ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাইসুল সৌরভ

মন ভোলানো আকসারধাম

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ৫ মে ২০১৭

মন ভোলানো আকসারধাম

দীর্ঘ ভ্রমণ ক্লান্তির পর গুজরাট ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনের শুরুটা আমাদের দলের সবাই বেশ উচ্ছ্বাস নিয়ে রাজ্যের রাজধানী আহমেদাবাদ শহর দর্শন দিয়ে শুরু করেছিল। গোয়া থেকে বাসে করে আহমেদাবাদে পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় দেড় দিন বা ৩৬ ঘণ্টার মতো! দীর্ঘ ভ্রমণ বেশ বিরক্তিকর। মুম্বাই থেকে ট্রেনের টিকেট না পেয়ে গোয়ার উদ্দেশে বাসে করে প্রথম আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। শুরুতে দলের সকলেই প্রথমবারে মতো বাসে শোয়ার ব্যবস্থা দেখে উৎফুল্ল হলেও রাত ও পথ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই তা জীবনের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়। মূলত বাস যখন আঁকাবাঁকা পথে মোড় ঘুরতে থাকে তখন বাসের সঙ্গে সঙ্গে আপন শরীরও অবলীলায় এক কাত থেকে অপর কাত হতে থাকে। ঘুম বাদ দিয়ে বাসের জানালার সঙ্গে সাঁটা লোহার হাতল আঁকড়ে নিজেকে সামলে রাখা মুখ্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। আর একটু পর পরই মনে হতে থাকে এই বুঝি বাস আবার বাঁক নিয়ে গোটা শরীর দুলিয়ে দিয়ে যাবে। কনো রকম রাত পেরিয়ে ভোরের যাত্রা বিরতিতে যখন আমরা একে-অপরের দেখতে পাই, ততক্ষণে রাতভর দোলাদুলির চোটে মগজ ঘুরিয়ে বমি বমি ভাব নিয়ে গোয়ার সমুদ্র-সেকতে দাপানোর শখ দলের সবারই উরে গেছে। গোয়া থেকে ফের ট্রেনের টিকেট কাটতে গিয়ে রিক্ত হাতে ফিরে আবারও বাসে ভরসা রাখতে হলো। যাই হোক, আগের দিন ঠিক করে রাখা ড্রাইভার কাম গাইড আহমেদাবাদ শহর ঘোরাতে, ঘুম না ভাঙতেই হাজির। ড্রাইভার আমাদের আশ্রম রোডের হোটেল থেকে তুলে নিয়ে শহর পেরিয়ে গন্তব্যে চলতে শুরু করল। আহমেদাবাদ ভারতের আর পাঁচটা বড় শহরের মতোই উন্নত । তার ওপর প্রধানমন্ত্রীর নিজের শহর বলে কথা। প্রশস্ত রাস্তার ঠিক মাঝখান দিয়ে নিরবচ্ছিন বাস চলার ও যাত্রী ওঠা-নামার আলাদা ব্যবস্থা দেখে আমাদের হা-হুতাশও বাড়তে লাগল। ইশ! আমাদের প্রধান শহরেও যদি অন্তত এমন ব্যবস্থা থাকত। ভ্রমণের শুরু ইস্কন মন্দির দর্শন দিয়ে। তারপর থেকে একের পর এক মন্দির দেখতে দেখতে যখন হাঁপিয়ে উঠেছি তখন আমাদেরই একদল ভ্রমণসঙ্গী পরবর্তী গন্তব্যে যাওয়া ইস্তফা দিয়ে শহরের লাল দরজা বাজার পানে ছুটল সস্তায় নিজেদের কেনাকাটা সারতে। এদিকে আমরা আরেক দল, যারা তখনও ভ্রমণের নেশায় বুঁদ; উপরন্তু যাদের কেনাকাটায় খুব বেশি তাড়া নেই তারা আঠার মতো লেগে রইলাম আমাদের সেই গাইড কাম ড্রাইভারের সঙ্গে সমগ্র আহমেদাবাদের দর্শনীয় স্থানসমূহ ঘুরে দেখতে। ড্রাইভাররূপী গাইড যখন কিলোমিটার হিসেব করে দূরত্বসহ দিনের