ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এ বিষয়গুলো সকল দলীয় রাজনীতির উর্ধে নেয়া যেতে পারে - স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ৪ মে ২০১৭

এ বিষয়গুলো সকল দলীয় রাজনীতির উর্ধে নেয়া যেতে পারে - স্বদেশ রায়

দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতির পরিবর্তন এসব কিছুর বাইরে গিয়েও কিছু বিষয় মাঝে মাঝে ভাবিয়ে তোলে। সাংবাদিক। কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই। তাই যে কোন বিষয়ের লিটরেচার পর্যন্ত পড়তে পারি, বুঝতে পারি কিন্তু তার অঙ্কে ঢুকে গেলে অনেক ক্ষেত্রে এগুনো কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। কোন কোন ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। তার পরেও, সাংবাদিক হিসেবে দেশের ওপরে একটা সিংহাবোলকন পড়ে। সব কিছুই চোখে আসে। এ কারণেই বিষয়গুলো ভাবিয়ে তোলে। যেমন ষাটের দশকে উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ হয়। ছোট ছোট বদ্বীপগুলোয় বাঁধ দিয়ে শস্য উৎপাদনের আওতায় আনা হয়। আগে যে শস্য হতো না তা নয়। আগে এক ধরনের বাঁধ ছিল না তাও নয়। তার পরেও সে বাঁধ ও শস্য উৎপাদন পদ্ধতির দিকে খেয়াল না করে বিশেষজ্ঞরা এই বাঁধ নির্মাণ করার মতামত দেয়। সামরিক সরকার সে বাঁধ নির্মাণ করে। এই বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে অনেক নদীতে বাঁধ দিতে হয়েছে। মারা গেছে অনেক নদী। যার ফলে সমুদ্রের পানি এখন যে পলি নিয়ে আসে ওই পলি অল্প কয়েকটি নদীতে রেখেই চলে যায়। ভরে উঠছে নদীগুলো। এর ওপরে খাঁড়ার ঘা ফারাক্কা বাঁধ। ফারাক্কা বাঁধের ফলে এখন মিষ্টি পানি আসে খুবই কম। বছরের বেশি সময় নদীতে লবণ পানি থাকে। যে সব এলাকায় কখনও সমুদ্রের লবণ পানি পৌঁছাত না সেখানেও বছরের বেশি সময় লবণ পানি থাকে। এর ওপরে আবার অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শুরু হয় চিংড়ি চাষ প্রতিযোগিতা। সব মিলে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে যে সুন্দরবন দেখেছি, সুন্দরবন এলাকার দু’পাশ ঘিরে যে উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্র্য দেখেছি তার কিছুই নেই বলা চলে। এর প্রতিকার কি জানা নেই। বিশেষজ্ঞও নই। প্রতিকার কি তাও বলতে পারব না। তবে যারা দেশ চালাচ্ছেন বা যারা দেশের জন্য রাজনীতি করেন তারা এ বিষয়টি নিয়ে ভাবলে একটা পথ নিশ্চয়ই বের হবে। কারণ শুধু সুন্দরবন নয়, গোটা উপকূলীয় এলাকার চরিত্র বদলে যাচ্ছে। