ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবার নিয়ে হিমশিম

অতিবর্ষণ আর পাহাড়ী ঢলে আলমের স্বপ্ন ভেসে গেছে

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৩ মে ২০১৭

অতিবর্ষণ আর পাহাড়ী ঢলে আলমের স্বপ্ন ভেসে গেছে

রাজন ভট্টাচার্য, হাওড়াঞ্চল থেকে ফিরে ॥ নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের ‘তেঁতুলিয়া’ ইউনিয়নের ‘তেঁতুলিয়া’ গ্রামের বাসিন্দা আলম মিয়া। ভূমিহীন কৃষক। টাকার বিনিময়ে অল্প সময়ের জন্য অন্যের জমি চাষের বন্দোবস্ত নেন। এই জমির ধান দিয়ে সচল থাকে তার সংসারের চাকা। বছরের খাবার, সংসার চালানো থেকে শুরু করে মেয়েদের পড়াশোনা সবকিছুই এক ফসলের ওপর নির্ভর। প্রকৃতি আর জীবন সংগ্রামে কেটেছে জীবনের প্রায় ৫৫টি বছর। তবুও সুখে-দুঃখে কোনরকম চলছিল সংসারের চাকা। কিন্তু হঠাৎই যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। জমিতে ভাল ফলনের জন্য রাতদিন পরিশ্রম করছিলেন। অর্থের অভাব। তাই সেচ দেয়া, ধান লাগানো থেকে শুরু করে সবকিছুই করেছেন নিজ হাতে। ঘরে ধান উঠবে। তাই সবুজ ছাপিয়ে সোনাধান সোনালি হবার অপেক্ষা। ঠিক এই মুহূর্তেই অকাল দুর্যোগের শুরু। অতিবর্ষণ আর উজান থেকে আসা পাহাড়ী ঢলে চোখের সামনে ভাসিয়ে নিয়ে গেল আলমের স্বপ্ন। ডুবে গেল এই দরিদ্র কৃষকের ৩০ কাঠা ধানের জমি! এখন কি হবে? গরিব এই কৃষক পরিবারের। তার চোখের সামনে এখন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত। দিশাহারা আলম এখন কাজের সন্ধানে ছুটছেন বারবাড়ি। এলাকার সব মানুষই তার মতো ফসল হারিয়ে এখন নিঃস্ব। কারো হাতে অর্থ নেই। নেই কাজও। হাওড়ে মাছও নেই। বিকল্প আয়ের উৎসও উবে গেছে। এখন কেমন আছেন আলম মিয়া। তার খবর জানতে হাওড় অঞ্চলে ছুটে চলা। ছুটতে ছুটতে দুর্গত এলাকার হাজারো আলমের মধ্যে একজন অতি অসহায় আলমের সঙ্গে দেখা। ডিঙ্গাপোতা হাওড়ের পারে তার বাড়ি। মোহনগঞ্জ উপজেলার শস্যভা-ার হিসেবে পরিচিত হাওড়টি। উপজেলার সবচেয়ে বেশি ধান হয় এই হাওড়ের জমিতে। স্থানীয় কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, ডিঙ্গাপোতায় জমির পরিমাণ সাড়ে ছয় হাজার হেক্টর। উপজেলায় মোট আবাদ হয় ১৬ হাজার ৮২০ হেক্টর জমি। এর মধ্যে ১৪ হাজার হেক্টর ফসলি জমি এখন পানির নিচে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ২৩ হাজার ৮০০। তাদের মধ্যে আলম একজন। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, হাওড়টি রক্ষার জন্য ২৯ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অংশ হিসেবে পরিচিত গাগলাজুর বাজার থেকে দেড় কিলোমিটার উত্তরে জালালেরকুড় পর্যন্ত। যতবার বাঁধ ভেঙ্গেছে ততবার এই অংশ দিয়েই তলিয়েছে কৃষকের স্বপ্নের ফসল। এবারও বাঁধটি রক্ষায় কাজ করেছেন হাওড়ের দু’পারের হাজার হাজার মানুষ। শেষ মুহূর্তে বাঁধ রক্ষায় যোগ দিয়েছিলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সাধারণ কৃষক-শ্রমিক ও লোকজন। অনেকের মধ্যে ছিলেন কৃষক আলমও। বাঁধ রক্ষায় রাতদিনের প্রাণান্ত চেষ্টায় তিনিও শামিল