ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

আট লাখ ব্যবসায়ী নিবন্ধিত ॥ কিন্তু ভ্যাট দেন মাত্র ত্রিশ হাজার

প্রকাশিত: ০৩:২৯, ৫ মে ২০১৭

আট লাখ ব্যবসায়ী নিবন্ধিত ॥ কিন্তু ভ্যাট দেন মাত্র ত্রিশ হাজার

এপ্রিলের ৩০ তারিখে ঢাকায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের’ (এনবিআর) এক মতবিনিময় সভা হয়ে গেল। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সভার প্রতিবেদন থেকে বোঝা যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের যত কথা, যত ব্যথা সব দুটো জিনিস নিয়ে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘ভ্যাট’, অন্যটি হচ্ছে পণ্যের ওপর অগ্রিম আয়কর। আগামী বাজেট থেকে ব্যবসায়ীরা ‘ভ্যাট’ দিতে চান, কিন্তু সরকার নির্ধারিত ১৫ শতাংশ হারে নয়। ভ্যাটের এই হার নিয়ে তারা লড়ছেন দীর্ঘদিন ধরে। তাদের যুক্তি- একই হার অর্থাৎ ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, জনগণের বোঝা বাড়বে। অধিকন্তু ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ীরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের দাবি- বর্তমানের প্যাকেজ পদ্ধতির ভ্যাট অব্যাহত রাখতে হবে। পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত বার্ষিক টার্নওভারের ওপর কোন ভ্যাট আরোপ করা যাবে না। এর ওপরে হলে ভ্যাট হতে হবে মাত্র তিন শতাংশ, ১৫ শতাংশ নয়। এসব দাবি নিয়ে মতবিনিময় সভায় তুমুল বাগ্্বিত-া হয়ে গেল। দৃশ্যত একদিকে সরকার তথা ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড’ এবং আরেক দিকে ‘এফবিসিসিআই’ (ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ)। মিডিয়া এই নিয়ে মুখরোচক অনেক স্টোরি করেছে। বলা হয়েণ্ডে ‘ব্যবসায়ীরা আন্দোলনে যাবেন, অর্থমন্ত্রী তা দমন করবেন’। এমন ধরনের খবর প্রায় কাগজেরই। আমি এসব উত্তেজক খবরে উৎসাহী নই, আমি উৎসাহী ব্যবসায়ীদের দাবি কী তা নিয়ে। কারণ বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও সরকার ‘ভাই ভাই’। ব্যবসায়ী নেতারাই সরকার, আবার সরকার ব্যবসায়ীরা। বড় ব্যবসায়ী নেতারা বহুদিন ধরে সরকার কর্তৃক প্রকৃতপক্ষে মনোনীতই। এমতাবস্থায় বাগ্্বিত-ার বিষয়টিকে ‘সেমসাইড’ যুদ্ধ বলা যায়। এক সময় তার আপোসরফা হয়ে যাবে। থেকে যাবে দাবি এবং তা থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতি। যেমন একটি দাবি সম্পূরক শুল্ক নিয়ে। ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ‘ভ্যাট’ আইন কার্যকর হলে ১ হাজার ৩৫০টি পণ্য থেকে সম্পূরক শুল্ক উঠে যাবে। তাহলে দেশীয় শিল্প মার খাবে। এটা ঘোরতর বিষয়। ‘ভ্যাট’ হোক, কিন্তু বহু কষ্টে গড়ে ওঠা দেশীয় শিল্প মার খাক এটা কেউ আমরা চাই না। সরকারকে এই সমস্যা আমলে নিতে বলব। ‘কর্পোরেট কর’ কমানোর দাবি এসেছে ঐ সভায়। অর্থমন্ত্রী মনে হয় নিমরাজি। বস্তুত, আমাদের দেশের কর্পোরেট করের হার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় খুব একটা বেশি নয়। তবুও বলব এই সম্পর্কে সরকার ভাবতে পারে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই হারের সামঞ্জস্য বিধান করাও চলে। বিশেষ করে অর্থমন্ত্রী যখন ইঙ্গিত করেছেন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ করের হারে। তিনি বলেছেন, আয়করকে তিনি স্থায়ী রূপ দিতে চান। পাঁচ-সাত-দশ বছরের জন্য। এ কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে করমুক্ত আয়সীমা ১০ হাজার ডলার। বাংলা টাকায় তা হয় ৮ লাখ টাকা। এই ক্ষেত্রে