ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা থাকবে ৬ কিমি দীর্ঘ এই সড়কে

এবার রাজধানীতে তৈরি হচ্ছে ডিজিটাল সবুজ সড়ক

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৪ মে ২০১৭

এবার রাজধানীতে তৈরি হচ্ছে ডিজিটাল সবুজ সড়ক

মশিউর রহমান খান ॥ রাজধানীতে দেশের প্রথম সবুজে ঘেরা প্রযুক্তি সম্পন্ন ‘ডিজিটাল সবুজ সড়ক’ তৈরি করছে সরকার। আধুনিক সকল প্রকার সুবিধাসম্পন্ন এ সড়কটির দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৬ কিলোমিটার। বিশেষ সুবিধাসম্পন্ন এ রাস্তাটির পাশ দিয়ে চলাচল করলে সার্বিক দৃশ্য দেখে কোনভাবেই রাজধানী ঢাকার কোন রাস্তায় চলাচল করছেন কি না, তা চেনা যাবে না। বিমানবন্দর থেকে নেমে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদেশীদের সুন্দর ধারণা দিতে রাজধানীর বনানী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত চিরচেনা সড়কের বাইরে এ সড়কটি নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর। সড়কটির আধুনিকায়নের কাজ করছে ‘ভিনাইল ওয়ার্ল্ড’ নামের একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি নির্মাণ পরবর্তী দশ বছর ব্যবস্থাপনায় থাকবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯০ কোটি টাকা। তবে এ জন্য সরকারকে কোন অর্থ ব্যয় করতে হবে না। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে এই অর্থ তুলে নেবে। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া এ সড়ক আধুনিকায়ন প্রকল্পের কাজ চলতি বছরের ডিসেম্বরের আগে যে কোন সময় শেষ করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। নির্মাণের পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আধুনিক সুবিধা সংবলিত ডিজিটাল সড়কের দুই পাশের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিজিটাল সুবিধাসম্পন্ন এ সড়কের ওপর দিয়ে চলাচলকারী নাগরিকদের সুবিধার্থে ডিজিটাল যাত্রী ছাউনি, ডিজিটাল ডাস্টবিন বক্স, দেশের সকল সংবাদ শিরোনাম জানতে বসানো হবে সড়কের বিভিন্ন স্থানে এলইডি মনিটর। ইন্টারনেটের জন্য ফ্রি-ওয়াই-ফাই সংযোগ, ২৪ ঘণ্টা নিরাপদে চলাচলের জন্য পুরো রাস্তায় বসানো হবে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা, আধুনিক টয়লেট, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সুবিধাসহ যাত্রী ছাউনি থাকবে। এছাড়া ছোট শিশুর মায়েদের সুবিধার্থে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার, কৃত্রিম ঝর্ণা, আলোর খেলা, বাহারি মাছের লেক, ক্যাফে ও নামাজের স্থান, সড়কের দুই পাশে ছোট ছোট ফুলের বাগান, থাকবে। এর বাইরে উন্নত বিশ্বের মতো কয়েন দিয়ে হালকা ও ভারি খাবার কেনার ব্যবস্থা, মোবাইল ফোন রিচার্জ ও মোবাইল টপ-আপসহ যে কোন সময় টাকা উত্তোলনের জন্য এটিএম বুথ সেবা প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে। বর্তমানে বনানী-বিমানবন্দর সড়কটিতে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আন্দোলন-সংগ্রামের বিভিন্ন ঘটনার ম্যুরাল স্থাপিত রয়েছে। এসব ম্যুরাল অক্ষত রেখেই সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, এয়ারপোর্ট থেকে বনানী পর্যন্ত রোডে চলাচলকারী প্রায় ৫ হাজার মানুষ ওয়াই-ফাইয়ের মাধ্যমে বিনামূল্যের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। পথচারীর সার্বিক নিরাপত্তার জন্য পুরো রাস্তাটি ১ হাজার ৫০০ ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার আওতায় থাকবে। রাস্তার সকল কর্মকা- মনিটর করতে বিশেষ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র তৈরি করা হবে। এ ছাড়া ৬ কিলোমিটার রাস্তায় মোট ১২টি যাত্রী ছাউনি তৈরি করা হবে। এসব যাত্রী ছাউনির প্রতিটিতে থাকবে নারী ও পুরুষের