হয়েছিলেন। কিন্তু সবার চেষ্টাই বৃথা। ফসলের শেষ রক্ষা হয়নি। আলমের পরিবারে স্ত্রীসহ ছয় মেয়ে। আটজনের সংসার। তিনি কৃষি মৌসুমে বোরো আবাদ করেন। জীবিকার প্রয়োজনে বর্ষায় মাছ ধরেন। ডিঙ্গাপোতা হাওড়ের তেঁতুলিয়া ঘাটে দেখা হয় তার সঙ্গে। বিষণœ মন। একা বসেছিলেন। কথা বলতে বলতেই জানা গেল তার জীবনের করুণ গল্পের কথা। অবলীলায় বললেন সবকিছু। কারণ, উপায়হীন তিনি। এ বছর কাঠাপ্রতি ৬শ’ টাকা দরে ৩০ কাঠা জমি এক ফসলের জন্য কিনে চাষ করেন তিনি। টাকা দিতে হয়েছিল অগ্রিম। স্থানীয়ভাবে এটাই নিয়ম। ফসল হোক আর না হোক জমি ‘জমা’ নিতে গেলে টাকা অগ্রিম। বন্ধকি জমির জন্য ১৮ হাজার টাকা ছাড়াও জমি চাষে ব্যয় হয় আরও ২৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার ব্যয় হয় তার। খরচা যোগাতে স্থানীয়দের কাছ থেকে ধারদেনাসহ ব্যাংক ও আশা সমিতি থেকে ঋণ নেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার। পাহাড়ী ঢলের কারণে সৃষ্ট অকালবন্যায় অনেকের মতো তারও পুরো জমিই তলিয়ে গেছে। পুড়েছে কপাল। এক ছটাক ধানও গোলায় ওঠেনি। আলম মিয়ার পরিবারের মাসে অন্তত ৯০ কেজি চাল লাগে। দিনে তিন কেজি। এছাড়া দৈনন্দিন হাটবাজারের খরচ তো আছেই। ভিজিএফ তালিকাভুক্ত হওয়ায় মাসে ৩০ কেজি চাল পাবেন তিনি। বাকি ৬০ কেজি সংগ্রহ করতে হবে নিজ উদ্যোগে। কিন্তু হাতে কোন টাকা নেই আলমের। অন্যান্য সময়ে বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরে সংসার চালাতেন। এবার হাওড়ের মাছ পানি দূষণের কারণে মরে গেছে। কয়েকদিন হাওড়ে গিয়ে খালি হাতে ফিরে এসেছেন। তিনি জানান, অভাব তার মাত্রা ছাড়িয়েছে। জীবনে আর কখনও এমন বাস্তবতা আসেনি। অভাবের কারণে চম্পা ও ঝরনা নামে দুই মেয়েকে মেয়েজামাইয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। তারা দ্রুতই ফিরবে। চম্পা স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে এবং ঝরনা ৭ম শ্রেণীতে পড়ত। ফসল নষ্টের আগে থেকে তারা আর স্কুলে যায় না। তাদের লেখাপড়া স্থগিত রেখেছেন। বললেন, পড়াশোনা করানোর মতো কোন অবস্থা নেই। কাগজ-কলমও কেনার ক্ষমতা নেই। এছাড়া তাদের পোশাক-পরিচ্ছদসহ দৈনন্দিন খরচও আমার পক্ষে চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। তিনি জানান, ছয় মেয়ে তার। ইতোমধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। অভাবের কারণে তারাও বাড়ি আসে। ছয় মেয়ে, তিনি ও স্ত্রীসহ ছয়জন এখন পরিবারে নিয়মিত। বিকল্প আয়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছেন বার বার। মাছ ধরতে স্থানীয় জেলেদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু হাওড়ে কোন মাছ নেই। কয়েকদিন চেষ্টা করেও এক টাকা আয় নেই তার। এবার দিন কাটান ট্রলারঘাটে বসে। যদি কোন কাজ পান। চেষ্টা করছেন ট্রলারে কাজ করার। তাতেও কোন ব্যবস্থা হচ্ছে না। অভাবের কারণে আয় কম, তাই ট্রলার মালিকরা বাড়তি জনবল নিচ্ছেন না। নিজেরাই সব করছেন। আলমের বাড়ি গিয়ে দেখা গেল, ছোট্ট একটি টিনের ঘর। উঠানজুড়ে ডুবন্ত পচা খড় শুকানো হচ্ছে। কিছু