ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রী ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

রবীন্দ্রনাথের গান ॥ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতের ক্রমবিকাশ

প্রকাশিত: ০৭:০২, ৫ মে ২০১৭

রবীন্দ্রনাথের গান ॥ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতের ক্রমবিকাশ

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতের ক্রমবিকাশটি বুঝলেই তিনি সমগ্র হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের বিকাশধারাকে কতটুকু বরণ করেছেন বুঝতে পারবো রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতে তিন চারটি স্তর আছে। প্রথম যুগে কিংবা স্তরে তিনি ভাল ভাল খানদানী ‘ঘরোয়ানা চীজের, সুরকে আশ্রয় করে গান রচনা করেছেন। যদু ভট্ট ও রাধিকা গোস্বামী এবং সেই সময়কার বড় বড় ওস্তাদের মুখে তিনি খুব ভাল চালের ধ্রুপদ ও খেয়াল শুনতেন, তার সেজদাদা জ্যোতিবাবু এই সুর নিয়ে পরীক্ষা করতেন, সেই সুরে রবীন্দ্রনাথকে গানের কবিতা লিখতে বলতেন। এই যুগে তার গান শুদ্ধ তানে মানে, লয়ে, সে গানের চাল অধিকাংশই ধ্রুপদ, ধামার, সাদ্রা অর্থাৎ ঝম্পের, ধ্রুপদের চারটি পদ মীড়, মুর্চ্ছনা সবই তার এই যুগের গানে আছে। গানের বিষয়গুলোও গুরুগম্ভীর। দ্বিতীয় যুগে তিনি সেই খানদানী কাঠামোর ভেতরেই একটু সুরের ও তালের নতুনত্ব করছেন। কাঠামোটি সেই পুরনো, কিন্তু কিসের একটা তাগিদ তিনি পূরণ করতে পারছেন না, তাই কাঠামোর ওপর রঙটি বদলাতে হচ্ছে অলঙ্কারগুলোকে একটু নতুন রকমে সাজাতে হচ্ছে। এ প্রয়োজনটি কিসের? আমার মতে এ প্রয়োজন একটি বিশেষ সড়ড়ফ-এর ভাবের, খেয়ালের। ওস্তাদের মুখে যখন মল্লারের বিশেষ ধংংড়পরধঃরড়হ গুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে, অথচ বৃষ্টিধারার বিরাম নেই, মেঘ আপন খেয়ালে নিরুদ্দেশযাত্রা করছে, প্রাণ আকুল হয়ে উঠেছে, তখন মল্লারের আশ্রিত স্মৃতিগুলোকে রূপ দিতে হলে রাগিণীকে ওস্তাদের কবল থেকে মুক্ত করতে হবে, তাকে মনোভাবের উপযোগী করার জন্য কিছু অদল বদল করতে হবে। সেই জন্যই রাগিনিতে নিখাদ উপরি উপরি না দিয়ে গানের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় রাখতে হবে। রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় যুগে এই কারণেই ‘সুরভ্রষ্ট’ হয়েছেন। বাস্তবিক পক্ষে, সুর মনের একটি ভাষা, ভাষা ভাবকে প্রকাশ করে, অবশ্য যা তা ভাবকে নয়। ভাব কিন্তু একই ধারায় চলে না, তার বৈচিত্র্যতা আছে, বর্ষার সময় কারুর ছোলা ভাজা খেতে ইচ্ছে করে, কারুর মেঘদূত পড়তে ইচ্ছা করে, কারুর বা গান শুনতে ইচ্ছে হয়। মানুষের মনের গতি মোটামুটি এক হলেও প্রত্যেক