ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

শাখা-প্রশাখা গাছ ও আগাছার রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ৬ মে ২০১৭

শাখা-প্রশাখা গাছ ও আগাছার রাজনীতি

দলে কাউয়া বা মুরগি আগে ছিল না? থাকলেও বলা হয়নি। এখনকার সাধারণ সম্পাদক বলছেন তবে বেশি বলছেন। এই বলার পেছনে সত্য থাকলেও মানুষ হতাশ। যারা সমস্যার সমাধান করবেন তারাই যদি অভিযোগ করেন তো আমরা যাব কোথায়? দেশময় এখন শুধু আওয়ামী লীগ। লোকজনে বলে কারও গায়ে ধাক্কা লাগলেও নাকি আওয়ামী ধাক্কা খেতে হয়। এত আওয়ামী লীগ কেউ জনমেও দেখেনি। সত্যি কথা বলতে কি বঙ্গবন্ধুর আমলেও সবাই রাতারাতি এমন আওয়ামী লীগার হয়ে যায়নি। যখন হয়েছিল তখন তার নাম বাকশাল। দলে দলে বাকশালে যোগ দেয়া নেতা-পাতি নেতা, সিভিল আর্মি পার্সোনালিটির একজন ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। ভাবা যায় তিনিও বাকশালের আদর্শে উদ্দীপ্ত হওয়ার ভান করেছিলেন? তার দল বিএনপি যখন গণতন্ত্র হত্যার জন্য একনায়কত্বের কারণে বাকশাল ও বঙ্গবন্ধুকে দায়ী করেÑ তখন তারা সে কাহিনী ভুলে যায়। খন্দকার মোশতাকের মতো বিশ্বাসঘাতকও বাকশালে ছিল। ছিল আওয়ামী লীগের নেতা। আজ এই যে দলে দলে-কাতারে কাতারে আওয়ামী লীগে যোগদান ও লীগার হয়ে যাওয়া এর পেছনে যে দুরভিসন্ধি বা খায়েশ বা ষড়যন্ত্র সেটা বোঝার পরও দল আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। এই সেদিনও যখন শাপলা চত্বরের ঘটনার পর দেশে জামায়াত-হেফাজত-বিএনপির ইন্ধনে নৈরাজ্য মেতে উঠেছিল কোথায় ছিল এত আওয়ামী লীগার? পুলিশ বাহিনী না থাকলে আজকের নব্য লীগারদের টিকিও পেতাম না আমরা। কে না জানে এর বেশিরভাগই গড়ে উঠছে কিছু পাওয়ার আশায়। আজ যদি দল গদিতে না থাকে এদের দেখা মিলবে না। বিএনপির দিকে তাকালেও এর জবাব মিলে যেত। কি দিন ছিল তাদের। দেশের আনাচে-কানাচে শুধু বিএনপি আর ধানের শীষের জয়জয়কার। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়াÑ সবাই বলে জিয়া, জিয়া সেøাগানে দেশ মাথায় তোলা সেই বাহিনী আজ নেই। নেই সেই ছাত্রদল যারা রোকেয়া হলের ছাত্রীদের ওড়না কেড়ে নিয়েও ভোটে জিতেছিল। জেতার পর এও বলেছিল, এটাই নাকি নিয়ম। যে মারে সে বাঁচাতেও পারে। সেই আস্ফালন সময় ঠিক গুনে রেখেছিল। কোথায় আজ তারেক জিয়া? একসঙ্গে সবকিছু বোঝা ও জানার লায়েক হয়ে ওঠা তারেক জিয়াই বিএনপির কবর খুঁড়ে দিয়েছিল। সেই সময় ছাত্রলীগকে দেখেছি কোনভাবে আত্মসম্মান বাঁচাতে। তাদের এমন হাল হয়েছিল মনে করা হতো রাজপথই আওয়ামী লীগের শেষ আশ্রয়। সেই জায়গা থেকে আওয়ামী লীগ কি নিজের পাওয়ারে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিল আসলে? না তাদের দ্বারা বিএনপিকে কোণঠাসা করা বা গদিচ্যুত করা ছিল সহজ কিছু? সে কাজটা হয়েছিল ওয়ান ইলেভেনে। যেভাবে