ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

২৫ বৈশাখ স্মরণে ॥ রবীন্দ্রনাথের ‘পলাতকা’ নারী নিপীড়নের চিত্র

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ৫ মে ২০১৭

২৫ বৈশাখ স্মরণে ॥ রবীন্দ্রনাথের ‘পলাতকা’ নারী নিপীড়নের চিত্র

১৯১৮ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘পলাতকা’ কাব্য। অবিভক্ত ভারতে তখন রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক উত্তেজক অধ্যায়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধ, মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা, স্বদেশী আন্দোলনের আত্মঘাতী, সম্পদ লুণ্ঠন এবং দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় সমকালীন অঙ্গন উত্তপ্ত, বিধ্বস্ত এবং সংঘাতময়। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু এবং পরিণতির প্রভাব তো আছেই। এসব মিলিয়ে কবি সৃষ্টিশীলতায় পড়ে বেদনার গাঢ়চিহ্ন, করুণ আর্তি যা তার শৈল্পিক চৈতন্যে ঐশ্বর্যময়। ‘পলাতকা’ সেই কষ্টকর অনুভূতির নির্মম যাতনা, এখানেও সেই যন্ত্রণার মূল বলি অবহেলিত, অসহায়, দুর্বল নারী সমাজ। মেয়ে হওয়ার অপরাধ থেকে শুরু করে বাল্যবিয়ের মতো অপরিণত জীবনযুদ্ধ, অকাল বৈধব্য, পাত্র নির্বাচনের অধিকার হরণ এবং বিধবা বিবাহের করুণ পরিণতির অসংখ্য নিপীড়নের চিত্র এই কাব্যে বিধৃত। যা সমকালে নারীর অবস্থানকে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে। বিদ্রোহের রুদ্রমূর্তি কবির কবিতায় সেভাবে প্রতিভাত হয়নি, বিপ্লবের লাল পতাকা ও তাঁর কাব্যিক অনুভূতিকে সেভাবে রঞ্জিত করেনি। তবু শান্ত, সংযত, ধীর-স্থিরভাবে সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি তার সৃজন চেতনাকে নিরন্তর সজাগ রাখেন। নারীর সামাজিক অবস্থানকে মানুষের মর্যাদা দিতে গিয়ে তার কবিতায় সৃষ্ট, সুললিত, রূপ সুষমাকে অপসৃত করে কঠিন জীবনবোধকে মূর্ত করে তোলেন। গীতি কবিতার রসবোধ, সাঙ্গীতিক আবহ কবিকে বার বার প্রাণিত করলেও সমাজের রূঢ় বাস্তবতাকে তিনি কখনও উপেক্ষা করেননি। সমাজ-সমীক্ষকের ভূমিকায় শক্ত লেখনীর দাগ কাটেন তাঁর স্বপ্নাচ্ছন্ন কবিতায়। ‘পলাতকা’ কাব্য গ্রন্থে সমাজের অসহায় নারীদের যে করুণ চিত্র বের হয়ে আসে তা যেমন বেদনাঘন চেতনায় রূপময় একইভাবে তা সমাজ ব্যবস্থার কঠিন আবর্তে রূঢ় বাস্তবের চিত্রও। মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই এদেশের মেয়েদের জন্য কেবল ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ।’ এরই মর্মস্পর্শী আর্তি ‘চিরদিনের দাগ’ কবিতায়। একে একে তিনটি মেয়ের পরে শৈল যখন জন্মাল তার বাপের ঘরে, জননী তার লজ্জা পেলো; ভাবল কোথায় থেকে অবাঞ্ছিত কাঙালটারে আনল ঘরে ডেকে। এ লজ্জা শুধু শিশুকন্যা শৈলের নয় তার মায়েরও। নারী নিগ্রহের এ বিধি একেবারে সমাজের শিকড়ে গাঁথা। মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধ নিয়েই শৈলের শিশু-কিশোর অতিক্রান্ত হয় নানা ঘাত-প্রতিঘাতে। পরিণতিও কোন শুভকর হয়নি। বিনা দোষে অপরাধের বোঝা নিয়ে শৈলের জীবনে যে দুর্বিষহ অভিশাপ নেমে আসে সেখানে বিদ্যমান সমাজ ও তার বিরুদ্ধে চলে যায়। ব্যবস্থার সঙ্গে নারী নিগ্রহের ব্যাপারটি ছিল একেবারে অবিচ্ছিন্ন। কিভাবে এ দেশের মেয়েদের অবোধ বালিকা থেকে শুরু করে জীবনের শেষদিন অবধি অনাদরে, অবহেলায় কেটে যায় স্বামী সংসারের ঘানি টানতে টানতে। ‘মুক্তি’ কবিতায় তারই নির্মম ছবি। মুক্তি বলতে এখানে একেবারেই জীবন থেকে