ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গোধূলিবেলায় অনিকেত সন্ধ্যা

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ৪ মে ২০১৭

গোধূলিবেলায় অনিকেত সন্ধ্যা

অপূর্ব কুমার কুণ্ডু ॥ গাছে ফুল ফুটলে অনুরাগী পথিক সে ফুল ছিঁড়ে নিয়ে চলে যায়। মাটি নিড়ানি দিয়ে, বীজ বপন করে, নিয়মিত পরিচর্যায় যে মালি গাছে ফুল ফোটাল সেই মালির কথা কিংবা ব্যথা একবারও কি অনুরাগী পথিকের মন ছুঁয়ে যায়! অনেকটা তেমনিভাবে সারাজীবন ধরে ইটের পর ইট ফেলে, রক্তস্নাত ঘাম ঝরিয়ে যে মানুষটি তার গৃহনির্মাণ করল, বাড়ি বানাল সেই মানুষটিকেই যখন বার্ধক্যের বেলা শেষে দৈন্য-অথর্ব- নিঃসঙ্গবস্থায় গৃহ থেকে টেনে হিঁছড়ে বৃদ্ধাশ্রমে নেয়া হয়, এতটুকু সেবা দেয়ার মতো আপনার বলতে আপনজন কেউ পাশে সেই তখন তো সেই মানুষটির সান্ত¡না পাবার মতো কোন জায়গা নেই। বার্ধক্য বেলার অক্ষমতা, আপনজনের অসহায়তা আর নিয়তির মতো বাস্তবতার মর্মস্পর্শী নাটক অনিকেত সন্ধ্যা। কিন্তু লক্ষভেদী নাট্যকার চন্দন সেন রচিত, ক্রতিহ্য আশ্রয়ী নির্দেশক আরহাম আলো নির্দেশিত, বহুবচনের ২৪তম প্রযোজিত নাটক অনিকেত সন্ধ্যার উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হলো গত ২৯ এপ্রিল মহিলা সমিতি মঞ্চে। জীবন মঞ্চে অভিনয় শেষের অন্তিম বেলায় ৮৭ বছর বয়সী সুরকার-গীতিকার গায়ক মুখার্জি মশাই আজ পরিত্যক্তের মতো পরিত্যক্ত গৃহে আসাড় হয়ে বিছানাশায়ী। গলায় সুর আজ আর নেই, অনুরাগী শ্রোতাও আজ আর আসে না, তাকে সময় দেবার মতো সময়ও হাতে কারও নেই। নাতি প্রিয়তোষ এবং নাতবৌমা মালবিকা বাড়িতে থাকলেও তাদের হাতে তিনি খান না। খান তখনই যখন তার একমাত্র ৬১ বছর বয়সী পুত্র যে কিনা পার্টটাইম লেকচারার এবং স্ত্রী হারিয়ে একা, সেই পুত্র কর্ণদেব গান গেয়ে খাওয়ান। পুত্রের অবর্তমানে দাদুকে নিয়ে নাতি-নাতবৌয়ের অশান্তি, দাদুর পাশে থাকতে যেয়ে নাতির চাকরির প্রমোশন নিয়ে দূরে না যেতে পারা, চতুর্থ জেনারেশনের আগমনে গৃহে ঘরের স্বল্পতা এবং সর্বোপরি মানসিক চাপমুক্ত হতে নাতি-নাতবৌ সিদ্ধান্ত নেয় এবং দিন ধার্য করে মুখার্জি মশাইকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবার। সার্বিক বিবেচনায় পুত্র কর্ণদেব আত্মশ্লাঘায় ভোগে, শতায়ু হবার এই শুভ আশীর্বাদ মানুষ মানুষকে কেন করে! অপরদিকে কর্ণদেবের আশৈশব বন্ধু যাত্রার অভিনেতা নটরাজ কালিদাস যে একসময় সিরাজ-উদ্দৌলা, আওরঙ্গজের প্রভৃতি চরিত্র করে মানুষকে মাতিয়েছে, যে সন্তানকে চাকরি পাইয়ে-বিয়ে দিয়ে মঞ্চ এবং সংসার উভয় স্থান থেকে বিতাড়িত সেই কালিদাস চায় বাঁচতে, আরও বাঁচতে, তার ভয় সে মারা গেলে তাকে মুখাগ্নী করার মতো যে কেউ নেই। নেই আর আছির মাঝে দাঁড়িয়ে গাড়ি আসে, মুখার্জি মশাইকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয়। বাবা মুখার্জি মশাইয়ের বৃদ্ধাশ্রমের সহযাত্রী হয় পুত্র কর্ণদেব। চার পুরুষের উপস্থিতিতে পুত্র কর্ণদেবের মরমীয় উক্তি, ‘আপনি তো আপনার ছেলেকে নিয়ে চললেন কিন্তু আমার ছেলে যে রয়ে গেল’ এবং হাতে স্যুটকেস এবং কাঁধে বাবাকে চড়িয়ে টলতে টলতে এবং ‘কত বড় বোঝা যে আমার কাঁধে চাপাল...’ বলতে বলতে বাবা-ছেলের গৃহ ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে যাবার মধ্যে দিয়ে শেষ হয় সন্ধ্যা নামার আগের নাটক অনিকেত সন্ধ্যা। সন্ধ্যা উতরে রাত যত গভীর হয় ততই শব্দ দূষণ কমে আর পরিণত ভাবনার জন্য ছেলেমানুষী থামে। ফলে যা চকচকে সেট-লাইট-ডিজাইন আর কোরিওগ্রাফির বিপরীতে নির্দেশক আরহাম আলো’র নির্ভরতা জোড়াল টেক্সট এবং নান্দনিক অভিনয়ে। মঞ্চের মাঝে ত্রিভূজের মতো কাল্পনিক রেখার শীর্ষত্রয়ে সিম্পল সেট বসিয়ে লাইটের জোন ভাগ করে পুরো নাটকটা দৃশ্যের অদল-বদল ঘটিয়ে নাট্য উপস্থাপনা ভাববার। সেট ও আলোক পরিকল্পক হেন্ডরী সেন নির্দেশকের যোগ্য সহকারী। মনু মাসুদ আবহ সঙ্গীত নির্মাণে ধ্রুপদী তবে কিছু ক্ষেত্রে সুর প্রধানের পাশাপাশি কথা প্রধানে কিভাবে কথাকে স্পস্ট করা যায় তা ভেবে দেখা দরকার। দরকার বেশি কিংবা কম সেটি বড় কথা না বড় কথা হলো প্রতিটি চরিত্রেরই রূপদানে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিমগ্নতা। এই নিমগ্নতা ছিল প্রযোজনার পুরোটাজুড়ে। পাপ্পু চরিত্রে শিশু শিল্পী নূর রোহানের ইংরেজী সুরে বাংলা উচ্চারণ এবং চঞ্চল অভিব্যক্তি আনন্দের। ভৃত্য অর্জুন চরিত্রে সাহিত্য এর কায়িক পরিশ্রম ও স্বর প্রক্ষেপণ দৃষ্টি কাড়ে। তবে অদূর ভবিষ্যত এ পাকামো যেন তাকে ঘিরে না ধরে সেটি প্রযোজনার স্বার্থেই বিবেচ্য। মালবিকা চরিত্রে রুমানা স্মার্ট এবং যৌতিক। কালিদাস নাহা চরিত্রে মনু মাসুদ তুরুপের তাস। ম্যাচ জিতিয়ে নেয়ার জন্যে তার পোড় খাওয়া অভিজ্ঞতা এবং অভিজ্ঞতাকে নিংড়ে অভিনয় মনে দাগ কাটে। তবে শুধু কাণ্ঠস্বর আর মুখ থেকে শব্দ প্রক্ষেপণ তার চরিত্রের একমাত্র চাওয়া না। সংলাপ প্রক্ষেপণে নাভিমূল থেকে বাতাস নিয়ন্ত্রিত হয়ে সংলাপ চৌদিকে ছড়িয়ে যাবার দাবি, তার সংলাপ তার কাছে রাখে। বুকের উপর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্যারালাইজড হাত রেখে, এক চেয়ারে সার্বক্ষণিক বসে এবং সহস্র সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করে ভঙ্গুর শব্দ উচ্চরণে মুখার্জি মশাই চরিত্রে অভিনেতা আরহাম আলো নক্ষত্র খোঁচিত রাতের আলো। আলো-আঁধারির দোলাচলে পথ না হারিয়ে বাবাকে পুত্র হয়ে পথ চেনানো এবং নিজ পুত্রদের আত্মবিস্মরণের হাত থেকে সুরক্ষা দেয়ার সুরক্ষদাতা কর্ণদেব চরিত্রে অভিনেতা তৌফিকুর রহমান ব্যক্তিজীবনে কর্তব্য পরায়নের মতো মঞ্চাভিনয়ে নান্দনিকতার সঙ্গে অনন্য। অনন্য সহমর্মীতায় অজ্ঞতাবশত জমে যাওয়া মনের মলিনতাকে আনন্দশ্রু দিয়ে ধৌত করে দেয় নাটক অনিকেত সন্ধ্যা।
×