ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বই ॥ ভালোবাসার ভাস্কর্যে নির্মিত পঙক্তিমালা

প্রকাশিত: ০৭:০০, ৫ মে ২০১৭

বই ॥ ভালোবাসার ভাস্কর্যে নির্মিত পঙক্তিমালা

মানুষ নিরন্তর তার ভালোবাসার বাতিঘর খোঁজে। যে স্বপ্ন হারিয়ে গেছে তাকে যেমন খোঁজে যা হারায়নি তারও অন্বেষণ করে প্রাণময়। স্বপ্নের কোন আগাপাশতলা নেই। কেবল পাওয়ার আনন্দ আছে, আর না পাওয়ার বেদনা আছে মানুষের আকাক্সক্ষার কোন পরিপূর্ণতা নেই। শুধু একা বসবাসে সে নিঃসঙ্গ নয়, ভিড়ের মধ্যেও সে একলা একা। নৈঃসঙ্গতার বেদনাবোধ তার অস্তিত্বকে ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত করে। কবি জাফরুল আহসানের ‘আমি যে তোর খেলার সাথি’ কাব্যগ্রন্থে এই নৈঃসঙ্গবোধ প্রবলভাবে ছায়া ফেলেছে। যদিও তাঁর কবিতায় ঈর্ষণীয় নিপুণ ছন্দে উপস্থাপিত হয়েছে, মানুষ, প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ, রাজনীতি, ভাষাপ্রীতি, মুক্তিযুদ্ধ, স্মৃতিকাতরতাসহ বিবিধ বিষয়। সকল বিষয়ে জাফরুল আহসান সিদ্ধ-দক্ষ কারিগর। তাঁর কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, একটি সাধারণ সহজ বিষয় উপস্থাপনায় গভীর দার্শনিকতা। বিষয়ানুসারে প্রত্যেকটি শব্দের ঘ্রাণ নিয়ে বড় ভালোবেসে যতœকরে কবিতার শরীর নির্মাণ করেছেন জাফরুল। প্রতিটি কবিতায় রয়েছে নান্দানিক শৈল্পিক বিন্যাস। ‘আমি যে তোর খেলার সাথী’ গ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘তুমি এসো বসন্ত সন্ধ্যায়’ প্রথম লাইনটি এরকমÑ ‘প্রিয়তমা আমার, তোমার বুঝি মন ভালো নেই/’, কবিতাটি শেষ করেছেন এভাবে-‘মন ভালো নেই মানলাম, তবু বলি বসন্ত এসেছে দ্বারে/ যৌবনের আমন্ত্রণ পাঠালাম বসন্ত বাতাসে প্রকৃতির রং মেখে-দীপ্ত চরণে দৃঢ় চিত্তে/ তুমি এসো, তুমি এসো বসন্ত সন্ধ্যায়/’ কবি নিঃসঙ্গ-একা তাই ব্যাকুল হয়ে তার মানসীকে আহ্বান করেছেন। প্রিয়তমা যদি ওই বসন্তে ফিরে না আসে, কবির মন খারাপ হয়ে তিনি খুব কষ্ট পাবেন। অভিমানের সুরে এর প্রতিধ্বনি শোনা যায় তার পরবর্তী ‘পণ’ কবিতায়। কবি বলেছেন, যত খুশি কষ্ট তুমি দিতেই পার/ কষ্ট সে তো তোমার দেয়া আত্মঘাতী খেলা/বুঝবে সেদিন যখন পাবে আমার অবহেলা/’ স্মৃতি জীবনের ছায়াসঙ্গী। অভিমানের পাথর ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। নৈঃসঙ্গর বেদনায় কাতর কবি কণ্ঠে ধ্বনিত হয় ‘তুমি ছাড়া কে আছে আর আমার /স্মৃতি ফুলে গাঁথাছি মালা আবার/’ওই একই কবিতার শেষ দু’লাইনে মিথের ব্যবহার করে হৃদয়ের আর্তি তুলে ধরেছেন-‘রাই-বিহনে বৃন্দাবনে কৃষ্ণকালা/ হারা জেতার মরণখেলা এই অবেলা/’ (মরণ খেলা এই অবেলা)। যে যায় সে দীর্ঘ যায়। সহজে ফেরে না। সহজে তার অভিমানও ভাঙে না। বিরহ বেদনায় ব্যাকুল চিত্ত ক্ষত-বিক্ষত হয়। একদিন যে বিনয়ী প্রণত ছিল, সে কীভাবে আজ ভুলে আছে। অতীতকে মনে করে বিষাদে ভরে যায় তার মন। সেই বেদনা বিধূর আক্ষেপের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় তাঁর ‘আমাকেই দাও’ কবিতায়- ‘এতোটা অবজ্ঞা আর অবহেলা করা কি তোমার সাঝে/তার চেয়ে ভালো নির্বাসন দাও কষ্টের কারুকাজে/একদা প্রণাম করেছো যাহারে ঘৃণা কেনো তারে দাও/ হৃদয়ে আগুন- জ্বেলে লেলিহান শিখা দেখতে কি পাও?/’ কবিতাটির শেষ দু’লাইনে বেদনাভরা আগুনের ফোঁটা ঝরে পড়েছে ‘সবটুকু দাও, দাও ঘৃণা ভরে/ দোহাই তোমার/অন্ধবধির আমাকেই দাও দুঃখের পাহাড়/’। এক পর্যায়ে সর্বনামে কবিকণ্ঠে ধ্বনিত হয়-‘সেকি জানিত না কতটা আঘাত পেলে/প্রেমিক পুরুষ জ্বলে বিরহ অনলে/’। সময় মানে না কোনো মানা। কালের আবৃত কলসের ঢাকনা খুলে আবারও বসন্ত ফিরে এসেছে। এবেলা জীবনের অনেক বেলা বেড়ে গেছে। দূরতমা, অধরা মানসী আজও জীবনের ছায়াসঙ্গী হলো না। শুধু ভালোবাসার স্মৃতিসঙ্গী হয়েই রইলো। ‘এ বসন্ত’ কবিতায় সন্নিবেশিত হয়েছে রিক্ত হৃদয়ের গহীন বিষাদ। অশ্রুসজল চোখে কবি প্রশ্ন করেছেন-‘বসন্তরে চিনিস নাকি নীল বেদনা?