ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লাবণ্য ও অমিতের দুই পাখি -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ৫ মে ২০১৭

লাবণ্য ও অমিতের দুই পাখি -স্বদেশ রায়

কোন এক সকালে বা বিকেলে ঈশান কোণের একচিলতে মেঘ হঠাৎ আলুথালু করে দেয় প্রকৃতির বিস্তীর্ণ ভূমিকে। অনেক বড় গাছের যায় শিকড় উপড়ে আবার ওই ঝড়ের সঙ্গে আসা বৃষ্টির পানিতে ওম পেয়ে গর্বিত ভঙ্গীতে মাটির ওপর উঠে আসে বীজপত্র। শেষের কবিতায় শিলংয়ের পাহাড়ী রাস্তায় অমিতের গাড়ির সঙ্গে যখন লাবণ্যর গাড়ির ধাক্কা লাগে তাকেও ঠিক ধরে নেয়া যায় প্রকৃতির এই হঠাৎ মেঘের ঘটনা। এখানে কোথায় যেন বড় একটি গাছের শেকড় গেল উপড়ে আবার মাথা উঁচু করে গর্বিত ভঙ্গীতে এলো দুটি বীজপত্র নতুন সূর্যালোকে। যদি মন ও চিন্তাকে শুধু শেষের কবিতার পাতার ভেতর আটকে রাখি, তাহলে হয়ত বলতে পারি, এ ছিল কোন একদিনের ঘটনা। যে ঘটনা দিয়ে শুরু হয়েছিল দুজন নর-নারীর বদলে যাওয়া। কিন্তু মনটাকে একটুখানি উদাস করে শেষের কবিতার পাতা থেকে বাইরে নিয়ে এলে, প্রকৃতির অযুত-নিযুত বছরের সূর্যালোকের সঙ্গে মেলালে ঠিকই দেখা যায়, ওই দুই জন আসলে অযুত-নিযুত বছরে অগণিত নর-নারীর বদলে যাবার ক্ষণের একটি উদাহরণ মাত্র। এমনকি যে আমি বা আমরা চারপাশে নানানভাবে বর্তমানের পৃথিবীতে আছি, তারাও কি কোন এক মুহূর্তে কখনও অমন বদলে যাইনি! কেউ হয়ত বলতে পারেন, সবাই বদলে যায় না; অগণিত অমিত ও লাবণ্য হলে- লাবণ্য ও অমিত সাধারণ হয়ে যায়। পৃথিবীটা যেমন শুধু সাধারণের নয় তেমনি সকল খাপছাড়ারও নয়। সাধারণ আর খাপছাড়া মিলেই বৃন্ত আর ফুল। সাধারণের বৃন্তে কখনও খাপছাড়ার ফুল ফোটে আবার কখনওবা উল্টোটাও ঘটে। অমিত ও লাবণ্য দুজনেই তাদের বদলে যাওয়া দিনের প্রথম থেকে শেষ অবধি সকালের ও সন্ধ্যার অনেক কূজন শোনায় দুজন দুজনকে। তাদের দুজনের কূজনের সুর মন পেতে শুনলে বোঝা যায়, তারা যে বাসর তৈরি করতে যাচ্ছে, তারা যে সংসার পাততে যাচ্ছে তা বাস্তবতার মাটির থেকে কল্পনার আকাশেই বেশি। দুজনের ভালবাসায় দুজন সব সময়ই একটি নতুন রং সৃষ্টি করতে ব্যস্ত, উদ্দেশ্যটা এমন - এই রং পৃথিবীতে যেন নতুন হয়, আগে কোনদিন, কোন ঊষালোকে বা কোন সূর্যাস্তে যে রং সৃষ্টি হয়েছিল তার সঙ্গে যেন কোন মিল না থাকে এর। দুজনের এ উদ্দেশ্যটা একেবারে ফেলনা নয়, এমনি করেই তো পৃথিবীতে বার বার নতুনের জন্ম দিতে হয়, ফাল্গুনে আসা গাছের নতুন পাতার একঝিলিক নতুন রঙের মতো -যা পাতাটা একটু বিকশিত হতেই মিলিয়ে যায়। লাবণ্য এবং অমিত যখন পৃথিবীতে এই সুর ও রঙের খেলা খেলছে তখন তাদের ধারণ করে আছেন যোগমায়া। যোগমায়া মা বসুন্ধরা। তিনি সর্বংসহা। তার ওপরই প্রকৃতির যত সন্তানের খেলা। তার ওপরই সূর্যালোক, তার ওপরই পাখির কূজন। যোগমায়া তো চির সত্য। পৃথিবীকে নিয়েই সব। আবার সব পাখিই কূজন করে। তাহলে অমিত, লাবণ্য আর যোগমায়া কি কোনরূপ আলাদা হতে পারে! মানুষ যখন