হোক তারাই বিএনপিকে সাইজ করার কাজটি করে। সে সময় হয়ত ইতিহাসের এটাই প্রাপ্য ছিল। ইতিহাস তাই করেছে। শেখ হাসিনার হাতে দেশের শাসনভার যাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের চেহারা ফিরতে শুরু করে। একদিকে তার গায়ে লেগেছে উন্নয়নের হাওয়া, আরেকদিকে তিনি হয়ে উঠেছেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার নেতৃত্বের এমন গুণাবলী আগে কেউ দেখেনি, ভাবতেও পারেনি। সময়ের হাত ধরে উঠে আসা বঙ্গবন্ধু কন্যা জামায়াত-শিবিরের মূলে আঘাত করেছেন। ইতিহাসের দায় চুকিয়েছেন। বাংলাদেশের গায়ে চাপিয়ে দেয়া মানবাধিকার, মানবতার কলঙ্ক ঘুচিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে, তাদের শাস্তি দিয়ে তিনি যে অমর কাহিনী রচনা করে চলেছেন তার কথা লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়। সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে তার নাম। আজ যারা তার বিরুদ্ধে নানাভাবে কুৎসা রটাচ্ছেন তাকে চোখের শূল মনে করছেন একদিন তারা হার মানবেই। আমার কথা বিশ্বাস না হলে দেশের ইতিহাস ও সময়ের বিচারের দিকেই তাকান। এক সময় যারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতেন, তাঁর নামে আজেবাজে কথা বলতেন, তঁাঁকে অপমান করতেন তারা আজ ঘাড় নামিয়ে মেনে নিয়েছে তাঁকে। জামায়াত-বিএনপির হাজার অপচেষ্টা রক্তমাখা কেকের পরও সেটা হয়নি। খালেদা জিয়া মুখে যাই বলুন ভেতরে খুব ভাল জানেন বঙ্গবন্ধুকে না মানার কারণে এবং তাঁকে অপমান করতে গিয়েই আজ তার এই দশা। মানুষ আর যাই নিক এটা নিতে পারেনি। এই যে সহস্র ভুলের বেড়াজাল বিএনপিকে নিঃশেষ করে এনেছে তার কিছু কিছু আওয়ামী লীগের বেলায়ও ঘটছে এখন। এত এত আওয়ামী শাখা লীগের দরকার কি? কোথা থেকে আসছে এরা? ওলামা লীগের দায় না নেয়া আওয়ামী লীগের নেতারা ভাল জানেন এরা কারা। কি কারণে তারা মাঝে মাঝে হেফাজতী কায়দায় কথা বলে। যেসব কথা ও কাজ লীগের আদর্শ বা চেতনার সঙ্গে যায় না সেগুলো বলে কাদের খুশি করা? যাদের মন ভজানোর জন্য এই অপচেষ্টা তারা জীবনেও আওয়ামী লীগ করবে না। নৌকায় ভোট দেবে না। বরং এতে যারা আদর্শের কারণে লীগকে ভালবাসে তারাই মুখ ফিরিয়ে নেবে একসময়, সেদিনও খুব বেশি দূরে নয়। এমন কোন লীগ নেই যা গঠিত হয়নি। হকার লীগ, ভিখারি লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আমীর লীগ, ফকির লীগÑ এত উপশাখার পরও বড় মুশকিল কেউ এদের ঠেকায় না, সেদিন দেখি শিশু লীগও হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে একবার এক অনুষ্ঠানে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, যেনামে সেøাগান দেয়া হচ্ছে তেমন কোন লীগের কথা জানেন না তিনি। ব্যস্ত ও সচল প্রধানমন্ত্রী সব জানবেন কিভাবে? তাঁর ওপর পুরো দেশের দায়িত্ব। সে কারণেই তো আছে নেতারা, আছে