মানুষের, বিশেষ করে, প্রত্যেক আর্টিস্টের খেয়াল বিভিন্ন। এই বিশিষ্ট মনোভাবের দাবি হিন্দুস্থানী সুরের ওস্তাদের মুখে পূরণ হয় না। আমাদের ধারণা ছয় রাগ ছত্রিশ রাগিণীতে পরিণত হলো, প্রত্যেক রাগিণী আবার ছত্রিশ ভাগে মল্লারে দুটো ভাগ হলো। এটা ঠিক এইভাবে হয়েছে কিনা জানি না, তবে আমাদের সঙ্গীতে প্রত্যেক রাগিণীর নানা রূপ আছে। এই বৈচিত্র্যের তাৎপর্য কি? তাৎপর্য এই, মানুষই যখন গান গেয়ে থাকে, যখন মানুষ নিয়েই কারবার, তখন তার মনোভাবের বৈশিষ্ট্যকে স্বীকার করতেই হবে। অতএব হিন্দুস্থানী সুরের কাঠামোকে অদল বদল করার প্রয়োজনীয়তা আছে। মানবমনের বৈচিত্র্যকে রূপ দেয়ার অধিকার আছে, যে অধিকার অষ্টাদশ কানাড়ার অস্তিত্বে বিশ্বাসের মধ্যে গুপ্ত রয়েছে। এই কারণে এই বিশ্বাসের জোরেই, রবীন্দ্রসঙ্গীতকে বিচার করা ঐতিহাসিক সমীচীনতা। একটি কথা মনে রাখতে হবে যে নতুনত্বটুকুর মধ্যে গুরুচ-ালী-দোষ আছে কিনা। গানে অনেক ধরনের গুরুচ-ালী-দোষ ওঠে স্বরের দিক থেকে বিবাদী স্বরকে বাদী করা, গতির দিক থেকে আরোহীর নিয়মকে রক্ষা না করা, ভাবের দিক থেকে গুরুগম্ভীর ভাবকে হালকা সুরে ব্যক্ত করা, তালের দিক থেকে ভারি সুরকে হাল্কা তালে বসানো প্রভৃতি রকমের গর্হিত আচরণ সম্ভব হয়। এক কথায় বলতে গেলে রীতিবিরুদ্ধ কাজ করার নামই গুরুচ-ালী। কিন্তু সামান্য অদল বদল করার অধিকার শাস্ত্রেই দিয়েছে, বিবাদী স্বরকে দেখানোর রীতিও আছে। একটা শ্লোকে আছে বাদী রাজা ও বিবাদী শত্রু। রাজা যেমন তার প্রজাকে ক্ষমতা দেখাবার জন্য শত্রুকে কয়েদ করেছেন তেমনি গায়ক তার কৃতিত্ব দেখাবার জন্য বিবাদী স্বরকে ব্যবহার করতে পারেন। বরোদার দরবারী গাইয়ে ফৈয়াজ খাঁ এবং আব্দুল করিমের মুখে ও কেরামত খাঁর হাতে মালকোষে পঞ্চম লাগিয়ে গাইতে শুনেছি, তাতে মালকোষের সাধারণ মনোময় রূপটি নষ্ট হয়নি। তবে আর্টের ক্ষেত্রে অন্তত জেনেশুনে পাপ করলে সেটি পাপ থাকে না এই যা। আদত কথা হচ্ছে রূপটি রক্ষা করতে হবে এবং সে রূপটি নিতান্তই অভ্যাসের ক্রীতদাস।... ব্যাপার হচ্ছে, ড়ঢ়ঢ়ড়ংরঃরড়হ রিঃযরহ ঃযব পড়হংঃরঃঁঃরড়হ হলেই সঙ্গত হয়। রবীন্দ্রসঙ্গীতের দ্বিতীয় স্তরে এই জিনিসটি রয়েছে, সেই জন্য এই যুগের গান অনেক ওস্তাদও গেয়ে থাকে। এই যুগে তিনি যদি ক্ষান্ত হতেন, তাহলে তাকে শুধু একজন উচ্চস্তরের নিধুবাবু কিংবা যাত্রাগানের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা বলতাম। কিন্তু এই দ্বিতীয় যুগের শেষভাগে তিনি এক নতুন পরীক্ষা করলেন। শুধু এক সুরের সঙ্গে সেই জাতেরই অন্য সুর মিলিয়ে তিনি সুখী হলেন না, সৃষ্টির এক নতুন উৎসের সন্ধান পেলেন। সে উৎস অতি নিকটেই ছিল, একেবারে হাতের কাছে, দ্বারের