তিনি নিজের উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আয়কর দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে যে হারে আয়কর দিয়েছেন ২০০৪ সালেও একই হারে কর দিয়েছেন। আমাদের দেশে এটা কী ভাবা যায়? হতভাগা দেশে প্রতিবছর তা পরিবর্তন করা হয়। পরিবর্তন হয় নানা হিসাব-নিকাশে। মাঝখানে একবার প্রয়াত অর্থমন্ত্রী মোঃ সাইফুর রহমান আয়করের বিধানাবলী দুই-তিন বছরের জন্য স্থায়ীভাবে কার্যকর করেছিলেন। তার সময় অনেক রেয়াতও ছিল। সঞ্চয়পত্রের সুদ আয় ছিল সম্পূর্ণ করমুক্ত। কিন্তু এরপর থেকে প্রতিদিন পরিবর্তন। কোন আয়করদাতা মেয়াদি কোন পরিকল্পনা নিয়ে কিছু করতে পারে না। তার আয়কর কত হতে পারে সে অগ্রিম কিছুই জানে না। জানে অর্থবছর শুরু হওয়ার পর। বিনিয়োগ কত করা যাবে। বিনিয়োগ কিভাবে হিসাবায়ন হবে, বিনিয়োগের ওপর কত রেয়াত, কিভাবে পাওয়া যাবে তা জানা যায় অর্থবছর শুরু হওয়ার পর। বাড়ি ভাড়ার কতটুকু করমুক্ত, কতটুকু করমুক্ত নয়, গৃহনির্মাণ বা ফ্ল্যাটের বিপরীতে নেয়া ঋণের ওপর প্রদত্ত সুদ আয় থেকে বাদ যাবে কিনা তা জানা যায় বছর শেষে। অগ্রিম কিছু ভেবে রাখার কোন উপায় নেই। এমতাবস্থায় সরকার লাভবান, কিন্তু করদাতা হন ক্ষতিগ্রস্ত। অথচ করদাতারা যদি জানে যে, আগামী ১০ বছর বা ২০ বছর পর্যন্ত এই হচ্ছে কর হার, এই হচ্ছে কর হিসাবায়ন পদ্ধতি, এই হচ্ছে বিভিন্ন রেয়াতি ব্যবস্থা তাহলে একজন করদাতা তার কর পরিকল্পনা করতে পারে, কর বাঁচানোর জন্য সরকারী ব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারে। এতে করদাতার ‘টেকহোম পে’ যদি বাড়ে, অথবা সাধারণ করদাতার আয় যদি বাড়ে তাহলে তা প্রসার যেমন বাড়াবে, তেমনি ‘কনজামশন’ও বাড়বে। এই প্রেক্ষাপটে অর্থমন্ত্রীর বর্তমান আশ্বাসকে আমি ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছি। আশা করি তিনি এই কাজটি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়িয়ে করতে পারবেন। করার সময় মনে রাখবেন যাতে হিসাবায়ন পদ্ধতি সহজতর হয়, যাতে উকিলের কাছে দৌড়াতে না হয়। উদাহরণ দিই একটা। বর্তমানে সম্পদের হিসাবের সময় মজার ঘটনা ঘটে। একজন আয়কর দাতাকে বছরে খরচ কত হলো এবং তার সম্পদ কত বাড়ল এই দুটো যোগ করতে হয়। এর সমান হতে হয় মোট আয়কে। অথচ বাঙালীর হিসাব আরও সহজ। আয় ১০ টাকা, খরচ ৮ টাকা, অতএব মোট সম্পদ বৃদ্ধি বছরে ২ টাকা। এমনতর অনেক প্যাঁচ হিসাবায়ন পদ্ধতিতে। এটি বর্তমানে আছে বিনিয়োগ হিসাবায়ন এবং তার ওপর রেয়াত হিসাবায়নেও। এতেই জটিলতা বাড়ে, অথচ রাজস্ব বোর্ডের কোন উপকার হয় না। অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করব সবকিছু হিসাব করে একটা সহজ পদ্ধতিতে আসতে। আর করমুক্ত আয়টা যুক্তিসঙ্গত রাখতে। এতে টাকার বা রাজস্বের অভাব হবে না। অর্থমন্ত্রীই বলেছেন, ভ্যাটের জন্য নিবন্ধনভুক্ত ব্যবসায়ীর সংখ্যা আট লাখ। অথচ ‘ভ্যাট’ দেন মাত্র ৩০ হাজার ব্যবসায়ী। খুবই পরিতাপের বিষয়Ñ এর পরেও ব্যবসায়ীরা ‘যুদ্ধ’ করতে চান। বর্তমান ভ্যাট হার কম। তাহলে কেন ব্যবসায়ীরা ভ্যাট দিচ্ছেন নাÑ এই প্রশ্নটি তো করতে পারি আমরা। পোশাক ব্যবসায়ীদের বিরাট অংশেরই ‘টিআইএন’ পর্যন্ত নেই। এই তথ্য রাজস্ব বোর্ডের। কাগজে দেখলাম ৩০টি প্রতিষ্ঠানের কাছেই মামলায় আটকা ১৬ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট। বিষয়টা কী দাঁড়াল? দাঁড়াল এই যে, ব্যবসায়ীরা যেহেতু কর দেন না তাই করের বোঝা শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়ে সাধারণ করদাতাদের ওপর। রাজস্ব বোর্ড কোন