ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হেলিকপ্টারযোগে সেনাবাহিনীর খাদ্য বিতরণ শুরু

সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি ও জুম ফলন কম হওয়ায় সাজেকে খাদ্য সঙ্কট

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৫ মে ২০১৭

সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি ও জুম ফলন কম হওয়ায় সাজেকে খাদ্য সঙ্কট

মোয়াজ্জেমুল হক/জীতেন বড়ুয়া ॥ দেশের সর্ববৃহৎ ইউনিয়ন। অথচ জনসংখ্যা মাত্র অর্ধ লাখ। নাম সাজেক। পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার একটি ইউনিয়ন। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার। কিন্তু দুর্গম। পর্যটনের অপার সম্ভাবনা এই সাজেকে এবার সৃষ্টি হয়েছে খাদ্য সঙ্কট। সঙ্কট নিরসনে গত বুধবার থেকে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে হেলিকপ্টারযোগে শুরু হয়েছে খাদ্য বিতরণ। এছাড়া বাঘাইছড়ি উপজেলা ইউনিয়নের উদ্যোগেও অনুরূপ খাদ্য বিতরণ কর্মসূচী শুরু হয়েছে। সাজেকের দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় খাদ্য সঙ্কটের নেপথ্যে রয়েছে ভিন্ন কিছু বিষয়। এর মধ্যে দুটি প্রধান কারণ অনুসুন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। এর একটি পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি, অন্যটি জুম চাষে ফলন কম হওয়ার জের। উল্লেখ্য, সাজেক ইউনিয়নের আয়তন ৬শ বর্গমাইলেরও বেশি। উপজাতীয়দেরই বসবাস বেশি। এলাকাবাসীর আয়ের মূল উৎস জুম চাষ ও বনজ সম্পদ সংগ্রহ করে বিক্রির মাধ্যমে উপার্জন। সাধারণত বর্ষাকাল শুরুর আগেই জুম চাষীরা পাহাড়ের পর পাহাড়কে চাষাবাদের উপযোগী করে তোলে আর বর্ষা শুরু হলেই শুরু হয় বীজ বপন। এ জুম চাষ থেকে উৎপাদিত ফসল বেচাকেনার মাধ্যমে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ হয়। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভারতের মিজোরাম রাজ্য সন্নিহিত সাজেক। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত সাজেক। স্থানীয়দের পক্ষ থেকে অভিযোগে জানা গেছে, পাহাড়ী সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর বেপরোয়া চাঁদাবাজির কারণে জুম চাষ, বনজ সম্পদ আহরণ তথা ব্যবসা বাণিজ্যে, উন্নয়ন কর্মকা-ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা শুধু বাঙালী নয়, পাহাড়ীদের কাউকে চাঁদার হাত থেকে রেহাই দিচ্ছে না। জুম চাষে, উৎপাদিত ফসল, বনজ সম্পদ আহরণ করে বাণিজ্যিক কর্মের ওপর চাঁদার পরিমাণ এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, যার কারণে পাহাড়ীরাও জুম চাষ থেকে ধীরে ধীরে পিছু হটছে। এর পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্য নিয়ে বাজারে যাওয়ার পথে চাঁদার হার থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। এছাড়া গত বছর প্রকৃতিগত কারণে জুম চাষে ফলন হ্রাস পেয়েছে। এ দুটি কারণেই এবার সাজেকের ২০টি ইউনিয়নে তীব্র খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। খবর নিয়ে আরও জানা গেছে, রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির এই সাজেক অবৈধ অস্ত্র চোরাচালানিদের একটি রুটেও পরিণত হয়েছে। ভারতের মিজোরাম থেকে এ পথ দিয়ে অস্ত্রের চোরাকারবারিরা আগের চেয়ে অধিকহারে সক্রিয় রয়েছে। অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে এসেছে, ইউপিডিএফ ও জনসংহতি সমিতির ক্যাডার গ্রুপগুলো সাজেক এলাকাকে তাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছে এবং এর পরিধি দিন দিন ব্যাপৃত হচ্ছে। ইতোপূর্বে এ সাজেকে পর্যটকদের আগমনের সংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল তা নিরাপত্তার কারণে এখন হ্রাস পেয়েছে। সাজেকের ইউনিয়নগুলোর এতই দুর্গম এলাকায় অবস্থিত যে, কোন কোন এলাকায় হেঁটে যেতে ৫ থেকে ৭ দিন সময় লাগে। বিগত ২০১১ সালে ইউপিডিএফ এ সাজেকে প্রশিক্ষণের ঘাঁটি গেড়েছিল। এসব পাহাড়ী সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে সাজেককে একটি নিরাপত্তাহীন এলাকায় পরিণত করতে তৎপর রয়েছে। ২০১৩ সালের ৮ মার্চ মিজোরামের আইজল শহর থেকে ৪৬টি একে ৪৭, ৩টি লাইট মেশিনগানসহ বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ আটক করে সীমান্ত এলাকার