মুক্তি। গঁৎবাধা সংসার জীবনের নিত্য কর্মপ্রবাহের গ্লানিতে মেয়েরা বুঝতেই পারে না কিভাবে স্বপ্নীল দিনগুলো নিঃশেষ হয়ে যায়। নববসন্তের পাতায় পাতায় নতুনের আগমন, অজানা শিহরণ কোনটাই বালিকাবধূদের অন্তরে সাড়া জাগায় না। লক্ষ্মী-প্রতিমার মতো গৃহস্থালির কাজই তার জীবনের ব্রত; সেখানে স্বামী-সন্তানের প্রতি কোন অনুভব, অনুভূতি বাহুল্য মাত্র। এটাই বঙ্গ-ললনার অম্লান রূপ লাবণ্য। এ সংসারে এসেছিলেম ন’বছরের মেয়ে, তার পরে এ পরিবারের দীর্ঘ গলি বেয়ে দশের ইচ্ছা বোঝাই করা এই জীবনটা টেনে টেনে শেষে পৌঁছিনু আজ পথের প্রান্তে এসে। পলাতকা কাব্যের প্রায়ই সব কবিতায় আছে এ দেশের নির্যাতিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মেয়েদের অধিকার হরণের ব্যথা, দুঃখ, কষ্ট-যন্ত্রণার বেদনাক্লিষ্ট অভিব্যক্তি। ‘নিষ্কৃতি’ কবিতায় বালিকা মঞ্জুলিকার বিয়ে হয় তার চেয়ে পাঁচগুণ বয়সী এক মৃত্যুপথযাত্রী ব্রাহ্মণের সঙ্গে। পরিণতিতে যা ঘটার তাই ঘটে। অবশেষে বৈশাখে, এক রাতে মঞ্জুলিকার বিয়ে হলো পঞ্চাননের সাথে। পঞ্চাননকে ধরল এসে যমে; কিন্তু মেয়ের কপালক্রমে ফলল না তার শেষের দিকটা দিল না যম ফিরে; মঞ্জুলিকা বাপের ঘরে ফিরে এলো সিঁদুর মুছে শিরে। মঞ্জুলিকার অকাল বৈধব্যে স্নেহশীলা মায়ের বুক আনচান করে। মেয়েকে আবারও বিয়ে দেয়ার সুপ্ত বাসনা স্বামীকে জানায়। অগ্নিশর্মা বাবার প্রতিক্রিয়া কবির লেখনীতে যেভাবে মূর্ত হয় তাÑ বাবা বললেন, কঠিন হেসে, ‘তোমরা মায়ে ঝিয়ে এক লগ্নেই বিয়ে করো আমার মরার পরে, সে ক’টা দিন থাকো ধৈর্য ধরে। মেয়ের চিন্তায়, দুর্ভাবনায় এক সময় মায়েরও মৃত্যু হয়। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর এক বছর যেতে না যেতেই বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। বৌ ঘরে নিয়ে পা দিতেই বাবা বুঝতে পারেন মঞ্জুলিকা তার ভালবাসার মানুষ পুলিনকে বিয়ে করে ঘর ছাড়ে। মুহূর্তে পিতার অভিশাপ বর্ষিত হয় মেয়ের ওপরÑ আগুন হয়ে বাপ বারে বারে দিলেন অভিশাপ। রবীন্দ্রনাথ পুরুষের একচেটিয়া আধিপত্যকে আঘাত করে মেয়েদেরও সমঅধিকার থাকা বাঞ্ছনীয়Ñ নিজের এ বোধকে নানামাত্রিকে স্পষ্ট করার অভিব্যক্তি তুলে ধরেন কবিতাটিতে। এমনিভাবে পলাতকায় কবি নারীর সামাজিক অবস্থা নির্ণয়ে বাস্তবোচিত নিখুঁত ছবি আঁকতে সক্ষম হন। ১৯১৮ সালের এই কাব্য তার নোবেল বিজয়ের পর লেখা হয়। তখন শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ একেবারে শেষের দিকে। বয়স প্রায়ই ষাটের কোঠায়। গ্রামে, গঞ্জে, দেশে, বিদেশে নারীর আর্থ-সামাজিক অসম ব্যবস্থায় তিনি ক্ষুব্ধ, মর্মাহত। সেই বেদনার শৈল্পিক আঁচড় পড়ে পলাতকায়। সমাজ চিন্তায় তিনি তখন স্থিত, পরিপক্ব এবং অনেক বেশি পরিণত। সাহিত্যের যে আঙিনায় (কবিতা) শুধু কল্পলোকে বিচরণ, আবেগে-আপ্লুত হওয়ার অনুভূতি সেখানে নির্মম কঠিন বাস্তবতা পথ আগলে দাঁড়ায়। সমাজের অর্ধাংশ অসহায় নারী জাতির প্রতি জাগ্রত হন, ভেঙে দিতে উদ্যত হন সেই সব নিয়ম-শৃঙ্খল যা নারীকে মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, কেড়ে নেয় তার সব ধরনের মানবিক চাহিদা। অস্তিত্বের প্রয়োজনে, বেঁচে থাকার তাগিদে নারী হয়ে ওঠে সার্বিক চেতনার ধারক, অধিকার আদায়ের নিয়ন্ত্রক, মানুষ হিসেবে টিকে থাকার সক্রিয়, দক্ষ চালক। তাঁর সাহিত্যের আপন আঙিনায়, নিভৃত সৃষ্টিতে বার বার বেদনাহত আওয়াজ তোলেন অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের নমনীয় প্রতিবাদ।
×