ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

৫ মে ॥ সেই বিভীষিকা কী করে ভুলবে ঢাকার মানুষ?

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৫ মে ২০১৭

৫ মে ॥ সেই বিভীষিকা কী করে ভুলবে ঢাকার মানুষ?

মোরসালিন মিজান ॥ এই সময়ের বুকে ক্ষত জমে আছে/শহরের বুকে ক্ষত জমে আছে/তোমারও বুকে ক্ষত জমে আছে/কিছু দেখি, কিছু দেখতে পাই না...। বহুদিন গত হয়েছে। বদলে গেছে অনেক কিছু। তাই বলে ৫ মে’র বিভীষিকা কী করে ভুলবে শহর ঢাকার মানুষ? ২০১৩ সালের এই দিনে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী শহর ঢাকার বুকে যে ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছিল, তা আজও দগদগে ঘা হয়ে আছে। শান্তির ধর্মের বিপরীতে দানবের চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। প্রিয় শহর ঢাকা এক রকম দখলে নিয়েছিল। ইসলাম রক্ষার নাম করে রাজধানীতে প্রবেশ করেছিল মৌলবাদী গোষ্ঠী। সংগঠনের অজ্ঞ-অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-ধর্মান্ধ কর্মীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতাকারী অপশক্তি জামায়াত-শিবির। যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে হেফাজতের ঘাড়ে চড়ে বসে এই দৈত্য। এর পর শুরু হয় তা-ব। মতিঝিল, পল্টন, বিজয়নগর, গুলিস্তান, নয়াপল্টন ও বায়তুল মোকাররম এলাকা দখলে নিয়ে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালায় মানুষরূপী দানবরা। টেলিভিশনে দৃশ্যগুলো সরাসরি দেখানো হয়। ভালবাসার শহরকে চোখের সামনে জ্বলেপুড়ে ছাই হতে দেখেন নগরবাসী। এর পরদিন অবশ্য কান ধরে উঠ-বস করেই বিদায় নেয় হেফাজত। তবে সেই দুঃসহ অতীত ভোলার নয় কোনদিন। ঘটনার পর টানা কয়েকদিন গোটা এলাকা ঘুরে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি বিবেকবান মানুষ। প্রিয় শহরের মানুষের ওপর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিসের ওপর এমন হামলা ছিল নজিরবিহীন। আজকের দিনে কিছুটা তার স্মরণ করা জরুরী বৈকি। ঘটনার পর কয়েকদিন গোটা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে ধ্বংসস্তূপ। উগ্রবাদীরা যা সামনে পেয়েছিল তাই ভেঙ্গে-গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। পুড়িয়ে দিয়েছিল। পল্টনের ফুটপাথে পুরনো বইয়ের বেশ কিছু দোকান। অস্থায়ী দোকান ছিল। ছিল কয়েকটি স্থায়ী দোকানও। সব মিলিয়ে ৩৮টি। কিভাবে যেন পাঁচটি বেঁচে যায়। বাকি সব দোকান পুড়িয়ে দেয়া হয়। দাউ দাউ করে হাজার হাজার বই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এভাবে সব হারানোর একজন উত্তম কুমার। দশ বছর ধরে এখানে বই বিক্রি করছেন। সব হারিয়ে নিঃস্ব দোকানি সেদিন খুব কাঁদছিলেন। তার কথাগুলো এখনও কানে বাজে। বলছিলেন, ফুটপাথে বসি। তবু একটা বইয়ে ধুলো জমতে দেইনি। অথচ সেই বই আগুন পুড়িয়ে দিয়েছে শয়তানের দল। তার ৩ হাজারের মতো বই সেদিন পুড়ে ছাই হয়ে যায়। হাসান নামের আরেক ব্যবসায়ীর অভিজ্ঞতা তুলে ধরা যেতে পারে। তিনিও প্রথমে অনুমান করতে পারেননি কেউ ধর্মের নামে মানুষের এত ক্ষতি করতে পারে। নিজের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলছিলেন, হেফাজতের লোকজনকে আমরা পানি খাওয়াতে গেছি। রুটি-কলা নিয়ে গেছি ওদের জন্য। কিন্তু তারা আমাদের ছোবল দিতে দুবার ভাবেনি। ওদের উন্মত্ততা দেখে এক পর্যায়ে হুজুরদের কাছে হাতজোড় করে তিনি নাকি মাফ চেয়েছিলেন। কাজ হয়নি। কথা শোনেনি উগ্রবাদীরা। বইয়ে আগুন দিয়েছিল ঠিকই। নিজের সব হারানোর কথা জানিয়ে তিনি বলছিলেন, এটা কোন্ বিচার? শফিক নামের এক¦ৃদ্ধও হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। দুঃখ করে তিনি বলছিলেন, এই তা-বের মাঝেও আমি ঝাঁপি ধরে টেনে বইগুলো ভেতরে ঢোকানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওরা আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বইয়ে আগুন দিয়েছে। তার কথাগুলো শুধু কথা বলে মনে হয়নি। মনে হয়েছিল অভিশাপ। এই অভিশাপ ধর্মীয় উন্মাদদের জন্য। একই