পরবর্তী গন্তব্যের নাম আকসারধাম জানাল, তখন আমরা অবশিষ্ট সবাই মোটামুটি নির্বিকার। কারণ আকসারধাম কী ধরনের দর্শনীয় বস্তু সে সম্পর্কে সবাই-ই ব-কলম! আকসারধাম পৌঁছে প্রবেশদ্বারের এক কোণে দর্শনার্থীদের জটলা দেখে টিকেট কাটার লাইন ঠাওরে প্রথমেই ভুল করে বসলাম। কাছে ভিড়তেই জানা গেল ভেতরে প্রবেশের পূর্বে মুঠোফোন, ক্যামেরাসহ সব ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস সেখানে জমা দিয়ে যেতে হবে। অগত্যা উপায়ন্ত না দেখে দলের সবাই মিলে পিপীলিকার সারির মতো দর্শনার্থীদের যে লাইন সে সব জমা নেয়ার কাউন্টারে গিয়ে ঠেকেছে সে লাইন অন্ধের মতো অনুসরণ করে মলিন বদনে কেউ কেউ কিছুটা হারাবার শঙ্কায় নিয়ে ফোন, ব্যাটারি, চার্জার, ক্যামেরা, ব্যাগÑ সবই জমা দিয়ে প্রবেশের পরবর্তী লাইন অনুসরণ করতে লাগলাম। তবে শঙ্কা কিছুটা কাটল জমাদানকারীদের প্রত্যেকের ছবি সিসিটিভি ক্যামেরায় তুলে রাখায় আর কম্পিউটারাইজড সিস্টেমে জিম্মা রাখায়। নিরাপত্তার বিরম্বনা এখানেই শেষ হলে ভাল ছিল; প্রবেশের ঠিক আগ মুহূর্তে ছেলেদের কোমর থেকে বন্ধনী (বেল্ট) হাতে স্থান করে নিল। এই সুযোগে কেউ কেউ ফোঁড়ন কেটে উঠল; ‘বাব্বা, ড্রাইভার ব্যাটা মনে হচ্ছে নিশ্চয় ফন্দি এঁটে ঘোরানোর পরিবর্তে আমাদের সাজা দিচ্ছে। নয়ত কী এমন আহামরি জিনিস দেখতে এলাম যে দফায় দফায় নিরাপত্তার জাল উৎরাতে হবে?’ নিরাপত্তাদ্বার মাড়িয়ে বেল্ট-টেল্টকে তার নির্ধারিত স্থানে আবার ঠাঁই করে দিয়ে অন্য সঙ্গীদের জন্য অপেক্ষার ফাঁকে যেই না একটু ছায়া খুঁজে নিয়ে জিড়িয়ে নিতে দাঁড়িয়েছি, ওমনি চোখের পলকে সব বিরক্তি কর্পূর যেমন সূর্যালোকের সংস্পর্শে নিমিষে উরে যায় ঠিক তেমনিভাবে আকসারধামের বাতাসে মিলিয়ে গেল। সবার একই উক্তি ভাগ্যিস অন্যদের পাল্লায় পড়ে শপিংয়ে গা ভাসায়নি; নইলে গুজরাট আসাই মাটি হতো। এবারের দীর্ঘ ভারত ভ্রমণে একমাত্র আকসারধামের মন ভরানো আবহচিত্তে নিরেট আনন্দ বয়ে এনেছে। আকসারধাম মূলত মন্দির হলেও সব ধর্মের মানুষই এর নির্মাণ শৈলীর সৌন্দর্যে অবগাহন করতে আসে। আকসারধাম নামে বহুল প্রচারিত হলেও এর কেতাবি নাম স্বামীনারায়ণ আকসারধাম; যেখানে মূলত স্বামীনারায়ণের জীবন ও শিক্ষা তুলে ধরা হয়েছে। ১৩ একর জায়গাজুড়ে অনিন্দ্য সুন্দর রূপে গড়ে তোলা পুরো কমপ্লেক্সের একেবারে মদ্দিখানে আকসারধাম মন্দির গড়তে তের বছর সময় লেগেছিল! মূল মন্দিরের কাজ ১৯৭৯ সালে শুরু হলেও পুরো কমপ্লেক্স চালু করতে ’৯২ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। নিরাপত্তা নিয়ে এত কড়াকড়ির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে অন্তর্জাল ঘেঁটে জানা গেল ২০০২ সালে এখানে একবার সন্ত্রাসী হামলায় ৩০ জন হত ও ৭০ জন মারাত্মক জঘম হয়েছিল। আকসারধামের প্রবেশ পথের দু’পাশে সবুজ কচি ঘাসের গালিচা বিছানো উদ্যান আর চমৎকার