জন্য পৃথক আধুনিক টয়লেট। থাকবে মায়েদের সুবিধার্থে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার। থাকবে বাহারি আলোর হাতিরঝিলের মতো একটি ফাউন্টেইন। এতে বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানের ছবি পানির মধ্যেই ভেসে উঠবে। যা পথচারীগণ দেখতে পাবেন। রাস্তার ফুটপাথে প্রতিবন্ধী ও বাচ্চাদের ট্রলি টানার আলাদা লেন, চলার পথে ক্লান্ত হয়ে গেলে বিশ্রাম নিতে তৈরি করা হচ্ছে গার্ডেন বেঞ্চ, এছাড়া হাঁটার জন্য থাকবে আলাদা লেন। মাঝে মাঝে থাকবে ফুলের ছোট ছোট সুন্দর বাগান। রাস্তার সৌন্দর্যবর্ধন করতে তৈরি করা হবে কৃত্রিম ঝর্ণা। সন্ধ্যার পর রাস্তাটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে থাকবে লাল-নীল বাহারি রঙের আলোর খেলা, এ্যাকুরিয়ামের মতো বাহারি মাছের লেকসহ নান্দনিক দৃশ্য তৈরির কাজ করা হবে। সড়কটিতে বাইসাইকেল চালানোর জন্য থাকবে আলাদা লেন, রোডটির খিলক্ষেতের নিকুঞ্জ লেকে শিশুদের জন্য পার্ক তৈরি হচ্ছে। এ পার্কটিতে এলাকার শিশুরা খেলাধুলা করতে পারবে বলে জানা গেছে। আধুনিক এ সড়কটিতে সুপ্রশস্ত দৃষ্টিনন্দন ফুটপাথ ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। সারা রাত রাস্তায় স্বচ্ছ আলোর এলইডি বাতির ব্যবস্থা করা হবে। এ ছাড়া রাস্তায় বের হওয়ার পর আবহাওয়ার খবর জানার ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়া থাকবে ডিজিটাল ডাস্টবিন বক্স। যেখানে ময়লা ফেললেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা চলে যাবে নিচে। যাত্রী ছাউনিতে ডিজিটাল বোর্ড থাকবে। বোর্ডে সিটিতে চলাচলকারী গণপরিবহনের কোন বাস কোথায় যাবে ও কখন থামবে তার সময়সহ যাত্রীর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নির্দেশনা দেয়া থাকবে। দীর্ঘ এ ছয় কিলোমিটার সড়কে ডিজিটাল প্রযুক্তির পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব গাছ, স্বল্প আকারের চা-বাগান তৈরি করা হবে। এছাড়া আধুনিক বিভিন্ন জাতের ফুল ও ফলের গাছ লাগানো হবে। সড়কটির সব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে ইতোমধ্যে বনানীতে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি কুড়িলে একটি সাব-কন্ট্রোল রুম ও অভিযোগ কেন্দ্র তৈরি করা হবে। ৩০ জন গার্ড সড়কটির দেখভালের দায়িত্বে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকবে। ১ হাজার ৫০০ সিসি ক্যামেরায় পুরো সড়ক তদারকির করা হবে। ফলে যে কোন ঘটনা বা দুর্ঘটনাই কর্তৃপক্ষের নখদর্পণে থাকবে। সরেজমিনে দেখা যায়, কুড়িল, শেওড়া, কাওলা, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও বিমানবন্দরসহ কয়েকটি এলাকায় ১২টি যাত্রী ছাউনি নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। যাত্রী ছাউনি থাকছে ক্যাফে ও নামাজের স্থানের পাশে। পথচারীদের জরুরী প্রয়োজনে মোবাইল ফোন রিচার্জ ও মোবাইল টপ-আপসহ এটিএম বুথ সেবার জন্য বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথ তৈরি করা হবে। দীর্ঘ এ ছয় কিলোমিটার সড়কে ডিজিটাল প্রযুক্তির পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব গাছ লাগিয়ে সবুজ ঢাকা তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। এ জন্য দেশীসহ বিশ্বের আধুনিক বিভিন্ন জাতের ফুল ও ফলের গাছ লাগানোর কাজ চলছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, সারা বছরই ফুল ও ফলের সমারোহ থাকবে এখানে। এ ছাড়াও সড়কের বিভিন্ন এলাকায় ১২টি কৃত্রিম ঝর্ণা বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। মূলত এ সড়কটি হবে পথচারীবান্ধব। ফুটপাথে প্রতিবন্ধী ও বাচ্চাদের ট্রলি টানার আলাদা লেন থাকবে। চলতে গিয়ে ক্লান্ত পথিক বিশ্রাম নিতে পারবেন। এ জন্য বসানো হচ্ছে ১৫০টি গার্ডেন