ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিয়ামত হোসেন

মজার মানুষ রবীন্দ্রনাথ

প্রকাশিত: ০৭:০০, ৫ মে ২০১৭

মজার মানুষ রবীন্দ্রনাথ

চেহারা এবং বাংলা ভাষায় গাম্ভীর্যের ভাব থাকলেও কবি রবীন্দ্রনাথ ভেতরে ভেতরে ছিলেন একজন প্রচ- রসিক ধরনের লোক। তা তাঁর জীবনের বহু ঘটনা থেকে বোঝা যায়। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে থেকেই তিনি খ্যাতিমান ব্যক্তি। কিন্তু নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর খ্যাতি বিশেষভাবে ছড়িয়ে পড়ে। নোবেল পুরস্কার তিনি যে পেয়েছেন, সে খবর তিনি যখন শুনলেন, তখনও একটা মজার ঘটনা ঘটে। সেদিন ভোরে প্রত্যেক দিনের মতো কবি বেরিয়েছেন প্রাতঃভ্রমণ। খুব ভোরে বেরুতেন, কিছুক্ষণ ধরে মর্নিং ওয়াক করে চলে আসতেন। সেদিন একটু তাড়াতাড়িই যেন ফিরলেন। ঠিক সে সময়ই দেখা গেল দূর থেকে একজন হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে। তিনি ওখানকার অধ্যাপক ক্ষিতি মোহন সেন। লম্বা চওড়া মানুষ, সাদা পাঞ্জাবি, সাদা চাদর তাঁর গায়ে। ঠিক এই ঘটনায় প্রকাশিত এক লেখায় বলা হয়েছে, তিনি যেভাবে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসছেন, তাতে দূর থেকে মনে হতে পারে সাদা পাল তোলা একটি নৌকা যেন এগিয়ে আসছে তার দিকে। ক্ষিতি মোহন সকালে ঘুম থেকে উঠেই নোবেল পুরস্কারের খবরটা শুনেছেন। গত রাতে কারা যেন কলকাতা থেকে এসেছে। তাদের কাছ থেকে খবরটা একান-ওকান হয়ে পৌঁছে গেছে ক্ষিতি মোহন সেনের কানে। তিনি খবরটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে খুঁজতে শুরু করলে কোথাও তাঁকে না পেয়ে যখন শুনলেন কবি ওই দিকে গেছেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি এগিয়ে গেলেন সেদিকে। কবিকে পেয়ে তিনি খুবই খুশি। হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি বললেন; শুনেছেন, শুনেছেন খবরটা! রবীন্দ্রনাথ তখন মুচকি মুচকি হাসছেন। বললেন, ক্ষিতি যখন টলেছে, তখন কিছু একটা যে ঘটছে তা বুঝতেই পারছি। বলেই হাসলেন এবং আগে থেকে ওখানে থাকা লোকদের বললেন, টাকার জন্য নর্দমাটা সারা হচ্ছিল না এবং এটা সারার ব্যবস্থা হলো। আসলে পুরো ঘটনাটি হচ্ছে : ক্ষিতি মোহন বাবু খবরটা শুনেছেন পরে, অর্থাৎ সকালে। ওদিকে রবীন্দ্রনাথকে বলছেন আগের রাতে। কলকাতা থেকে রাতেই কয়েকজন এসেছে সংবাদটি কাউকে জানানোর জন্য। কলকাতা থেকে যে দল গিয়েছিল তাঁদের মধ্যে ছিলেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তও। রবীন্দ্রনাথ যেহেতু শুনেছেন, তাই সকালে ক্ষিতি মোহন বাবুর ওভাবে এগিয়ে আসার ঘটনায় রগড় করে বললেন : ক্ষিতি যখন টলেছে তখন কিছু যে একটা ঘটেছে, বুঝতেই পারছি। অর্থাৎ পৃথিবী টলে উঠলে সেটাতে বোঝা যায় কিছু একটা কা- ঘটেছে। উল্লেখ্য, ক্ষিতি মোহন থাকতেন শান্তি নিকেতনই। তিনি প-িত মানুষ। তাঁর অমন দ্রুত হাঁটা দেখে এ রসিকতা। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের নানা হচ্ছেন প-িত ক্ষিতি মোহন সেন শাস্ত্রী। কবি সত্যেন দত্তের ব্যাপারেও রয়েছে এক মজার ঘটনা। রবীন্দ্রনাথ তখনও সত্যেন দত্তকে দেখেননি। সে সময় কলকাতায় এক ঘরোয়া আড্ডা। দোতলা এক বাড়িতে অনুষ্ঠান। অনেক কবি-সাহিত্যিক গেছেন। রবীন্দ্রনাথও গেছেন। সেখানে সাহিত্য পাঠ হবে। আলোচনা হবে। গান-বাজনাও হবে। যে সময়ে সভা শুরু হওয়ার কথা, সে সময়টা হয়ে আসছে। কিন্তু তখনও কারও কারও আসার বাকি। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, মোটামুটি সবাই এসেছেন। একজন ছাড়া। তিনি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। এর কিছুক্ষণ পরই দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে শোনা গেল পায়ের আওয়াজ। কে যেন আসছে আর আসতে আসতে গলা খাঁকারি দিয়ে খুক্ খুক্ কাশি দু’একবার। এক উৎসাহী রবীন্দ্রনাথের দিকে একটু এগিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি সত্যেন্দ্রনাথকে আগে দেখেছেন কি? রবীন্দ্রনাথ দেখলেন কাছেই একটা হারমোনিয়াম। তিনি সেটা টেনে নিয়ে গান ধরলেন : ‘এখনও তারে চোখে দেখিনি/ শুধু বাঁশি শুনেছি...’ রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা একটি গান হচ্ছে : ‘এখনও তারে চোখে দেখিনি/ শুধু বাঁশি শুনেছি। শুনেছি তার বরণ কালো/ তারে দেখিতে ভালো’... ইত্যাদি। কবি সঙ্গে সঙ্গে নিজের গানের নিজেই প্যারোডি বানিয়ে সত্যেন দত্তের উদ্দেশে গাইলেন গানটি। একটু পর দেখা গেল, সভায় ঢুকলেন কবি সত্যেন দত্ত। কবির কাছে অনেক লোক আসত দেখা করার জন্য, আলোচনার জন্য। একদিন সকালে আগন্তুকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অনেক বেলা হয়ে গেছে। অতিথি যারা এসেছিলেন তারা বিদায় নিয়েছেন। কবি উঠতে যাবেন, এমন সময় একজন এসে জানালেন, এক ভদ্রলোক এসেছেন, খুব জরুরী কাজ। তাঁকে একটু সময় দিতে হবে। কবি বললেন, ঠিক আছে, জরুরী আলাপ যখন, তখন আসতে বলো। ভদ্রলোক এসে কুশল বিনিময়ের পর বসলেন। তার পর শুরু করলেন তাঁর কথা। তিনি এক বিশেষ ব্যক্তির কাজকর্ম নিয়ে বলতে শুরু করলেন নানা কথা। এ ব্যাপারে কবির মন্তব্য শুনতে চান। ভদ্রলোক বলেই চলেছেন, রবীন্দ্রনাথ নীরব শ্রোতা। ভদ্রলোক বলছেন ফ্রুড সাহেব সম্পর্কে। ফ্রুড সাহেব এই লিখেছেন, এই বলেছেন। এসব বলছেন আর ভদ্রলোক বলে চলেছেন নিজের মন্তব্য। রবীন্দ্রনাথের ক্ষিদে পেয়েছে, বেলাও হয়ে গেছে। কিছু বলছেন না। চুপচাপ বসে বসে শুনছেন তাঁর কথা। ফ্রুড সাহেব সম্পর্কে তো ভদ্রলোক একগাদা কথা বলে গেলেন। তাই ভদ্রলোক সন্তুষ্ট। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ একটি কথাও বললেন না, তাই কী করবেন আর। নিজের বক্তব্য শুনিয়ে কবির হ্যাঁ, হুঁ ইত্যাদি শুনে বিদায় নিলেন। ভদ্রলোকটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে উচ্চৈঃশব্দে হেসে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর উঠলেন। আশপাশে যারা ছিল তারা এগিয়ে এসে হাসির কারণ জিজ্ঞেস করল, অমনভাবে হেসে উঠলেন কেন? রবীন্দ্রনাথ বললেন, দ্যাখো, ভদ্রলোক যার বিষয় নিয়ে গম্ভীর আলোচনা শুরু করেছিলেন, তার নামই তিনি ঠিকমতো জানেন না। তিনি এসেছিলেন ফ্রয়েড নিয়ে আলোচনা করতে। কিন্তু সারাক্ষণ তাঁর নাম বলে গেলেন ফ্রুড বলে। তিনি জানেনই না, তাঁর নাম ফ্রয়েড। উল্লেখ্য, এই সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখাও হয়েছে, আলাপও হয়েছে। ফ্রয়েড সম্পর্কে তিনি তাই ভালভাবেই জানতেন। ঠিক এ ধরনেরই একটা ঘটনা। কবি আগত লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। এই করতে করতে সেদিনও অনেকখানি বেলা হয়ে গেছে। গোসল এবং খাওয়ার জন্য উঠি উঠি করছেন কবি। এমন সময় তাঁর এক কর্মচারী জানান, আর একজন লোক বাকি আছে। সে আসতে চায় কিছু বলতে। সে নাকি আগে এসে ঘুরে গেছে, দেখা পায়নি। সামান্য কথা। বেশি সময় নেবে না। ইত্যাদি। কবি বললেন, ঠিক আছে, আসতে বলো। এর পর আগন্তুকের প্রবেশ। একটি আসনে উপবেশন। তার পর এদিক ওদিক তাকিয়ে তিনি তাঁর ঝোলা থেকে বের করলেন কটি খাতা। রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন লোকটি তাঁকে কবিতা শোনাবে। তিনি চুপচাপ বসে রইলেন। লোকটি খাতা খুলে শুরু করল কবিতা পাঠ। শুরু হলো এভাবে : ‘জগৎ- সংসারে খ্যাতা/ রাজধানী কলিকাতা।’ রবীন্দ্রনাথ তার এক চিঠিতে এই কবিতা শোনার অভিজ্ঞতাটি লিখেছেন। যাই হোক, রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন, এটাও কবি প্রশস্তি অর্থাৎ রবীন্দ্র প্রশস্তি। ভদ্রলোক ‘জগৎ-সংসারে খ্যাতা/ রাজধানী কলিকাতা’ বলে শুরু করলেন। কলকাতার প্রশস্তি, তারপর সেখানকার জোড়াসাঁকো নামে এক এলাকার প্রশস্তি। এরপর সেখানে এক বাড়ির কথা, বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রনাথের দাদা, তার কথা, এর পর তার বাবার কথা, তারও পরে অর্থাৎ সর্বশেষে এলো আসল কথাÑ রবীন্দ্রনাথের কথা ইত্যাদি। বেলা বেড়ে গেছে, পার হয়ে গেছে গোসলের সময়, খাবার সময়ও হয়ে গেছে। এতসব ঝামেলার মধ্যেও আগন্তুক কবিকে হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন যেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানান সংস্কারের জন্য একটা কমিটি গঠন করে দিলে সেই কমিটি বাংলা বানানের পুরনো রীতি পাল্টে নতুন বানানরীতি চালু করে। এই কমিটি এই কাজ করতে গিয়ে ‘গরু’ বানান নিয়ে সমস্যায় পড়ে। কমিটি ঠিক করে যে ‘গরু’ বানানটি গরু না লিখে ‘গোরু’ লেখা উচিত। কারণ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃতের ‘গো’ শব্দ থেকে। আদিতে ‘ও’ কার, সেজন্য এখানেও ‘ও’ কার থাকা উচিত। কিন্তু সমস্যা হয়েছে, প্রায় সব বাংলাভাষী লেখক, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক সবাই ‘ও’ কার ছাড়া গরু বানান লেখেন। কিন্তু কী করা যায়! কমিটির সিদ্ধান্ত হলো, রবীন্দ্রনাথের মত এক্ষেত্রে নেয়া দরকার। দেখা যাক, উনি কী বলেন। কমিটির প্রধান ছিলেন ভাষাবিদ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। ওঁর নেতৃত্বে কমিটির লোকজন চলল শান্তিনিকেতনে। সেখানে গিয়ে তাঁরা সাক্ষাত প্রার্থী হলেন কবির। কবি সাক্ষাত দিলেন এবং তাদের আগমনের হেতু জানতে চাইলে তাঁকে বিষয়টি বোঝানো হলো এবং বলা হলো, আপনার মত আমরা জানতে এসেছি। রবীন্দ্রনাথ কথাটা শুনে মৃদু হেসে বললেন, তা তোমাদের ‘ও’ কার দিয়ে গরু লেখার ব্যাপারে অন্তত একটা সুবিধাই হবে যে, আমাদের দেশের জীর্ণকায় হাড় জিরজিরে গরুগুলোকে অন্তত একটু মোটা ও তাজা দেখাবে! অন্তত এটা তো হবে। একবার এক ভদ্রলোক খানিকটা সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলেন একটি কলমের জন্য। সম্ভবত নিজের কলম না থাকায় এর কাছে ওর কাছে কলম চেয়ে কারও কাছ থেকে কলম না পেয়ে কাছেই থাকা রবীন্দ্রনাথের কাছে কলম চাইলেন। ভদ্রলোকটি পড়েছেন আরেক সমস্যায়। একটি সংস্কৃত কবিতায় প্রথম লাইনটা তার মনে ছিল। দ্বিতীয় লাইনটা কিছুতেই তার মনে আসছিল না। তিনি কলম চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি দ্বিতীয় লাইনটা জানেন? প্রথম লাইনটা হচ্ছে ‘সকল পক্ষী মৎস্য ভক্ষী, মৎস্যরাঙ্গী কলঙ্কিনী’, এর পরের লাইনটা কি জানেন? ভদ্রলোক কলমও চেয়েছেন দ্বিতীয় লাইনটাও জানতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। রবীন্দ্রনাথ কলমটা দিয়ে বললেন দ্বিতীয় লাইনটা জানি। সেটা হচ্ছে ‘সবাই কলম ধার চেয়ে নেয়, আমিই শুধু কলম কিনি।’ তাহলে লাইন দুটো দাঁড়াল এই রকম : ‘সকল পক্ষী মৎস্য ভক্ষী, মৎস্যরাঙ্গী কলঙ্কিনী। সবাই কলম ধার চেয়ে নেয়, আমিই শুধু কলম কিনি।’
×