উপায়ন্তর না দেখে এখান থেকে ১০ কোটি, ওখান থেকে ২০ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এবং বোর্ড তাই বেশি বেশি ঝুঁকছে অগ্রিম আয়কর আদায়ে, তাও উৎসে কর্তনের দিকে। এতে শ্রম কম, মেধা লাগে না অথচ রাজস্ব নিশ্চিত। এসব বিকল্প না থাকার কারণ। আট লাখ রেজিস্ট্রিকৃত ব্যবসায়ী যদি ‘ভ্যাট’ দিত তাহলে সাধারণ আয়কর দাতারা কিছুটা স্বস্তি পেত। আমি এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের দায়িত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। শুধু নিলে তো হবে না। আপনারা শক্তিশালী তাই শুধু ‘নেবেন’, দেশকে-সরকারকে কিছুই ‘দেবেন’ না, তা তো হয় না। উৎসে অগ্রিম আয়কর কাটার বিধান রয়েছে বিপুলসংখ্যক পণ্যে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, মৌলিক কাঁচামালের ওপর ধার্যকৃত অগ্রিম আয়কর তুলে দিতে। এটা দৃশ্যত ন্যায্য দাবি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তা রদ করা যায়। তেমনি আরেকটা বিষয় আছে আমানতে প্রদত্ত সুদের ওপর কর কর্তনে। এখানে দুটো হার কার্যকর। একটি আয়কর দাতাদের জন্য প্রযোজ্য, আরেকটি যারা কর দেন না তাদের জন্য। আমি মনে করি বর্তমান হার দুটো মাত্রাতিরিক্ত। এর সামঞ্জস্য বিধান করা দরকার। দুটো হারই থাকতে পারে, তবে তা হ্রাস করা উচিত। সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর কর্তনের পর তাকে ‘চূড়ান্ত নিষ্পত্তি’ ধরা হয়েছে। কিন্তু এই খবর সংশ্লিষ্টরা জানে না। ফলে করদাতারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সঞ্চয়পত্রে যে অগ্রিম কর কেটে হার নির্ধারণ করা হচ্ছে এর ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্টরা দিতে পারে না। এমন অনেক বিষয় আছে যা জানানোর জন্য এবং প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য সারা বছরের জন্য কার্যকর একটা ‘সেল’ থাকা দরকার। ‘অনলাইনে’ তো কর হিসাবায়নের ব্যবস্থা থাকবেই, সাক্ষাতেও যাতে তা করা যায় এর ব্যবস্থাও দরকার। পরিশেষে দুটো কথা বলা দরকার ‘ভ্যাট’ নিয়ে। ‘ভ্যাট’ যা ভ্যালু এ্যাডেড ট্যাক্স তা কার্যত ভোগ কর। ভোগ কর মানে যারা খরচ করে ভোগ করবে তাদেরকেই এই কর দিতে হবে। অর্থাৎ এটি ‘এক্সপেন্ডিচার’ কর। কর যদি ব্যয়ের ওপর অর্থাৎ ‘এক্সপেন্ডিচারের’ ওপর হয় তাহলে আবার আয়ের ওপর অর্থাৎ ‘ইনকামের’ ওপর কর কেন? এই সমস্যাটা দেশবাসী বোঝে না। উভয়দিক থেকেই কর। বলা হবে সারা বিশ্বেরই এই ব্যবস্থা। বিশ্বের সঙ্গে তুলনা করলে কিছু বলার থাকে না। কিন্তু তাহলে বিশ্বের মতো অন্যান্য ব্যবস্থাও দরকার। যুক্তরাষ্ট্রে যদি দশ হাজার ডলার আয় করমুক্ত হয় তাহলে আমাদের করমুক্ত আয় ৮ লাখ টাকা কেন হবে না? ওই দেশে শুনেছি চিকিৎসা, বেকার ভাতাসহ নানাবিধ সুবিধা নাগরিকরা পায়। তাহলে আমাদের দেশে কেন তা আমরা পাব না? প্রতিবেশী ভারতে ‘সিনিয়র সিটিজেনরা’ ওষুধে, বিমান ভাড়ায়, রেলভাড়ায় রেয়াত পায়। আমরা তা পাব না কেন? এমন অনেক প্রশ্ন। আমাদের যার যার সুবিধামতো উদাহরণ দিয়ে কার্যসিদ্ধি করার একটা প্রবণতা আছে। এটা কাম্য নয়? কর ব্যবস্থাকে পরিপালনযোগ্য করা দরকার। যাতে সবাই ‘কমপ্লায়েন্ট’ নাগরিক হতে পারে। মাসে ২০ হাজার টাকা আয় হলেই যদি কর দিতে হয় তাহলে কোটি কোটি লোককে হতে হবে করদাতা। এটা কী বাস্তব? এমতাবস্থায় আগামী বাজেটে করমুক্ত আয়সীমাকে ১০-২০-২৫ বছরের জন্য বাস্তবসম্মতভাবে নির্ধারণ করে দেয়ার জন্য সুপারিশ করছি। আর ‘ভ্যাটের’ হারকে সহনশীল রাখতে অনুরোধ করছি। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×