ধানও আছে। তার স্ত্রী আছিয়া জানালেন, পানির নিচ থেকে কিছু খড় ও ধান সংগ্রহ করা হয়েছে। একমণ ধানে চাল হচ্ছে ৫/৭ কেজি। যেখানে ২৫থেকে ২৭ কেজি হবার কথা। খড় জ্বালানি হিসেবে কাজে লাগাচ্ছেন। আশপাশে বাড়ির গোয়াল থেকে গোবর শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছেন। রবিবার দুপুরে যখন আছিয়া বেগমের সঙ্গে বাড়িতে কথা হচ্ছিল তখন ঘরে কোন খাবার ছিল না। বললেন, আশায় আছি সরকারী চাল আসবে। তাহলেই খাওয়া-দাওয়ার একটা ব্যবস্থা হবে। এখন টাকাও কেউ ধার দেয় না, চাল কিংবা আটা দিতেও নারাজ। কারণ সবাই অভাবী। তিনি জানান, আমাদের এখন আর তিনবেলা ভাত জোটে না। দু’বেলা রুটি খাই, একবেলা ভাত। এই পরিবারটির খাদ্য তালিকায় এখন আর মাছ জোটে না। শাকপাতা দিয়ে খেয়ে কোনরকমে দিন যাচ্ছে তাদের। আলম জানালেন, সব মিলিয়ে ৫০ হাজার টাকা দেনা আছে। স্থানীয় কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। আশা সমিতি থেকেও নিয়েছেন ১৫ হাজার টাকা। কিস্তির জন্য নিয়মিত লোকজন বাড়ি আসছেন। কিন্তু টাকা দিতে পারছেন না। বার বার তারিখ দিচ্ছেন। তিনি দাবি জানান, বেসরকারী এনজিও সংস্থার ঋণ মওকুফ না করলে আমাদের বেঁচে থাকা আরও কষ্টকর হবে। বলেন, আমাদের এমপি কিস্তি দিতে মানা করে গেছেন। কিছুটা ভরসা পাচ্ছি। কিন্তু লোকজনের আসা তো বন্ধ হচ্ছে না। এখন খাব, নাকি কিস্তি পরিশোধের চিন্তা করব...। আরেক নাসিমের গল্প... আলমের মতোই আরেকজন হলেন নাসিম। তার বাড়ি পার্শ¦বর্তী গাগলাজুর ইউনিয়নের মান্দারবাড়ি গ্রামে। নাসিম এ বছর ৫ একর জমি চাষ করেছিলেন। কিন্তু চর হাইজদা বাঁধ ভেঙ্গে আগাম বন্যার কারণে একমুঠো ধানও কাটতে পারেননি। অন্যান্য সময় বর্ষা মৌসুমে হাওড়ে মাছ ধরতে পারতেন। কিন্তু এবার তা-ও সম্ভব হচ্ছে না। একে তো হাওড়ে মাছ নেই। মাছের পোনা পর্যন্ত মরে গেছে। অন্যদিকে নিজস্ব জাল বা নৌকাও নেই তার। মাছ ধরার জাল-নৌকা কিনতে কমপক্ষে ৩০-৪০ হাজার টাকা দরকার। একটি জাল ও একটি নৌকায় তিন-চার জনের রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়। অন্যান্যবার মাছের আড়তদার বা পাইকাররা জাল-নৌকা কেনার অগ্রিম টাকা দিতেন। মাছ ধরে বিক্রির পর তা ক্রমান্বয়ে পরিশোধ করতেন। কিন্তু এবার পাইকার বা আড়তদাররা কাউকে টাকা দিচ্ছেন না। কারণ, টাকা দিলে তা অভাবের কারণে জেলেরা পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে। জমি চাষাবাদের কারণে দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৬৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। ইতোমধ্যে দুটি গরু বেচেও তা সম্পূর্ণ পরিশোধ করতে পারেননি। প্রায় ৭০ হাজার টাকা দামের দুটি গরু মাত্র ৫৮ হাজার টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। নাসিম বলেন, কিছুদিন পর হাওড়ে হয়ত মাছ পাওয়া যাবে। তাই সরকার যদি জেলেদের জাল-নৌকার জন্য ঋণের ব্যবস্থা করে তাহলে তারা কিছু একটা করার উপায় খুঁজে পাবে। শুধু কি আলম আর নাসিম? নেত্রকোনার হাওড়াঞ্চলে তাদের মতো হাজারো কৃষক আছেন যারা চরম অভাব-অনটনে দিন পার করছেন এখন।
×