্থায়ী সমাধান। স্থায়ী একটি সমাধানের জন্য শিক্ষকদের এ বিষয়ের সঙ্গে আরও পরিচিত করে তুলতে হবে। শিক্ষকরাই যেন হয় সেই বাটখারা। শিক্ষার বিষয়, পরীক্ষার বিষয় ও মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে সকল শিক্ষককে জানাতে হবে। ট্রেনিং দিতে হবে। তাহলেই আসবে ভাল সমাধান। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, এবারের ফলাফল দেখে কেউ বিস্মিত হতে পারেন, কারও কারও কাছে ধাক্কা বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তার কাছে এটা প্রত্যাশিতই ছিল। যদিও গত বছর ৮৮ দশমিক ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করার পর এই হার আরও বাড়ার প্রত্যাশার কথা বলেছিলেন তিনি। বছর বছর পাস বাড়লেও শিক্ষার মান বাড়ছে নাÑ এমন অভিযোগও তিনি প্রত্যাখ্যান করে আসছিলেন। যদিও এবার তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে আগে পরীক্ষকদের গাফিলতি আর পদ্ধতিতে ত্রুটি ছিল। এবার নতুন পদ্ধতিতে ‘যথাযথ’ মূল্যায়ন হওয়ায় পাসের হার কিছুটা কমেছে। আগে অনেক পরীক্ষক দায়সারাভাবে খাতা দেখতেন, তাদের মূল্যায়নের পার্থক্যও হত অনেক বেশি। ফলে শিক্ষার্থীদের কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হতো, কেউ আবার বাড়তি সুযোগ পেয়ে যেত। এবার প্রথমবারের মতো খাতা মূল্যায়নে নেয়া হয়েছিল নতুন উদ্যোগ। যা কার্যকর করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সেসিপ প্রকল্পের একটি ইউনিট। বাংলাদেশ এক্সামিনেশন ডেভেলপমেন্ট ইউনিটের (বেদু) উদ্যোগে বাস্তবায়িত নতুন এ পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়ন হওয়ায় পরীক্ষায় পাসের হার কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। কমেছে জিপিএ-৫-সহ বেশকিছু সূচক। তিন বছর গবেষণা করে এবার একটি নমুনা ও মানদ- ঠিক করে দেয়ায় শিক্ষার্থীদের খাতা মূল্যায়নে ‘সমরূপতা’ এসেছে বলে দাবি করলেন আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি ও বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এ চেয়ারম্যান বলছিলেন, আমাদের পরীক্ষার খাতা দেখার যে রেওয়াজ অতীতকাল থেকে চলে আসছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ ছিল আমাদের সামনে। বোর্ড থেকে তালিকাভুক্ত শিক্ষকরা খাতা নিয়ে যেতেন, সেই খাতা দেখে আবার জমা দিতে যেতেন, এখানেই শেষ। এটার কোন ভাল মনিটরিং ছিল না, কোন নিয়মরীতি আমাদের ছিল না। তিন বছর ধরে গবেষণা করে শিক্ষকরা কীভাবে খাতা মূল্যায়ন করেন তা দেখেছে বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট। এর প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, তারা শিক্ষার গুণগত পরিবর্তন আনতে চান, সে জন্যই পরীক্ষা পদ্ধতি ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ। সারা দেশে ইউনিফর্ম মূল্যায়ন পদ্ধতি হয়েছে। শিক্ষকরা আগে ঢালাওভাবে নম্বর দিতেন এবার সেই সুযোগ রাখিনি। এবার উত্তরপত্রের কোয়ালিটি মূল্যায়ন হয়েছে, এটা অব্যাহত থাকবে। আরও নতুন নতুন উদ্যোগ নেয়া হবে। সব পাবলিক পরীক্ষার খাতা নতুন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হবে বলেও জানান শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান। কিন্তু নতুন পদ্ধতিটা কী, কিভাবে তা প্রয়োগ করা হয়েছে? এমন প্রশ্নে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলছিলেন, শত বছরের পুরনো পদ্ধতি ছিল। এই সময়ে শিক্ষা পদ্ধতি অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাই আগের খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতির ফলে পরীক্ষায় বড় ধরনের বৈষম্য তৈরি হত। একটা খাতা বাছাই করে ২০টি কপি করে ২০ জন শিক্ষককে দেয়া হলো। দেখা গেল খাতায় ২০ ধরনের নম্বর দেয়া হয়েছে। ১০ এর মধ্যে কেউ দিয়েছেন ৮, কেউ ৬, কেউ ৫, কেউ ৭ নম্বর। এমন তারতম্য হয়ে যাচ্ছে। তিন বছরের গবেষণার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, এবারের এসএসসির উত্তরপত্র মূল্যায়নে তা কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এটা থেকে বেরিয়ে আসতে আমারা প্রধান পরীক্ষকদের ওই মূল্যায়নের ভিত্তিতে প্রস্তুত করেছি, একটা ট্রেনিংও দিয়েছি। তাদের অধীনে যে পরীক্ষক তাদেরও সংক্ষিপ্ত ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। এবার পরীক্ষায় বাস্তবে প্রয়োগ করার লক্ষ্য নিয়ে আমরা অগ্রসর হই। পদক্ষেপ যখন আমরা নিতে গেছি তখন ভাল করে বুঝতে পারছি এটার একটা প্রভাব হয়ত আমাদের ফলাফলে পড়তে পারে। মন্ত্রী আরও বলেন, সব পরীক্ষক চাপের মধ্যে ছিলেন, সে জন্য এবার খাতা মূল্যায়নে ‘ফাঁকি দেয়ার’ সুযোগ ছিল না। কীভাবে খাতা মূল্যায়ন করতে হবে সে বিষয়ে প্রথমে একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। তার আলোকে বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট ছয় পৃষ্ঠার একটি নির্দেশনা পরীক্ষকদের দেয়। পরীক্ষার পর প্রধান পরীক্ষকরা ও ভাল শিক্ষকরা বসে মোটামুটি উত্তরটা কি হওয়া উচিত, এর উত্তরটা তারা তৈরি করেন। বলা হচ্ছে, এটা হচ্ছে সাধারণ উত্তর। এটাকে মানদ- ধরে শিক্ষক নম্বর দিয়েছেন। এর চেয়েও ভাল কেউ লিখতে পারে। এটা আমরা এবার কার্যকর করেছি। এ জন্য এবার খাতা ভালভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। আমাদের ফলাফল দেখে মনে হবে অনেক বেশি ফেল করেছে কিংবা জিপিএ-৫ কম পেয়েছে ইত্যাদি। বিস্ময় হতে পারে যে আমাদের লেখাপড়া খারাপ হচ্ছে, ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় খারাপ করছে। কিন্তু বিষয়টা ঠিক এভাবে নয়, আমরা এ জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কারণ জানি আমরা যে পদক্ষেপগুলো নিতে যাচ্ছি তার প্রভাবে প্রথম দিকের পরীক্ষায় এভাবেই পড়তে পারে। এদিকে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা অনেক দিন ধরেই পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের কথা বলে আসছিলেন।
×