ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হাওড়ে বাঁধ নির্মাণ

পাউবো কর্মকর্তারাই অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন ॥ দুদক

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৫ মে ২০১৭

পাউবো কর্মকর্তারাই অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন ॥ দুদক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের হাওড়াঞ্চলে ২৮টি বাঁধ নির্মাণ, সংস্কারে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবসহ সাত কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির মহাপরিচালক (প্রশাসন) মুনীর চৌধুরীর নেতৃত্বে দুদকের একটি দল দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে পৌনে ৩টা পর্যন্ত তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কর্মকর্তারা হলেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোঃ খলিলুর রহমান, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর কবির, অতিরিক্ত মহাপরিচালক আব্দুল হাই আল বাকী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হারুন অর রশিদ এবং সাময়িক বরখাস্ত হওয়া সিলেটের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ নুরুল ইসলাম সরকার, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (উত্তর-পূর্বাঞ্চল) মোঃ আব্দুল হাই ও সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আফসার উদ্দীন। অপরদিকে হাওড়ের বাঁধ নির্মাণসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকা-ে কোন প্রকার দুর্নীতি হয়েছে কি না তা বের করতে দুদকের পরিচালক মোহাম্মদ বেলাল হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি অনুসন্ধান কমিটি করেছে দুদক। অপর দুই সদস্য হলেন উপপরিচালক আব্দুর রহিম, সহকারী পরিচালক সেলিনা আক্তার মণি। জিজ্ঞাসাবাদের পর সুনামগঞ্জে হাওড়ের বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে অনিয়মের কথা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারাই স্বীকার করেছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন মুনীর চৌধুরী। তিনি বলেন, হাওড় রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত এই সংস্থার প্রচ- গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারা যথাযথভাবে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ডিজি থেকে শুরু করে সবাই তা স্বীকার করে বলেছেন, পানিতে বাঁধ ডুবে যাওয়ার কারণে বাঁধগুলো সম্পর্কে মেজারমেন্ট করতে পারেনি। প্রকল্পগুলোতে অনিয়মের তদন্তকারী জাতীয় গোয়েন্দা দফতরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে সুনামগঞ্জের ৩৭টি হাওড়ের ডুবে যাওয়া বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজে দুটি প্রকল্প নেয়া হয় ৬৫ কোটি টাকার। উক্ত কাজ পেয়ে দুইজন ঠিকাদার বাঁধ নির্মাণ কাজ ঠিকমতো করেননি। তারপর এবারও তারা এ কাজ পেয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মুনীর চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আজকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও সিনিয়র অফিসারদের ডেকেছিলাম সুনামগঞ্জে হাওড়ের বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে যে অনিয়ম হয়েছে তা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য। জিজ্ঞাসাবাদে আমরা যেসব বার্তা উদঘাটনে সক্ষম হয়েছি তা হলো- বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রচ- গাফিলতি ছিল। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পাউবো চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তারা বাঁধ নির্মাণ বাস্তবায়ন, মনিটর ও কাজ আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রকল্পে যে অনিয়ম হয়েছে সেটা তারা স্বীকার করেছে। পাউবোর একজন প্রকৌশলীকে ওএসডি করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকলেও তারা তা করেনি বলে জানান মুনীর চৌধুরী। জিজ্ঞাসাবাদের পর পাউবোর ডিজির বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। দুর্বল ও অসমাপ্ত বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবন ও ফসলহানির পেছনে বাঁধ নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি দায়ী বলে অভিযোগ ওঠার পর সংস্থাটির তিন প্রকৌশলীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, গত ৩১ মার্চের মধ্যে এবারের প্রকল্প শেষ করার কথা ছিল। মার্চের শেষেই বৃষ্টি ও উজানের ঢলে তলিয়ে যায় হাওড়গুলো। সুনামগঞ্জসহ আশপাশের ছয়টি জেলার হাওড়াঞ্চলের মোট দুই লাখ ১৯ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আট লাখ ৫০ হাজার ৮৮টি পরিবার। দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য জনকণ্ঠকে বলেন, সুনামগঞ্জের হাওড় এলাকায় বাঁধ ভেঙ্গে ফসলের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানতে ২০১৬ সালের এপ্রিলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে দুদকের পক্ষ থেকে একটি চিঠি পাঠায়। এর প্রায় দশ মাস পর গত ফেব্রুয়ারিতে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় দুদকে প্রতিবেদন পাঠায়। ওই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই তাদের তলব করা হয়েছে ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৩০ এপ্রিল সুনামগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত হাওড় এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে বলেন, বাঁধ নির্মাণে কারও গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এরপরই নড়ে বসে দুদক। ইতোমধ্যে হাওড়াঞ্চলের বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজের সঙ্গে যুক্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তিন প্রকৌশলীকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এরা হলেন- সিলেটের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ নুরুল ইসলাম সরকার, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (উত্তর-পূর্বাঞ্চল) মোঃ আব্দুল হাই এবং সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আফসার উদ্দীন। এদিকে হাওড় রক্ষা বাঁধের নির্মাণ ও সংস্কার কাজে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ধীরগতির অভিযোগ তদন্তে গত মাসে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব মোঃ খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত এক সদস্যের কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। পুনর্গঠিত কমিটিতে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মোহাম্মদ আলী খানকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। এতে খলিলুরের সঙ্গে পাউবোর চিফ মনিটরিং অফিসার কাজী তোফায়েল হোসেনকে সদস্য এবং মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-প্রধান মন্টু কুমার বিশ্বাসকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। অন্যদিকে সুনামগঞ্জ, সিলেট ও নেত্রকোনা জেলার হাওড় এলাকায় আগাম বন্যা ও হাওড়ের ফসল বিনষ্ট হওয়ার কারণ এবং বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে গত ৯ এপ্রিল পাউবোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পূর্বাঞ্চল) এ কে এম মমতাজ উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে আরেকটি তদন্ত কমিটি করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
×