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা এক সময়ে এসে পড়বে। তখন এসব এলাকায় কী হবে? সাধারণ মানুষগুলো কোথায় যাবে? তাদের জীবনে কোন ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে? তাদের কি শেষ পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ মাইগ্রেশনের শিকার হতে হবে। অভ্যন্তরীণ মাইগ্রেশনের ফল প্রতিদিন ঢাকার বস্তিতে দেখি। ভারতে গেলে ভারতজুড়ে দেশান্তরীদের দেখি। ইউরোপেও দেখেছি দেশান্তরীদের। সবই সমান মানের দুর্বিষহ। এ জীবন যেন আর কোন একটি পরিবারের জন্য না আসে এই হোক আমাদের রাজনীতির লক্ষ্য- এমনটিই ভাবতে ইচ্ছে করে। কারণ মানুষের হাতে প্রকৃতি, সবটুকু মানুষই নিঃশেষ করে যাবে! এও কি সম্ভব! ভাবতে ভাবতে মনে হয়, এই পলিমাটির দেশে আমরা একের পর এক সেতু তৈরি করে যাচ্ছি পিলার বসিয়ে। তাও একটা-দুটো নয়, অনেক পিলার বসিয়ে আমরা তৈরি করছি সারাদেশে নদীর ওপর এই ব্রিজ। কোন জায়গাতে কোন জনপ্রতিনিধি পদে নির্বাচন করতে গেলেই নদীমাতৃক এই দেশে প্রথম দাবি আসে আমাদের এই নদীটির ওপর একটি ব্রিজ তৈরি করতে হবে। তাই সে সংসদ নির্বাচন হোক আর লোকাল গবর্নমেন্ট নির্বাচন হোক। চলাচলের কারণে অনেক ব্রিজের ওপর চোখ পড়ে। চোখ পড়ে এর তলদেশে। কোন কোন ব্রিজের তলদেশে এখন আর গ্রীষ্মকালে পানিই থাকে না। পলি আর বালু জমে উঠেছে। যারা এতদিন ‘এক নদী বিশ ক্রোশ’ এই ভাবনা থেকে এই ব্রিজের দাবি করতেন তারা এখন আর গ্রীষ্মকালে কষ্ট করে ব্রিজে ওঠেন না- হেঁটে বা সাইকেলে, স্কুটারে ওই শুকনো নদীর ওপর দিয়ে চলে যান। ছোট ছোট এমনি কত শত নদী সারাদেশে ব্রিজের কারণে পলি জমে মরে গেছে তারও কোন সঠিক হিসাব আছে বলে মনে হয় না। উন্নয়নের জন্য ব্রিজ দরকার, আবার নদীকেও তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এর জন্য কী দরকার তা ভাল জানেন বিশেষজ্ঞগণ। তবে সারাক্ষণ এসব নদীতে কি ড্রেজিং মেশিন বসিয়ে রাখা উচিত নয়? কারণ ওই নৌপথ শুধু প্রকৃতি রক্ষার জন্য নয়, উন্নয়নের জন্যও দরকার ছিল। ব্রিজের ধারণক্ষমতার থেকে লক্ষগুণ ধারণক্ষমতা নৌপথের। অথচ নদী ড্রেজিংয়ে সত্যিকার অর্থে আমাদের মন আছে বলে মনে হয় না। নইলে প্রতিদিন এত নদী মারা যাচ্ছে, কই এ নিয়ে তেমন যন্ত্রণা রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার মধ্যে লক্ষ্য করি না। এ মুহূর্তে লক্ষ্য করা যাচ্ছে একটি তীব্র যন্ত্রণা হাওড় এলাকা নিয়ে। তাও হাওড় নিয়ে নয়- ফসল নিয়ে। প্রকৃতির এই হাওড়ে বাঁধ দেয়া হয়েছে। কতটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে এ বাঁধ দেয়া হয়েছে? সব স্থানে ফসল হিসেবে ধানই উৎপাদন করতে হবে তা কি ঠিক? মাছও অনেক বড় কৃষি ফসল। ধান আর মাছ যদি এক সঙ্গে হয় তো ভাল। একজন নগণ্য সাংবাদিক হিসেবে কোথায় যেন মনে হয়, হাওড় এলাকার এই প্রকৃতিকে বদলে দিয়ে আসলে কি ঠিক কাজটি করা হচ্ছে? এও কি উপকূলীয় এলাকার মতো এক সর্বনাশা খেলা নয়? আশু লাভ হচ্ছে, ধান হচ্ছে, জীবনযাত্রা সহজ হচ্ছে- এ সবই ঠিক আছে। তবে আমরা হয়ত আর কিছু দিন বাঁচব। অন্যদিকে ভূগোল বাঁচবে কোটি কোটি বছর। তাই রাজনীতির নামে, ফসলের নামে, আমাদের জীবদ্দশার ভেতরই কিছু করতে হবে, এই মানসিকতা নিয়ে আমরা যে ভূগোল নিয়ে নয় ছয় করি এটা কি ঠিক? ভূ-প্রকৃতির ওপর হাত দেয়ার আগে অনেক বিবেচনার কি প্রয়োজন নয়। শুধু রাজনৈতিক কারণে