প্রকৃতির মতো আপন খেয়ালে আলাদা হয়, পৃথিবীও তখন আলাদা রূপ নেয়। লাবণ্য ও অমিতের পরিবর্তনে যোগমায়ার রংও যায় বদলে। অমিতের সঙ্গে লাবণ্যর দেখা হবার আগে অমিতের জীবনে কেতকী ছিল। যে পৃথিবীর বাস্তবতার ঘষামাজাতে ‘কেটি’ হয়েছিল। লাবণ্যর জীবনেও ছিল শোভনলাল। যে নিচু মাথায় আরক্ত মুখে ভালবেসেছিল । অথচ শিলং পাহাড়ে দুই নর-নারীর চোখাচখি হতেই কেতকী এবং শোভনলাল মুহূর্তে গেলো ভেসে। কিন্তু লাবণ্য আরেকজন কেতকী হলো না অমিতও হলো না আরেক শোভন লাল। সাধারণ লেখকের কোন উপন্যাস হলে চতুর্ভুজ প্রেমের একটা চমৎকার ফ্রেম তৈরি হতে পারত এখানে। তার বদলে শেষের কবিতায় দেখা গেলো প্রেমটা কোনমতেই চতুর্ভুজ কোন ফ্রেমে গেলো না। বরং লাবণ্য আর অমিতের যে প্রেম তা যে সাধারণের কাছে শুধু অচেনা তাও নয়, লাবণ্য ও অমিত দু’জনেরই ধরাছোঁয়ার মধ্যে নয়ও সে প্রেম। তারা প্রতিদিন নতুন নতুন প্রেমের সৌধ সৃষ্টি করছে কিন্তু ধরতে পারছে না কেউই; এমনকি তারা যেন ধরতে চায় না। আর এখানেই রবীন্দ্রনাথ, এখানেই তাঁর শেষের কবিতা। এ কেমন প্রেমের কূজন যা সাধারণ প্রেমিক ও প্রেমিকা চেনে না। চেনে না তাদের আপন স্রষ্টারা। তারপরও স্রষ্টারা সৃষ্টি করে যাচ্ছে, গানের পাখির গানের মতোই। তাই তো শেষের কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ কি আমাদের উপনিষ্দ পড়াচ্ছেন না নতুন প্রজন্মের জন্যে শেষের কবিতা নাম দিয়ে তিনি নতুন করে উপন্যাসের আড়ালে উপনিষ্দ লিখছেন। মু-কোপনিষদের একটি কবিতায় বলা হচ্ছে, দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে। তয়োরণ্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত্য- নশ্নন্নন্যে অভিচাকশীত॥ ( এক দেহে এক নামে মিলিত দুই পাখি, এক গাছে থাকে, এক পাখি সব ফল খায়- তাই যে স্বাদই হোক। আরেক করে না কোন ভোগ কেবলই দেখে গীতিময় চারিপাশ। - লেখক অনূদিত) এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষই আসলে এই দুই পাখির মিলন। মানুষের মনের ভেতরের এই দুই পাখিই মানুষকে নিয়ে জগৎসংসারে খেলা করে। বান্তবতা, দুই পাখির একটি পাখি জৈবিক তাড়নায় সবার জীবনে জেগে থাকে। আরেকটি পাখি কখনও কখনও কারো কারো জীবনে জেগে ওঠে হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে। এই যে জৈবিক তাড়না ছাড়াও যে পাখিটি জেগে উঠছে যার বেঁচে থাকার জন্যে কোন ফল খাবার প্রয়োজন পড়ে না, পৃথিবীর চারপাশের রূপ, রস, গন্ধ দেখে ও উপলব্ধি করে যে শুধু নিজেকে সুন্দর করে না; পৃথিবীকে, মানুষকে, সভ্যতাকে দেয় নতুন আলো, যে আলোয় থাকে পথ চলার ডাক। তার ডাকেই পৃথিবী চলে। সভ্যতা হয় নান্দনিক। শেষের কবিতায়, অমিত ও লাবণ্যর ভেতর এই পৃথিবীর সুন্দর চারপাশ দেখার পাখিটি জেগে উঠেছিল শিলং পাহাড়ে। শুধু যে জেগে উঠেছিল তাই নয়, অমিত ও লাবণ্য সেই দুই নর-নারী যারা এই দুই পাখিকে সমানভাবে নিজের জীবনে জাগিয়ে রাখতে পারে। তাই তো যখনই শিলং পাহাড়ে অমিতের গাড়ির