সজ্জায় লাগানো গাছ-গাছালি বিশেষত গাছ দিয়ে তৈরি হাতির অবয়ব আর মন্দিরে সদর দরজার ঠিক সামনে তাজমহলের আদলে তৈরি চৌবাচ্চার সঙ্গে পানির ফোয়ারাই বুঝি ক্লান্তি মিলিয়ে দিতে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। মন্দিরের চারপাশের পরিবেশের অমিত সৌন্দর্য আমাদেরকে আরও বেশি পোঁড়াচ্ছিল এই ভেবে যে; ক্যামেরা শূন্য আমরা না পারব কেনাকাটাকারীদের গান্ধীনগরের এই শ্রেষ্ঠ স্থানের ছবি দেখিয়ে অন্তর জ্বালিয়ে দিতে, না পারব একখানি স্থিরচিত্র তুলে ভীষণ সুন্দর এই সৌন্দর্যকে স্থায়ী করে রাখতে। ১০৮ ফুট উঁচু, ১৩১ ফুট চওড়া এবং ২৪০ ফুট দীর্ঘ এই মন্দির তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে ৬০০ টণ গোলাপি রাজস্থানি বেলেপাথর। ভেবে বিস্ময়ের ঘোর কাটে না যে এই মন্দির নির্মাণে কোন রড ব্যবহার করা হয়নি; পাঁচ টণ ওজনের ২০ ফুট দৈর্ঘের পাথুরে বিম ব্যবহার করা হয়েছে মন্দিরের ওজন ধরে রাখতে। মন্দিরের ঠিক মাঝে স্বামীনারায়ণের স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া সাত ফুটের একটি প্রতিবিম্ব রয়েছে; যেখানে ভক্তরা আসেন উপাসনা করতে। তিনতলা মন্দিরের উপরের তলায় স্বামীনারায়ণের জীবনীভিত্তিক চিত্র প্রদর্শনী আর নিচ তলায় স্বামীজির জীবনালেখ্য বিভিন্ন ভাস্কর্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। মন্দিরের চারপাশ ঘিরেও বেলেপাথরের আর মার্বেল পাথরের চমৎকার স্থাপত্যশৈলী নির্মাণ করা হয়েছে; যেখানে পাঁচটি প্রদর্শনী প্রেক্ষাগৃহ রয়েছে। প্রেক্ষাগৃহগুলিতে সনাতন ধর্মের বিবিধ দিক ও স্বামীনারায়ণের জীবন এবং দীক্ষা নিয়ে অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশন চাইলে টিকেট কেটে দেখে নেয়া যাবে। এ ছাড়াও মন্দির কমপ্লেক্সের অন্যতম আকর্ষণ সাত-চিত-আনান্দ ওয়াটার শো। যে শো-য়ে সঙ্গীত, অগ্নি, ফাউন্টেইন এ্যানিমেশন, লেজার, ওয়াটার স্ক্রিন প্রজেকশনের মিশেল দর্শকদের শুধু বিমোহিতই করে না, জলের অপূর্ব খেলায় উদ্বেলিতও করে সমান তালে। আকসারধামের আঙ্গিনাজুড়ে হিন্দুধর্মের বিভিন্ন ভাস্কর্য, ঝর্ণা, পাথুরে পথের ধারে বৃক্ষরাজি আর ফুলের বাগানের ছড়াছড়ি। যা সমগ্র আঙ্গিনার কেবল সৌকর্যই বৃদ্ধি করেনি; বরং চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে স্নিগ্ধ মোহময়তার এক মিহি আবেশ। যেখানে প্রকৃতি ও ধর্ম মিলেমিশে হয়েছে একাকার। যে পরিবেশ একদিকে যেমন ধরে রেখেছে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য অন্যদিকে আবার নিশ্চিত করেছে অনিন্দ্য সৌন্দর্য। এক কথায় আকসারধাম কেবল কোন প্রচলিত ধারার ধর্মালয় নয়, সৌন্দর্যেরও উপাসনালয় যেন। প্রকৃতির যে নিবিড়তা শুধু ধর্ম চর্চার মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি বয়ে আনে না, চিত্তের পরিতুষ্টিও বয়ে আনে অফুরান। ই-চিঠি : [email protected]
×