ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

১০ বছরে তিন লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা পাচার

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৩ মে ২০১৭

১০ বছরে তিন লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা পাচার

রহিম শেখ ॥ বাংলাদেশ থেকে ২০১৪ সালে আরও ৭০০ কোটি ৬৯ লাখ ডলার পাচার হয়েছে। টাকার অঙ্কে ৫৬ হাজার ৫৫ কোটি ২ লাখ টাকা। এদিকে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে তিন লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা (চার হাজার ৪৬১ কোটি ৫৩ হাজার মার্কিন ডলার)। মূলত আমদানি-রফতানির সময়ে পণ্যের প্রকৃত মূল্য গোপন করার মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করা হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) গত সোমবার অর্থ পাচারের এই তথ্য প্রকাশ করেছে। জিএফআই আট বছর ধরে উন্নয়নশীল দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ অবৈধভাবে পাচার হয়, তা নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। এবার ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বড় এবং স্থায়ী অবৈধ আর্থিক প্রবাহ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া ওই অর্থ বাংলাদেশের ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, পল্লী উন্নয়ন, শিল্প ও ভৌত অবকাঠামো খাতের মোট উন্নয়ন বাজেটের সমান। ২০১৭ সালে জিএফআই প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ ছিল ১৪৯টি দেশের মধ্যে ৪৬তম। সোমবার প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর অর্থপাচারের হার ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এই ১০ বছরে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে অর্থ পাচার দুই ট্রিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে সাড়ে তিন ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। সারা বিশ্বে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয় তার ২৪ শতাংশই হয় উন্নয়নশীল দেশ থেকে। জিএফআই ২০১৩ সালে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে সেটা থেকে জানা যায়, ২০১৩ সাল পর্যন্ত হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ৫৫৮ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে। ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি ডলার পাচার হয়েছিল। তিন বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৬৬ কোটি ডলার। নতুন প্রতিবেদনে পাচারের হার আরও বেশি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ওই ১০ বছরের গড় হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশের মধ্যে ভারত থেকে ৫৫ হাজার ৭ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। এ ছাড়া ওই সময়ে শ্রীলঙ্কা থেকে ২৩২৩ কোটি, নেপাল থেকে ৫২৫ কোটি, পাকিস্তান থেকে ৫৮৯৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। এ ছাড়া আফগানিস্তান থেকে পাচার হয়েছে ১১ হাজার ৭৯৬ কোটি ডলার। বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান জনকণ্ঠকে বলেন, ২০১৩ সালে যে অর্থ পাচার হয়েছে, তা শিক্ষা বাজেটের ৩ দশমিক ৬ গুণ; স্বাস্থ্য বাজেটের ৮ দশমিক ২ গুণ। আর পাচার করা অর্থের যদি ২৫ শতাংশের ওপর করারোপ করা যেত, তাহলে স্বাস্থ্য বাজেট তিন গুণ আর শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ হতো। ওই বছর (২০১৩) বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সাড়ে ৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। তিনি বলেন, যদিও ২০১৪ সালে এই পাচারের অর্থের পরিমাণ কিছুটা কম। তারপরও এদেশ থেকে টাকা পাচার বন্ধে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা জরুরী। একই সঙ্গে টাকা পাচার রোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন উল্লেখ করে প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনী সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান এই গবেষক। জিএফআইয়ের গবেষণা প্রতিবেদনে ২০০৫ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত অর্থ পাচারের হিসাব দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে ২০১২ ও ২০১৩ সালে। যেমন ২০১২ সালে অর্থ পাচারের পরিমাণ ৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার, ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার ও ২০১৪ সালে ৭০০ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। এ ছাড়া ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ২০ লাখ ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৮ সালে ৬৪৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ২০০৯ সালে ৬১২ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি ৯০ লাখ ডলার এবং ২০১১ সালে পাচার হয় ৫৯২ কোটি ১০ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণ ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ৫৩ লাখ ডলার বা ৩ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ দিয়ে অন্তত এক বছরের বাজেট তৈরি করতে পারত বাংলাদেশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গড়ে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫৫৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার। জিএফআইয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ডেভ কার ও অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্পানজারস বরাবরের মতো এই গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। ডেভ কার এর আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অর্থনীতিবিদ ছিলেন। তারা বিভিন্ন দেশের লেনদেনের ভারসাম্য ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করেছেন। আর এসব পরিসংখ্যানের উৎস হচ্ছে আইএমএফ। এবারের প্রতিবেদনে ২০০৩ সালের তথ্য দেয়া ছাড়াও আগের বছরগুলোর পরিসংখ্যান হালনাগাদ করা হয়েছে। এই গবেষণায় আর্থিক সহায়তা দিয়েছে ফিনল্যান্ড সরকার। গবেষণায় মূলত দুভাবে অর্থ পাচারের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ট্রেড মিসইনভয়েসিং বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চালানের গরমিলের মাধ্যমেই বেশি পরিমাণ অর্থ উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ পণ্য আমদানি-রফতানির চালানে প্রকৃত মূল্য আড়াল করে কমবেশি দেখিয়ে একদিকে কর ফাঁকি দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে মোটা অঙ্কের অর্থ দেশে না এনে বাইরেই রেখে দেয়া হয়েছে। অপরটি হলো আন্তর্জাতিক লেনদেনে গরমিল। তবে এর মধ্যে ভুয়া চালান দেখিয়েই অর্থের ৮৩ শতাংশ পাচার করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকেও দুভাবে অর্থ পাচার হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করা হয় আমদানি-রফতানিতে পণ্যের প্রকৃত মূল্য আড়াল করার মাধ্যমে। যেমন গত ১০ বছরে এভাবে পাচার করা অর্থের পরিমাণ ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। এর মধ্যে ২০১৪ সালে পাচার হয় ৭০০ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এবি মির্জ্জা মোঃ আজিজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের কথা সবাই জানেন, আমার তো মনে হচ্ছে, রফতানির আড়ালেও অর্থ পাচার হতে পারে। গত মাসে দেশের যে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার পেছনেও অর্থ পাচার থাকতে পারে বলে সন্দেহ পোষণ করেন তিনি। এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক লেনদেনের মাধ্যমে অর্থ পাচারের বিষয়টি নিয়ে এনবিআর আরও গভীরভাবে খতিয়ে দেখছে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে একটি বিশেষ সেল খোলা হয়েছে।
×