/ বসন্তরে কেমন করে বলব তরে/ শেষ বিকেলে আগুন জ্বলে মনের ঘরে/তবুও তুই শুনতে চাস শেষ কথাটি?/এ বসন্তে গুঁড়িয়ে গেছে বসতবাটি/’ আমরা জানি কালবৈশাখীর কাপালিক ঝড়ে-তা-বে ঘরবাড়ি ভেঙে যায়। বিনাশ হয় সব সঞ্চিত আয়োজন। অথবা প্রকৃতি বিরূপ হলে প্রবল বন্যায় ভেসে যায় সব কিছু। কবির সর্বনাশ হয়েছে কালবৈশাখী ঝড়ে নয়, বসন্ত বাতাসে। চারদিকে যখন ফুলের সমরোহ ম ম গন্ধে মুখরিত। পাতার আড়ালে বসে কোকিল ডাকছে। তখন প্রিয়তমার সান্নিধ্যের জন্য হু হু করে উঠেছে কবি মন। কিন্তু সে নেই। সে হাসে দূরে ফুল পাতার আড়ালে। কিন্তু না। দীর্ঘ রাত্রি শেষে ভোর আসে। আঁধার শেষে আলোয় আলোয় ভরে যায় দশদিগন্ত। কবি ফের আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠেন। কবি কণ্ঠে ধ্বনিত হয়, উজ্জ্বল সাহসী উচ্চারণ ‘আমাকে দুঃখ দেবে কতোটা সাধ্য তোমার/প্রিয় মৃত্তিকা শিখিয়েছে সর্বংসহা হতে/’ আগুনে পোড়ালে খাঁটি হয় সোনা/ তবুও আমাকে দুঃখের ভয় দেখাবে?/ (দুঃখ কাকে বলে)। পথে দেখা প্রিয় সাথী। কতো স্বপ্ন- জড়ানো, মধুর স্মৃতি রাঙানো সময় আজ পেছন থেকে ডেকে ওঠে। তারই অসাধারণ ছবি চিত্রিত হয়েছে- ‘আমি যে তোর খেলার সাথী’ এই অসামান্য কবিতায়। এ কবিতার বিষয়-কাহিনী একা জাফরুলের নয়। সকল মানব মনের। সকল হৃদয়ের সজল প্রতিধ্বনি। জাফরুল কি বলছেন শুনি-‘যাচ্ছো কোথায়, তাড়া কিসের একটু থামো সই/ তোমার সঙ্গে এই অবেলায় মনের কথা কই/ ভুলেই গেছো ছেলেবেলার সিঁড়ি ভাঙার মই/ আমি যে তোর খেলার সাথী ভিন্ন কিছু নই/....তোমার আমার মধুর স্মৃতি পেছন থেকে ডাকে/ ছাউনি ঢাকা দু’চোখ আমার জলের ছবি আঁকে/’ মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চেতনার অগ্নিশিখা। দীর্ঘ অন্ধকারে মহাসড়কের আলো। ভাষা আমাদের প্রাণের স্বপ্নধ্বনি। জাফরুল আহসানের অজস্র কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে ভাষার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা। যেমন তাঁর ‘একা’ কবিতায় এভাবেই তার প্রকাশ দেখি ‘আমার আছে আগুন মাখা ফাগুন রাঙা ভোর/ গহীন রাতে পাখির স্বরে কাব্য করার ঘোর/’ মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিযোদ্ধার কথাও বিধৃত হয়েছে অসংখ্য কবিতায়Ñ ‘যুদ্ধজয়ী হে মুক্তিসেনানী তোমাকে সালাম জনমভর/জীবনের দামে কেনা স্বাধীনতা তোমরা জাতির কণ্ঠস্বর/’ (যুদ্ধজয়ী হে মুক্তিসেনানী)। জাফরুল আহসান সত্তর দশকের অন্যতম বিশিষ্ট কবি। তাঁর কবিতায় দুর্বোধ্যতার দুরূহ-জটিল কুয়াশা নেই। বিষয়ানুসারে ভাষা ও শব্দের ব্যবহারে দক্ষ কুশলী শিল্পী। সব রকম ছন্দ নির্মাণে দক্ষ তিনি। উপমা-উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্প তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। প্রতিটি কবিতায় রয়েছে মেলবন্ধন, অসাধারণ গল্প। তাঁর এই ‘আমি যে তোর খেলার সাথী’ গ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই সুখপাঠ। এই গ্রন্থ পাঠে পাঠকও শ্রোতা খুঁজে পাবেন নির্মল আনন্দ। গত ২০১৬ একুশের বই মেলায় গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ‘বিশ্ব সাহিত্য ভবন’ থেকে। মূল্য মাত্র ১০০/- টাকা। নাসিম আহমেদের নান্দনিক প্রচ্ছদে গ্রন্থটির সৌকর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি কবি জাফরুল আহসানের ‘আমি যে তোর খেলার সাথী’ কাব্য গ্রন্থের বহুল প্রচার কামনা করি।
×