ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মে দিবসের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী

কিছু শ্রমিক নেতা শিল্পকে অস্থিতিশীল করতে কাজ করছেন

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৩ মে ২০১৭

কিছু শ্রমিক নেতা শিল্পকে অস্থিতিশীল করতে কাজ করছেন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের শিল্পকারখানাগুলো অস্থিতিশীল করতে কিছু শ্রমিক নেতা বিদেশের স্বার্থে কাজ করছে। দেশে তাদের কোন খবর নেই। তবে তারা কিছু হলেই কেবল বিদেশে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মেসেজ পাঠানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারা কি ভাড়া খাটেন? কোন বিদেশী এজেন্সির ভাড়া খেটেই এটা করেন কিনা আমার সন্দেহ। নইলে দেশে কি ঘটনা ঘটল তা দেশে বসে সমাধান না করেই মুরব্বি খুঁজতে যাবেন পরদেশে! তারা এসে কি করবে, খবরদারি করবে। আর এই খবরদারির ফলে যদি ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হয়ে যায়, তবে যারা এসব ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেন তাদের ভাগ্যে কি জুটবে?’ সোমবার বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় আয়োজিত মহান মে দিবসের অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি আরও বলেন, একটা শ্রেণী আছে যাদের কাজই হচ্ছে ত্রুটি খুঁজে বের করে বদনাম করা। যারা কথায় কথায় বিদেশীদের কাছে নালিশ করতে যান তারা যে নিজে দেশ, মালিক, মানুষ এবং ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতি করেন, এটা তারা কেন উপলব্ধি করতে পারেন না? তথাকথিত নেতৃত্বের দাবিদারদের উসকানিতে কান না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিছু কিছু শ্রমিক নেতা জুটে যান, তারা যে কোথাকার শ্রমিক, তা আমি জানি না। তারা নেতা সাজেন। এদের উসকানিতে কেউ যদি কোন কিছু করে, নিজেরা চাকরি হারালে, তখন কি তারা খাবার দিতে আসে? বিপদে পড়লে কোন সাহায্য দেয়? আহত হলে চিকিৎসার সাহায্য করে? শেখ হাসিনা বলেন, অন্তত এটুকু বলতে পারি আমার রাজনীতি বাংলাদেশ এবং এদেশের জনগণের স্বার্থে ও কল্যাণে। জনগণের উন্নয়নের জন্য এখানে আমাদের চাইতে আর কারো দরদ বেশি উথলে উঠতে পারে তা আমি বিশ্বাস করি না। আমি এটুকু বলব, আপনারা শ্রমিক ভাইয়েরা এদেশের কল্যাণে শ্রম দেন। আপনাদের বেতন-ভাতার জন্য আন্দোলন করা লাগবে না। তিনি বলেন, আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। দেশ এখন বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের রোল মডেল। এই সম্মান আমাদের ধরে রাখতে হবে। আমি আজকের দিনে বাংলাদেশের সকল শ্রমিক ভাই এবং প্রবাসেও যারা রয়েছেনÑ তাদের বলব, যে যেখানে আছেন তারা যেন সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেন। কারণ যার মাধ্যমে আপনার জীবন-জীবিকা নির্বাহ হয় সেটা যেন সচল থাকে। সেই সচল রাখার দায়িত্ব আপনাদের। মে দিবসের চেতনাকে ধারণ করে শ্রমিক এবং মালিক পক্ষকে দেশের উন্নয়নের স্বার্থে এক সঙ্গে কাজ করে দেশকে শিল্পায়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মালিক শ্রমিক সম্পর্ক হতে হবে হƒদ্যতাপূর্ণ। একে অপরের পরিপূরক হয়ে কাজ করলেই কেবল দেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন, আমার রাজনীতি আপনাদের জন্য, বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক, মেহনতি মানুষের জন্য। কাজেই আমি আছি আপনাদের সঙ্গে। কোনরকম উসকানিতে কান না দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে বহির্বিশ্বে দেশের সুনাম বৃদ্ধিতেও শ্রমিকদের করতে এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কল্যাণে সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা উল্লেখ তিনি বলেন, মে দিবসের যে সংগ্রামী চেতনা, সেই চেতনাকে মাথায় নিয়েই আমাদের দেশকে ধীরে ধীরে আমরা শিল্পায়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব। আমাদের দেশ উন্নত হবে। বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্ত হবে। শেখ হাসিনা শ্রমের মর্যাদা এবং শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা যথাযথভাবে মিটিয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে মালিকদের উদ্দেশে বলেন, মুনাফা অবশ্যই করবেন। তবে তা যেন শোষণে পরিণত না হয়। শ্রমিকদের বঞ্চিত করে শিল্পের উন্নয়ন হবে না। কারণ শ্রমিক হচ্ছে কারখানার প্রাণ। শ্রমিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, শিল্প টিকে থাকলেই কেবল আপনাদের কর্মসংস্থান হবে। দারিদ্র্য দূর হবে। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখতে পারবে। তাই শিল্পের ক্ষতি হয় এমন কোন কাজে সম্পৃক্ত হবেন না। শেখ হাসিনা শ্রমিক ও মালিক পক্ষকে আশ্বস্ত করে বলেন, সরকার সবসময়ই আপনাদের পাশে আছে। কোন সমস্যা হলে অবশ্যই আমরা আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান করতে পারব। ‘শ্রমিক মালিক গড়ব দেশ, এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ’-এবারের মে দিবসের এই প্রতিপাদ্যটি যথার্থ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁর সরকার শ্রমনীতি বাস্তবায়ন ও শ্রমিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। জীবনধারণের ব্যয়, মূল্যস্ফীতি এবং প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ ও পুনর্নির্ধারণ প্রক্রিয়া রাখা এবং এজন্য মজুরি কমিশন ও সংশ্লিষ্ট আইনসমূহের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হবে। ইতোপূর্বে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিতে নিজস্ব উদ্যোগ এবং শ্রমিকদের পক্ষে বার্গেনিং এজেন্ট হিসেবে মালিকপক্ষের সঙ্গে যুক্তিতর্কে অংশ নিতে তাঁর উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সীমিত সম্পদের মধ্যেও আমরা শ্রমিকের কল্যাণে গত আট বছরে ব্যাপক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করেছি। আমরা পোশাক শ্রমিকের মজুরি তিন দফা বাড়িয়েছি। ন্যূনতম মজুরি ১ হাজার ৬শ’ টাকা থেকে ৫ হাজার ৩শ’ টাকায় উন্নীত করেছি। শ্রমিকদের জন্য রেশনিং প্রথা চালু করেছি। শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র, স্কুল, হাসপাতাল, ডরমেটরি নির্মাণ করেছি। তিনি বলেন, গার্মেন্টস শিল্পে কমপ্লায়েন্স ইস্যুটিকে তাঁর সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। এ শিল্পের উন্নয়নে আইএলওর সহায়তায় ত্রিপক্ষীয় জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এ সময় বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর সরকার প্রচলিত অনলাইন রেজিস্ট্রেশন না করে কোন প্রকার দালালের দ্বারস্থ হয়ে নিজের ভিটেমাটি বিক্রি করা থেকে বিরত থাকতে প্রবাসগামীদের সতর্ক করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক থাকার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তাদের জন্য সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলেও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, দেশের প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের কল্যাণে শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গড়ে তোলা হয়েছে। ২০০৮ সালে এ তহবিলে জমা ছিল মাত্র ৮ লাখ টাকা। বর্তমানে এ তহবিলে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ ২শ’ কোটি টাকার বেশি। শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান এমপি, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কান্ট্রি অফিসের পরিচালক শ্রীনিবাস বি রেড্ডী, জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি শুক্কুর মাহমুদ, তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের পক্ষে বিজিএমইএ সভাপতি মোঃ সিদ্দিকুর রহমান, কর্মজীবীদের পক্ষে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি সালাউদ্দিন কাশেম খান, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মিকাইল শিপার প্রমুখ। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, সরকারের পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা, বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশনের সদস্য, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধি, অন্যান্য আমন্ত্রিত অতিথি এবং শ্রমিক ও মালিক পক্ষের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
×