বেঞ্চ। এছাড়া সড়কটির পাশে বেশ কয়েক জায়গায় ফুলের ছোট বাগান, কৃত্রিম ঝর্ণা, আলোর খেলা, বাহারি মাছের লেকসহ নান্দনিক দৃশ্য তৈরির কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। সড়কের দুই পাশে কয়েকটি ঝর্ণা বসানো হয়েছে, যা থেকে পাহাড়ী ঝর্ণার মতো পানি ঝরতে থাকবে। বিমানবন্দর থেকে নিকুঞ্জ পর্যন্ত বাইসাইকেল চালানোর জন্য আলাদা লেন করা হয়েছে। নিকুঞ্জ লেকে করা হচ্ছে শিশুদের পার্ক। সড়কটির বিভিন্ন জায়গায় এলইডি মনিটর বসানো হবে, যার মাধ্যমে জানা যাবে দেশে কোথায় কী হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশের ক্রিকেট, ফুটবলসহ বিভিন্ন খেলার খবর ও বিভিন্ন লাইভ অনুষ্ঠান দেখা যাবে ও আবহাওয়ার খবর জানা যাবে। ছয় কিলোমিটার সড়কজুড়েই থাকবে সুপ্রশস্ত দৃষ্টিনন্দন পুটপাথ ওয়াকওয়ে। সাদা এলইডি ফোকাসিং করা লাইটের এমন ব্যবহার এই প্রথম দেশের কোন সড়কে করা হচ্ছে। ফলে পুরো ওয়াকওয়ে সারা রাত আলোকিত থাকবে। বনানী থেকে বিমানবন্দর এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, শ্রমিকরা দিন-রাত নিবিড়ভাবে কাজ করছেন। ইতোমধ্যে লোহার শিকল ঝালাই করে ফুটপাথে বেষ্টনী তৈরি করা হচ্ছে। ফুটপাথের নির্ধারিত স্থানে ইট-পাথরের সুড়কি দিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা আলপনা। সড়কের ‘সড়ক বাতি’ বদলে এলইডি বাতি লাগানো হচ্ছে। হোটেল রেডিসনের সামনে একটি ঝর্ণা ও ২০০ মিটার হাঁটার রাস্তার নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এখানে রয়েছে একটি ঝর্ণা। ঝর্ণার পানিতে খেলছে বিভিন্ন রঙের মাছ। মূলত সড়কটির পুরো নির্মাণকাজ শেষ হলে এ সড়কটি হবে ডিজিটাল সড়কের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপথ অধিদফতরের ঢাকা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ সবুজ উদ্দিন খান জনকণ্ঠকে বলেন, দেশে সড়ক ব্যবস্থায় আধুনিকায়নের জন্য এই প্রথম রাজধানীর এয়ারপোর্ট থেকে বনানী পর্যন্ত উন্নত বিশ্বের আদলে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি তৈরির কাজ চলছে। সরকার ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশের অংশ হিসেবে এ সড়কটি উন্নত বিশ্বের মতো একটি আধুনিক পথচারীবান্ধব ডিজিটাল সড়ক হিসেবে নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া এ সড়কের আধুনিকায়নের প্রকল্পটির কাজ চলতি বছরের ডিসেম্বরের আগে যে কোন সময়ে শেষ করা হবে। তিনি বলেন, রাস্তায় পথচারীদের সুবিধার্থে ইন্টারনেট সংযোগ পেতে ফ্রি ওয়াই-ফাই, সর্বাধুনিক যাত্রী ছাউনি, আলাদা হাঁটার ও সাইকেল লেন, কৃত্রিম ঝর্ণা ও লেক, সন্ধ্যার পর বাহারি আলোর খেলা দেখার ব্যবস্থা, শিশুপার্ক, দেশী- বিদেশী ফুলের বাগান, ডিজিটাল তথ্য বোর্ড, বিশ্রাম নিতে গার্ডেন বেঞ্চের ব্যবস্থা থাকবে। রাস্তার দুই ধারে ফুলের বাগানসহ নানা ধরনের সবুজ দেশী-বিদেশী বৃক্ষ লাগানো হচ্ছে। ইতোমধ্যেই বড় আকৃতির বনসাই লাগানো হয়েছে। এর বাইরে ছোট আকৃতির অনেক বনসাই লাগানো হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে প্রায় ৯০ কোটি টাকা। তবে সরকারকে এ জন্য কোন অর্থ প্রদান করতে হবে না। ভিনাইল ওয়ার্ল্ড নামে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকবে। নির্মাণের পরবর্তী ১০ বছর তারা এটির তত্ত্বাবধায়ন করবেন। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানটি নির্ধারিত স্থানে ওয়াই-ফাই ব্যবহারের মাঝে মাঝেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে নিজেদের বিজ্ঞাপন প্রচার করবে। এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই তাদের ব্যয়িত অর্থ তুলে নেবে। মোট কথা, প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে এটি হবে বাংলাদেশের প্রথম সবুজ ঘেরা ডিজিটাল সড়ক।
×