ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে সেমিনার

বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ্যামনেস্টির রিপোর্ট ॥ তথ্যমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৪ মে ২০১৭

বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ্যামনেস্টির রিপোর্ট ॥ তথ্যমন্ত্রী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাষ্ট্র, গণমাধ্যম ও সাংবাদিক কেউ কারও প্রতিপক্ষ নয়। সরকার গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তারা এমন কোন আইন তৈরি করবে না যাতে মুক্ত গণমাধ্যম বাধাপ্রাপ্ত হয়। বরং আইনের আধুনিকীকরণ ও যুগোপযোগী করে গণমাধ্যমের বিকাশে আরও সহায়তা করা হবে বলে মন্তব্য করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেন, পাকিস্তান আমলে দেশে মুক্ত সাংবাদিকতা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। সে সময় সরকার ও গণমাধ্যম একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসেবে কাজ করেছে। বর্তমানে রাষ্ট্র সাংবাদিকদের কোন কর্মকা- বাধাগ্রস্ত করছে না। এমনকি রাষ্ট্র, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকরাও সাংঘর্ষিক অবস্থায় নেই বলে উল্লেখ করেন। বুধবার বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এসব মন্তব্য করেন। ম্যানেজমেন্ট এ্যান্ড রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এমআরডিআই) ও ফোয়ো মিডিয়া ইনস্টিটিউট, সুইডেনের সহযোগিতায় বাংলাদেশ মুক্ত গণমাধম্যের বর্তমান চিত্র শীর্ষক এই সেমিনারের আয়োজন করা হয় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান। সেমিনারে দেশের গণমাধ্যমের সার্বিক চিত্র নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল। অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে তথ্যমন্ত্রী এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে বলেন, তাদের এ প্রতিবেদন পক্ষপাত ও উদ্দেশ্যমূলক। বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এমন রিপোর্ট তৈরি করেছে। তিনি বলেন এই মুহূর্তে দেশে গণমাধ্যমের প্রতিপক্ষ সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, কালোবাজারি ও মাদক ব্যবসায়ীরা। এটা প্রতিরোধে সরকার ও গণমাধ্যম একযোগে কাজ করছে। জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম সবসময় আপোসহীন থেকেছে। এক্ষেত্রে তারা একচুল ছাড় দেয়নি। তিনি গণমাধ্যম সংক্রান্ত আইনের বিষয় তুলে ধরে বলেন, কোন আইনের মাধ্যমে গণমাধ্যমের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে না। বরং গণমাধ্যমের বিকাশে আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী আইন তৈরির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে মান্ধাতা আমলের আইন বাতিল করা ও পুরনো আইন হালনাগাদ ও যে বিষয়ে এখনও কোন আইন তৈরি করা হয়নি সে বিষয়ে আইন তৈরি করা হচ্ছে। এসব আইন তৈরি করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের বিকাশ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে বেশি নজর দেয়া হবে। তথ্যমন্ত্রী বলেন, তথ্য অধিদফতরে নিবন্ধনের জন্য এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮শ’র বেশি অনলাইন গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে দরখাস্ত জমা পড়েছে। এগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। প্রায় ২ হাজার অনলাইনের মধ্যে মাত্র ৩৫টি অনলাইনের প্রকাশনা বন্ধ রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের উদ্দেশ্যপূর্ণ, মিথ্যা ও উস্কানিমূলক রিপোর্ট প্রকাশের জন্য। সরকারের সমালোচনার জন্য আজ পর্যন্ত একটি অনলাইনও বন্ধ করা হয়নি। দেশে এত অনলাইন কাজ করছে তাতে সরকারের কোন সমস্যা হচ্ছে না। মূলত বিভিন্ন ধর্মের ওপর আঘাত দিয়ে রিপোর্ট প্রকাশের জন্যই এসব অনলাইন বন্ধ করা হয়েছে। এগুলো আমাদের সংবিধান অনুমোদন করে না। তিনি বলেন, এমনকি একটি