মিজোরাম পুলিশ। আটককৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিল, মিজোরাম থেকেই প্রতিনিয়ত অস্ত্রের চালান বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পৌঁছানো হয় সাজেক রুট দিয়ে। এসব অস্ত্রশস্ত্রের ক্রেতা হচ্ছে পাহাড়ী সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। উল্লেখ করা যেতে পারে, অর্ধ লক্ষাধিক জনঅধ্যুষিত সাজেকের অধিবাসীদের জীবনধারায় রয়েছে বৈচিত্র্য। সেখানকার অধিবাসীদের মূল কাজই হচ্ছে জুম চাষ ও বনজ সম্পদ সংগ্রহ। এটি তাদের ঐতিহ্য। গত বছর ধানসহ অন্যান্য ফসলের ফলন হ্রাস হওয়ার কারণে গেল দু’মাস আগে থেকেই খাদ্য সঙ্কট শুরু হয়। সাজেকের উদলছড়ি, নতুন জৌপুই, পুরান জৌপুই, নিউ থাং মাং, নিউ লংকর, বেটলিং পাড়া, শিয়ালদাই, নিমুইপাড়া, হাগড়া কেজিং, দুলুছড়ি, দুলবন্যাসহ বিশ গ্রামের সাড়ে চার শতাধিক পরিবারের মাঝে খাদ্য সঙ্কট সবচেয়ে বেশি। বিষয়টি প্রচার মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে জানাজানি হওয়ার পর উপজেলা প্রশাসন সঙ্কট মোকাবিলায় নামলেও তা অপ্রতুল। ফলে সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশনের উদ্যোগে গত বুধবার থেকে হেলিকপ্টারযোগে শুরু হয়েছে খাদ্য বিতরণ। খাগড়াছড়ির রিজিয়নের পক্ষ থেকেও খাদ্য সঙ্কট মোকাবিলায় তৎপরতা শুরু করেছে। প্রতিদিন হেলিকপ্টারযোগে দুর্গম এলাকার গ্রামগুলোতে খাদ্য বিতরণ করা হচ্ছে। ফলে খাদ্য সঙ্কটে পড়া পাহাড়ী অধিবাসীদের মাঝে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চার দফায় হেলিকপ্টারযোগে খাদ্য পৌঁছানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর বাঘাইহাট জোন কমান্ডার লে. কর্নেল মোঃ ইসমাইল খাঁ। সাজেক ইউপি চেয়ারম্যান মেলসান চাকমা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, একদিকে জুম চাষে অনীহা, অপরদিকে নির্বিচারে বনজ সম্পদ ধ্বংস হওয়ার কারণে স্থানীয় অধিবাসীদের আয়ের উৎস কমে গেছে। এছাড়া গত বছর প্রকৃতিগতভাবে জুম চাষ থেকে কাক্সিক্ষত উৎপাদন আসেনি। পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেননি। তবে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কোন তথ্য দেননি। কিন্তু স্থানীয় অধিবাসীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জুম চাষে আগেভাগেই চাঁদা ধার্য করে দেয়া হয়। ফলে জুমিয়া পরিবারগুলো জুম চাষ থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছে। পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা জুম চাষীসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতদের কাউকে রেহাই দেয় না। নির্ধারিত চাঁদার পরিমাণ পৌঁছে দেয়া না হলে নেমে আসে বিপদ। ফলে তারা ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় দিনযাপন করে। পুরো সাজেক এলাকাটি এতই দুর্গম যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যে কোন ঘটনা ঘটলে দ্রুততম সময়ে অকুস্থলে পৌঁছুতে পারে না। আর এ কারণে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া দাপট চলছে। এ বছর এ সাজেকে যে খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে তা অতীতের যে কোন সময়ের একটি রেকর্ড। সরকারের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনী সাজেকের পাহাড়ী লোকজনকে খাদ্য সঙ্কট থেকে রক্ষায় হেলিকপ্টারযোগে ত্রাণ বিতরণের কর্মসূচীতে এলাকায় বর্তমানে স্বস্তি ফিরে এসেছে। তবে এ কর্মসূচী অব্যাহত রাখা না হলে আবারও অভাব অনটন অনাহার অর্ধাহারে জীবন কাটাতে হবে পাহাড়ের অনগ্রসর এলাকার এসব মানুষকে। সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশন সূত্রে জানা গেছে, তারা পুরো বিষয়টি মনিটরিং করছেন। প্রতিনিয়ত হেলিকপ্টারে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিয়ে সেখানকার পাহাড়ী জনগণকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসার তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি ও বাঘাইছড়ি জোনের সদস্যদেরও এ কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি বাঘাইছড়ি উপজেলা প্রশাসন থেকে খাদ্য সহায়তা বৃদ্ধির জন্য সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে বলে উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
×