পাশে, পল্লীগ্রামে। কবি চিরকালই পল্লীজীবনের ভক্ত, শহরের কৃত্রিমতা তার কখনও ভাল লাগে না। তার জীবনের বোধহয় সবচেয়ে সুখের সময় ছিল যখন তিনি পদ্মার দুধারের গ্রামের ঘাটে নৌকা ভেড়াতেন। মাঠে-ঘাটে, নদীর ধারে, তিনি বৈরাগীর বাউল ভাটিয়াল, মাঝিদের সারি গান, পল্লী উৎসবের ঐক্যসঙ্গীত শুনে বেড়াতেনÑ তার প্রাণে ওই প্রকার গানের সুরের আবেগ, ভাবের সরল স্বাধীনতা ও গভীরতা সাড়া দিত। নিতান্ত স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মতো তিনি এই পল্লীসঙ্গীত, এই লোকসঙ্গীতের মর্ম গ্রহণ করলেন। এখানে তার প্রতিভা। জীবনের সমগ্র ধারাকে নিজের সৃষ্টির মধ্যে বহমান করান প্রতিভার কাজ। আমরা পূর্বে দেখেছি যে হিন্দুস্থানী দরবারী সঙ্গীত এতদিন যে বেঁচে এসেছে তার অন্যতম কারণ এই যে তার ক্রাইসিসের সময় থেকে সঙ্গীতের রক্ত তার শিরার মধ্যে ইনজেক্্ট্ করানো হয়েছিল। সে জন্য রবিবাবুর গানের তৃতীয় স্তরে ভাটিয়াল, বাউলের আগমন লক্ষ্য। এই যুগের গানের দরবারী সুর-পদ্ধতির সঙ্গে ভাটিয়াল-বাউলের মিশ্রণ হয়েছে। এর পরের যুগের গানই তার গানের শ্রেষ্ট কীর্তিÑ তা আমাদের আগেকার গানের মতো ভাল লাগুক আর না লাগুক-এর কথাগুলো হয়তো গীতাঞ্জলির মতোন নয়, তবু এর মধ্যে এমন একটি সংযম আছে, কথা ও সুরের মধ্যে এমন একটি মিল আছে, তার সৌষ্ঠব এত হৃদয়গ্রাহী তার আবেদন একসঙ্গে এত ঢ়বৎংড়হধষ ও রসঢ়বৎংড়হধষ যে তার থেকে আনন্দ না পেয়ে থাকা যায় না। লোকসঙ্গীতের গ্রাম্যতা, তার অসংযত আবেগ ও চিৎকার এর মধ্যে নেই, তেমনি দরবারী সঙ্গীতের অজস্র তানের ও তালের নিরর্থক গু-ামিও এর মধ্যে নেই। অথচ তাদের সদ্্গুণ সবই রয়েছে, আনন্দের সব উচ্চাঙ্গের উপাদানই রয়েছে, লোকসঙ্গীতের ভাবসম্পদ এবং দরবারী সঙ্গীতের সূক্ষ্ম কারুকার্য ভদ্রতা ও শালীনতা। বিচিত্র সুরের ও মিশ্রণের প্রয়োজন রয়েছে। সে প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথ মিটিয়েছেন হিন্দুস্থানী সুর পদ্ধতির ধনংঃৎধপঃ হধঃঁৎব কে পড়হপৎবঃব করে ও এক কথায় সুরকে যঁসধহরংব করে, অথচ তাকে আর্ট থেকে ধৎঃরভরপব-এর নিচু পঙ্ক্তিতে নামতে না দিয়ে। শুনেছি ও পড়েছি বিলেতে বিট্হোফেন এই কার্য করেছিলেন। যদি সত্য হয়, তাহলে রবীন্দ্রনাথকে তারই সঙ্গে তুলনা করা চলে। আমাদের দেশে সমতুল্য পড়সঢ়ড়ংবৎ জন্মায়নি। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে ‘রবি প্রনাম’ শিরোনামে সারেগামার সঙ্গীত এ্যালবামে প্রকাশিত। তবে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নিবন্ধটি এইচ এম ভি প্রকাশিত রবীন্দ্র শতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ ‘রবীন্দ্রগীতি মালিকা’য় প্রথম প্রকাশিত।)
×