ভূগোল নিয়ে নয় ছয় করেই সারা পৃথিবীতে কত কোটি কোটি মানুষ প্রাণ দিয়েছে, এখনও প্রাণ দিচ্ছে। আমাদের ভূগোলেও প্রাণ দিয়েছে- সবখানে উদ্বাস্তু হয়েছে– এগুলো বিবেচনায় নেয়া দরকার। এ লেখায় আগেই লিখেছি প্রকৃতি নড়েচড়ে বসলে তার কারণে যে অভ্যন্তরীণ মাইগ্রেশন হয় তা ভয়াবহ। তাকে সাধারণ কোন ঘটনা ভাবার কোন কারণ নেই। হাওড়ে যে বোরো ধান হয় এই একই বোরো চাষ হচ্ছে উত্তরবঙ্গে, আমাদের কৃষিমন্ত্রী এই বোরোকে দক্ষিণবঙ্গে শিফট করতে চাচ্ছেন। তাঁর কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। জানি না কবে তিনি এ কাজ শেষ করতে পারবেন। সাধারণ একজন ক্ষুদ্র সাংবাদিক হিসেবে যখন উত্তরবঙ্গের মাটির নিচ থেকে হাজার হাজার কোটি গ্যালন পানি তুলতে দেখি তখন ভীত হই। কারণ, এমনিতে ফারাক্কার কারণে উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় নীরব মরুকরণ শুরু হয়েছে। দিনে দিনে বাড়ছে মরা পদ্মার দৈর্ঘ্য। তিস্তায় পানি নেই, পানি পাওয়ার ক্ষেত্রে দেশের ভেতর ঘষেটি বেগম আর দেশের বাইরে মমতা ব্যানার্জী। তার ফলে উত্তরবঙ্গে আরও বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে এই মরুকরণ। এই সময়ে যদি প্রতিটি শুষ্ক মৌসুমে এভাবে মাটির নিচ থেকে পানি তোলা হয়, তাহলে কোন্ ধরনের ভবিষ্যত আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে! এক্ষেত্রে ধন্যবাদ কৃষিমন্ত্রীকে। তিনি এই ভূগর্ভস্থ পানি যাতে না তুলতে হয় সে জন্য উত্তরবঙ্গে ফসল হিসেবে গম ও ভুট্টা নিয়ে যেতে চাচ্ছেন। দক্ষিণবঙ্গে বর্ষার সময় নদীতে আসা মিষ্টি পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে চান তিনি। যার ফলে ওই পানি দিয়ে দক্ষিণবঙ্গে বোরো চাষ সম্ভব হবে। এ কাজ বাংলাদেশকে করতেই হবে। কারণ একদিকে যেমন উত্তরবঙ্গের মরুকরণ ঠেকাতে হবে, অন্যদিকে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বোরো চাষও কোন মতে কমানো যাবে না। বরং সেটা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল অবধি নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। শুধু এই বোরোর জন্য নয়, বর্ষাকালের মিষ্টি পানি যদি ধরে রাখা সম্ভব হয় তাহলে শুধু বোরো উৎপাদন নয়, পানি রফতানিকারক দেশ হিসেবে আমরা এক সময়ে অনেক তেল রফতানিকারক দেশের থেকে বেশি রফতানি আয়ও সম্ভব করতে পারি। এ কাজগুলো সব দলীয় রাজনীতির উর্ধে তুলে আনা প্রয়োজন। এখানে বিদেশী অর্থায়নে আবার কেউ পরিবেশের বা অন্য কোন এনজিও যেন না খোলেন। ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধার বা কিছু আয়-রোজগারের জন্য বিষয়গুলোকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত না করলে সেটাই হবে দেশের জন্য মঙ্গল। দেশের বিশাল এসব বিষয় নিয়ে মত দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করা অনেক দুঃসাধ্য, কেবলই যে ভাবনাগুলো নাড়া দেয় তাই সকলের সঙ্গে শেয়ার করা মাত্র।
×