অনলাইনে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের মৃত্যুর বিষয় নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছিল। দেশে ৪ কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে। এর মধ্যে মাত্র ২০ জনের আইডি স্থগিত করা হয়েছে। এসব আইডি ছিল ভুয়া, মিথ্যা ও ফেক। এছাড়া বিভিন্ন সময় যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তা নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই করা হয়েছে। এটা কোন গণমাধ্যম বা সম্পাদক দমনের জন্য করা হয়নি। একটি পত্রিকায় পবিত্র কাবা শরীফের গিলাফের ছবি দিয়ে মিথ্যা প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য; তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশে ২ হাজার ৮শ’র বেশি পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। এতে হাজার হাজার সাংবাদিক কাজ করছেন। যখনই কোন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে সরকার বা রাষ্ট্র কিন্ত কখনও এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে না। বরং সঠিক ও নিরপেক্ষভাবে বিষয়টি জানার চেষ্টা করছে। কোনভাবেই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দমনমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। শেখ হাসিনার শাসনামলে আজ পর্যন্ত কত সাংবাদিক বিপদে পড়েছেন। সব মিলিয়ে ৫০ জনের বেশি হবে না। তিনি উল্লেখ করেন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে সাইবার জগতের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ দেশে একটি সাইবার জগত গড়ে উঠেছে। কিন্তু সাইবার জগতকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাইবার ক্রাইম। সরকার মিথ্যাচার, ভুয়া তথ্য সরবরাহকারী ও উস্কানিদাতাদের হাত থেকে গণমাধ্যমকে রক্ষার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলে তথ্যমন্ত্রী উল্লেখ করেন। অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশ নিয়ে সমকাল সম্পাদক গোলাম সারোয়ার বলেন, দেশে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়ছে। এটা মোকাবেলা করেই এগিয়ে যেতে হবে। পেশাগত ক্ষেত্রে কোন সাংবাদিককে হত্যা করা হলে বা কেউ নিহত হলে তার বিচার দ্রুত বিচার আইনে করতে হবে। দেশে আইসিটি এ্যাক্টের খারাপ দিক হলো: এ ধারায় জামিন দেয়া যাবে না। বিশ্বের অন্যান্য দেশে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সমালোচনা করা গেলেও এখানে তা আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আদালত অবমাননার আইন নতুন করে লেখা হোক। তিনি বলেন দেশে দ্রুত গণমাধ্যমের বিকাশ ঘটছে। গণমাধ্যমের বিকাশ হওয়া ভাল। কিন্তু শতফুলে সুগন্ধই চাই। দুর্গন্ধ কিছু কিছু ক্ষেত্রে বের হচ্ছে। এটা মেনে নিয়েই চলতে হচ্ছে। সারাবিশ্বেই সাংবাদিকতা পেশাকে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হিসেবে দেখা হয়। এ পেশা সমুন্নত রাখতে ঐক্যবদ্ধভাবেই চেষ্টা করতে হবে। তবে সকলের ওপর হলো দেশের স্বার্থ। দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে কোন আপোস নয়। এ সময় তিনি উল্লেখ করেন, কোন পত্রিকায় কারো বিরুদ্ধে রিপোর্ট প্রকাশ হলে অন্য পত্রিকায় টাকার বিনিময়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে এর প্রতিবাদ জানানো বা এ ধরনের বিজ্ঞাপন ছাপানো উচিত হবে না। বিজ্ঞাপনের দায়দায়িত্বও সম্পাদকদের নিতে হবে। পত্রিকায় সেলফ্ সেন্সরশিপ পরিহার করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে নিজেদের গুটিয়ে রাখার কোন মানে নেই। পত্রিকার নিউজের শিরোনাম স্মার্ট হতে হবে। নিউজ বড় করে পাঠকের ধৈর্যে চ্যুতি না ঘটানোর আহ্বান জানান গোলাম সারোয়ার। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, গণমাধ্যম সংক্রান্ত আইনকানুন যেন গণমাধ্যম সহায়ক হয়। এগুলো যেন কোনভাবেই চাপিয়ে দেয়া বা গণমাধ্যমের নিবর্তনমূলক না হয়। স্বাধীনতার অপব্যবহার রোধেও আইনের প্রয়োজন রয়েছে। সাংবাদিকতার স্থিতিশীলতার জন্য এডিটরিয়াল কাউন্সিল গঠনের কথা বলেন তিনি। ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, সাংবাদিক ইউনিয়ন বা সাংবাদিক সমাজের বিকাশের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। সাংবাদিকদের রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতেই পারে। কিন্তু পেশাগত ক্ষেত্রে দলমতের ওপরে উঠতে হবে। তিনি পুরনো ঐক্য নতুন করে প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান সাংবাদিকদের। বলেন, মুক্ত গণমাধ্যম ও পেশার মর্যাদা রক্ষা করতে হলে পোশাগত দায়িত্ব পালনেও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা থাকতে হবে। কোন কিছু যেন তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া না হয়। তথ্য উপদেষ্টা বলেন, নিয়মিত বেতন না পেলে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা নষ্ট হয়। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, বিভিন্ন সময় সংবাদপত্র সরকারের রোষানলে পড়ছে। এ কারণে সরকার সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন বন্ধের নির্দেশ দিচ্ছে। যখন তিনি একতার সম্পাদক ছিলেন দেশ স্বাধীনের আগে ও পরে একতা পত্রিকা বার বার সরকারের রোষানলে পড়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া ভোরের কাগজের সম্পাদক থাকার সময় ১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকার এবং ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম আলোর বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছিল। বর্তমানও সরকারের চাপ ও ভয়ভীতি থেকে সংবাদপত্র মুক্তি পায়নি। মামলার জামিন নিতে অনেক ঘোরাঘুরি করতে হয়। তিনি বলেন,বর্তমান বিশ্বে সাংবাদিকতার ধরন বদলে যাচ্ছে। অনলাইনের পাঠক বাড়ছে। সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আসছে। এ অবস্থায় প্রত্যেকের উচিত হবে সংবাদপত্রের গুণগত মান বৃদ্ধির দিকে নজর দেয়া। মূল প্রবন্ধে বিএফইউজে সভাপতি মনজুরুল আহ্সান বুলবুল বলেন, গণমাধ্যমের দিক থেকে বাংলাদেশ আংশিক স্বাধীন দেশ। মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষ করে এখন পর্যন্ত গণমাধ্যম সংক্রান্ত অনেক আইন রয়েছে পুরাতন। আবার অনেক ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োজন হলেও এখন পর্যন্ত কোন আইন তৈরি করা হয়নি। সম্প্রচার আইন শেষ করা হয়নি। অনলাইনে সাংবাদিকতার জন্য কোন আইন তৈরি করা হয়নি। কিন্তু সরকার অবাধে লাইসেন্স দিয়ে যাচ্ছে। আবার নতুন যেসব আইন করা হয়েছে তারও অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য নতুন আইন করার আগে সাংঘর্ষিক দিক বিবেচনায় নেয়ার জন্য তিনি আহ্বান জানান। বুলবুল বলেন, দেশে বর্তমানে বড় বড় হাউস তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে সংবাদপত্রকে ব্যবহার করছে। সাংবাদিকদের দুর্নীতির ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের প্রতিষ্ঠানে। বর্তমানে বিজ্ঞাপনদাতারাও বড় প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, কোন কারণ ছাড়াই সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। আর চাকরি চ্যুতির কারণেই অনেক সাংবাদিক নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। আবার বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনেক প্রতিষ্ঠানের সিনিয়রদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। বিএফইউজে সভাপতি বলেন, দেশে সাংবাদিক হত্যার কোন বিচার হয় না। ৪ দশকে এখন পর্যন্ত তিন সাংবাদিক হত্যার বিচার সম্পন্ন করা হয়েছে। এ সময় দেড়ডজন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নিহত হয়েছেন। ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্তের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান, যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম ও ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তাসমীম হোসেন।
×