ধাক্কা গিয়ে লাগল লাবণ্যর গাড়িতে- যার ফলে চারটি চোখ হলো এক, ওই চোখের দৃষ্টির আলোকে উভয়ের ভেতর জেগে উঠল ভোগ না করা ওই পাখিটি। যে ভোগ করে না, সৃষ্টি তো তারই সাজে। ভোগের সৃষ্টি তো নিত্যদিনের সামগ্রী আর ভোগ না করা যে সৃষ্টি সে তো মেঘের পাহাড়ের কোলে ভেসে বেড়ানো এক সংসার। যেখানে কথা আছে, গান আছে- সুর আছে মিলন ও বিরহ আছে; নেই কেবল কামনা ও বাসনার উগ্র সেই দেহ। এ কারণেই শিলংয়ে সেই গাড়িতে ধাক্কা খাবার দিন থেকে লাবণ্যর চলে যাবার দিন অবধি অমিত ও লাবণ্যর ফলাহার না করা ওই পাখির, কত না কূজন! আর এই পাখি যে অমিততেজী, সে যে সাধারণ নয় তাও ধরা দেয়, কেটিকে (কেতকী) প্রতিদিন ঘষে ঘষে এনামেল তুলে যখন সাধারণ একটি সংসার পাতার, অর্থাৎ যেখানে নিত্যদিনের ফল খাওয়া, যেখানে পাখির জৈবিক সব কিছু সেই চেষ্টায় ব্যস্ত অমিত - সে সময়ে যতিকে অমিত বলে,“দেখ ভাই, সব কথা সকলের নয়। আমি যা বলছি হয়ত সেটা আমারই কথা। সেটাকে তোমার কথা বলে বুঝতে গেলে ভুল বুঝবে, ...।” এটাই কিন্তু সত্য, আর এ সত্য উপন্যাসে নিয়ে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ উপনিষ্দ থেকে। কারণ, অমিতের ওই কথা তো গানের পাখির কথা। আবার অমিতের ভেতর সাধারণ পাখিও আছে। যা অমিত সরাসরি যতিকে বলছে, “কেতকীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ভালবাসারই,কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল- প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যর সঙ্গে ভালবাসা সে রইল দিঘি, সে ঘরে আনবার নয়। আমার মন তাতে সাঁতার দেবে।” যতি এখানে পাল্টা প্রশ্ন করে, “...অমিতদা দুটোর মধ্যে একটাকে কি বেছে নিতে হয় না।” অমিত উত্তর দেয় , “যার হয় তারই হয়, আমার হয় না।” রবীন্দ্রনাথ এখানে মানুষের জীবনের ভেতর এক সঙ্গে বাস করা কেতকী ও লাবণ্যকে সহজ উদাহরণের ভেতর দিয়ে শুধু দেখিয়ে দিয়ে যাননি, উপনিষ্দকে অনেকেই যে ঈশ্বর ও মানবাত্মার সম্পর্কের ব্যাখ্যার বেড়াজালে বেঁধে ফেলে সাহিত্য থেকে অনেক দূরে নিয়ে গেছেন- সেখান থেকে আবার নতুন করে মানুষের জীবনের নিত্যাচার ও বোধের পৃথিবীতে নিয়ে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষের কবিতায়। তাই তাকে কি কৌশলী বলব, না বলব, নতুন করে আধুনিক উপনিষ্দ লিখলেন রবীন্দ্রনাথ শেষের কবিতা নাম দিয়ে। দেখিয়ে দিলেন, আসলে সেই পরম সুন্দর ঈশ্বর নামে যাকে আমরা ডাকি, সে বাস্তবে নর-নারীর ভালবাসা। যে ভালবাসায় স্বর্গীয় সুখ সৃষ্টি করে, সৃষ্টি করে চারপাশে স্বর্গ ও দেবতার মতো মানুষ। তবে তার পরও বাস্তব সত্য, এই স্বর্গ কখনই ভোগের নয়, এ স্বর্গ লাবণ্যর মতো দিঘি, সেখানে মন দিয়ে সাঁতার কাটা যায়, মন দিয়ে শোনা যায় দিঘির জলের জলতরঙ্গ। আর মানুষের সাধারণ জীবন! ঘড়ায় তোলা জল। যে জলে জলতরঙ্গ বাজে না। আবার যোগমায়ার পৃথিবীতেই কেবল বাস করে লাবণ্য আর অমিত। সাধারণ পৃথিবী! সিসি, কেটি, নরেন ও যতিদের।
×