সময় উন্মাদরা পাশের মুক্তিভবনে কমিউনিস্ট পার্টির কার্যালয়ে আগুন দেয়। আগুন ছড়িয়ে যায় আশপাশের বিভিন্ন অফিসে, দোকানে। ওই ভবনের দোতলার উত্তরা ব্যাংকের শাখাটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পল্টনের র‌্যাংগস ভবনেও ব্যাপক ভাংচুর চালানো হয়। আগুন দেয়া হয় কেএফসির শোরুমে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন ভবনের দিকে তো তাকানোই যাচ্ছিল না। এই চোখ আগে কোনদিন দেখেনি এমন বর্বরতা। ভবনটির নিচতলায় ছিল জনতা ব্যাংকের শাখা। সেটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে দিয়েছিল হেফাজতীরা। শাখাটির ভেতরে-বাইরে পুড়ে একরকম ছাই হয়ে গিয়েছিল। আগুনে পুড়ে যায় পাশে থাকা আইডিয়াল প্রোডাক্টসের শোরুম। ভবনের ভেতরের অংশে বড় খোলা জায়গা। এখানে সব গাড়ি পার্ক করে রাখা হয়েছিল। পাশাপাশি রাখা ২৪টি গাড়িতে সেদিন আগুন দেয়া হয়। বাকি গাড়িগুলোতে চলে ভাংচুর। ভবনের গার্ড দেলওয়ার ঘটনার সাক্ষী। জনকণ্ঠকে তিনি বলছিলেন, হেফাজতীরা ভবনের দুই গেট দিয়ে স্রোতের মতো প্রবেশ করে। সবাইকে অফিস ছাড়তে বলে। সবাই বের হতে না হতেই আগুন ধরিয়ে দেয় সবখানে। তার মতে, আশপাশের এলাকা জামায়াত-শিবিরের ঘ৭াটি। এরা সব অফিস চেনে। এ জন্যই তাদের অফিস বেছে নিয়েছিল। কথার এক পর্যায়ে চোখ কিছুটা ছল ছল করে উঠছিল তার। অসহায়ের মতো বলছিলেন, সব বুঝেও আমাদের কিছু করার ছিল না। ভবনে আরও ছিল আয়কর বিভাগ, প্রধান হিসাব নিরীক্ষণ কর্মকর্তা (জনপ্রশাসন), বাংলাদেশ টুরিজম বোর্ড ও যুবক কমিশনের কার্যালয়। সেগুলোও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বিএইচবিএফসি কর্তৃপক্ষ পরে জানিয়েছিল, সব মিলিয়ে তাদের ১৮ কোটি ১৭ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জামায়াত আর হেফাজতের তা-বের চিহ্ন ছিল রাজপথেও। পল্টন থেকে মতিঝিলে যাওয়ার পথটি চেনা যাচ্ছিল না। মাঝখানে ডিভাইডার উপড়ে ফেলা হয়েছিল। কংক্রিটের স্তূপ হয়ে ছিল মাঝখানে। বৈদ্যুতিক খুঁটির নিচে মস্ত ঢালাই। এর পরও দিব্যি উপড়ে ফেলা হয়েছিল। মাঝখানে বিশাল দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়েছিল বাকি খুঁটিগুলো। এই শহরে বৃক্ষ খুব যতেœ বড় করতে হয়। নয়াপল্টনে যাওয়ার রাস্তা থেকে সেসব বৃক্ষ নির্মমভাবে কেটে ফেলা হয়েছিল। গাছের উপড়ে ফেলা গুঁড়িগুলো নির্মমতার বর্ণনা দিচ্ছিল যেন। ধর্মের নামে যে ধ্বংসযজ্ঞ তা থেকে সেদিন বাদ যায়নি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমও। মসজিদটির বাইরের দেয়ালে বহুদিন ছিল আগুনে পোড়া দাগ। মসজিদের দক্ষিণ গেটে, এমনকি কোরান শরিফ, হাদিসের বই পুড়িয়ে দিয়েছিল অন্ধের দল। টুপি, আতর, সুরমা কিংবা মেসওয়াক কোনটিই বাদ যায়নি। দুঃখ করে দোকানি তৈয়বুর রহমান বলছিলেন, কোরান-কিতাব দোকানে রেখেই আমরা নামাজ পড়তে যাই। চোরও নেয় না। ভয় পায়। অথচ, হুজুর নামধারীরা আসমানি কিতাবও পুড়িয়ে দিয়েছে। এই দুঃখ কোথায় রাখি! একইভাবে পোড়ানো হয় খেলনা, কাপড়, ব্যাগের দোকানও। তবে স্বর্ণের দোকানগুলো যেন ছিল বিশেষ টার্গেট। এই মার্কেটটা এমনভাবে আগুনে জ্বালানো হয়েছিল যেন কোন যুদ্ধক্ষেত্র। মার্কেটের সামনের স্টেনলেজ স্টিলের অবকাঠামো পর্র্যন্ত পুড়ে গলে গিয়েছিল। সেই ক্ষত এখনও দগদগে। বহুদূর থেকে দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামেও আছে সেই একই ক্ষতচিহ্ন। পুরো ঘটনায় বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত যেমন হয়েছেন তেমনি বেদনাহত হয়েছেন শহরের অধিকাংশ মানুষ। সেই বেদনার কথা জানিয়ে ইতিহাসবিদ ও ঢাকার বিষয়ে প্রচুর গ্রন্থের রচয়িতা মুনতাসীর মামুন বলেন, এই ঢাকা চার শ’ বছরের। ঐতিহ্যবাহী শহর। এখানে বহু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস রচিত হয়েছে। আন্দোলন সংগ্রাম, শিল্প, সাতিহ্য, সংস্কৃতির ঢাকায় এমন বর্বরতা অকল্পনীয়। তবে একটি ভাল হয়েছে। মানুষ ধর্মের নামে এমন তা-ব সৃষ্টিকারীদের চিনেছে। এই অভিজ্ঞতার আলোকে আগামী দিনগুলোতে তাদের মূল্যায়ন করার আহ্বান জানান তিনি।
×