সম্পাদক। তাঁরা কি জানেন না আওয়ামী প্রতিবন্ধী লীগ গঠনের কাজও প্রায় শেষ। এভাবে চললে দেশের মানুষের মনে যে বিদ্বেষ ও নেগেটিভ ধারণা বাসা বাঁধছে তার বহির্প্রকাশ হবে মারাত্মক। আসলে লীগের রাজনীতি বা দলের রাজনীতি কোথায়? এখন এই পরিবর্তিত বিশ্বে রাজনীতির ধরন পাল্টে গেছে। মানুষ মাঠে গিয়ে সভা-সমিতিতে যোগ দিয়ে ভাষণ শুনতে নারাজ। তার কোন প্রয়োজনও পড়ে না। সব মানুষই একেকটি মিডিয়া। সবার হাতের মোবাইল মানে ক্যামেরা বাটন চাপলেই দুনিয়া হাজির। তার কি দরকার নেতাদের কথা শোনার? কি বলবেন তারা? নতুন কি তথ্য দেবে আমাদের বয়স্কজনরা? আর নতুনরা তো এসবে নেই। তাহলে এত উপদল এত শাখা গঠন করছে কারা? একশ্রেণীর ধান্দাবাজ বিরিয়ানি প্যাকেট আর পানির বোতল দিয়ে কিছু মানুষকে অল্প সময়ের জন্য খুশি রাখতে পারলেও এটা কোন সমাধান বা পথ হতে পারে না। আসলে রাজনীতি এখন বন্ধ্যা। এই বন্ধ্যা সময়কে পুঁজি করে টু পাইস কামানো শাখা-প্রশাখা বিস্তারকারীরা চাইছে নিজেদের আখের গোছাতে। এমন তো নয় যে, এ দেশে কোন দিন স্বাভাবিক নির্বাচন বা রদবদল হবে না। সে নির্বাচনে বা সে সময়কালে এরা নৌকাকে তীরে ভেড়াবে না, তরী ডোবাবে? এ কথা জানার পরও আওয়ামী লীগের মতো দলের নেতারা মূক, নীরব। এটা মানি প্রধানমন্ত্রীর সময় নেই। তাঁর ওপর দেশের ভার তাঁর ওপর নির্ভর করছে মানুষের ভবিষ্যত। তিনি এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও খ্যাতির শীর্ষে। যখন যেখানে যাচ্ছেন নিয়ে আসছেন যথার্থ সম্মান। জার্মানির চ্যান্সেলর থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীÑ সবাই তাঁকে যতœ করেন। এর কারণ কি শুধু পছন্দ? এর পেছনে আছে বাংলাদেশের ধারাবাহিক উন্নয়ন, আছে স্বপ্নপূরণে মানুষের শ্রমের অবদান। সে ফসল আওয়ামী লীগের শাখা-প্রশাখার নামে হাতছাড়া হতে দেয়া কি উচিত? সাধারণ সম্পাদকের কি কোন দায় নেই? তিনি তো প্রায়ই মাঠে ঘুরে বেড়ান। তাঁর কি এসব কথা বা কর্মকা-ের খবর জানা নেই? থাকলে কোথায় তার প্রতিকার? মানুষ ধীরে ধীরে বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের জানা প্রয়োজন তারা হেরে গেলে তাদের লোকসান বা হারের মূল্য যতটা তার অনেকগুণ বেশি মূল্য শোধ করতে হয় এ দেশের মানুষদের। তাদের চারপাশে ডাকাত অন্ধ আর মৌলবাদের ভেতর তারা যাদের মন্দের ভাল হিসেবে বেছে নেয় তারা যেন মনে না করে তারাই দরবেশ বা সাধু। টেন্ডার, চাঁদাবাজি, মস্তানি আর লোভে গজিয়ে ওঠা এত এত আওয়ামী শাখা-প্রশাখার বিস্তার বন্ধ না হলে সময় ছেড়ে কথা বলবে না। তা ছাড়া এত দল আমরা রাখবই বা কোথায়? এভাবে দলীয়করণ আর লীগের নামে মানুষ ক্ষেপিয়ে তোলার পরিণাম ভাল হবে না। হতে পারে না। তারপরও চলছে, চলবে। সরকারে থাকলে যারা অন্ধ বা বধির তারা জানেন না জনগণ এখন বলাবলি করছে, এত লীগ আমরা রাখব কোথায়? [email protected]
×