ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আ.স.ম জাকারিয়া

মে দিবস এবং প্রাসঙ্গিক ভাবনা

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ১ মে ২০১৭

মে দিবস এবং প্রাসঙ্গিক ভাবনা

১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগো শহরের ‘হে মার্কেট’ নামক স্থানে শ্রমিক শ্রেণী তার আট ঘণ্টা কর্মের দাবিতে মালিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সূচনা করে। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রমিক শ্রেণীর প্রথম অধিকার আদায়ের আন্দোলন। ১ মে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দুনিয়ার নির্যাতিত মানুষ তাদের ঐক্যবদ্ধ জানান দিল, রক্ত দিল, দাবি আদায় করল। সারা দুনিয়ার দুর্বল, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষ জানল যে, ঐক্যবদ্ধ শক্তির কাছে যে কোন শক্তি হার মানতে বাধ্য। সম্মিলিতভাবে কাজ করলে সফলতা অর্জন করা যায়। গণমানুষের শক্তি ‘একতা’ এর মধ্য দিয়ে দাবি আদায় নির্যাতিত-নিপীড়নের প্রতিবাদ, প্রতিরোধসহ যে কোন কাজ করা সম্ভব। নিপীড়ক শ্রেণী, মালিক শ্রেণী, শোষক শ্রেণী, শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্যবদ্ধতাকে বেশি ভয় পায়। অন্য কিছুকে এত ভয় পায় না। এজন্য মালিক শ্রেণী শ্রমিক শ্রেণীকে তথা শোষিত মানুষকে ট্রেড ইউনিয়ন করতে দিতে চায় না। অর্থনৈতিক সামান্য দাবি-দাওয়া যেনতেনভাবে মেনে নেবে কিন্তু ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার দিতে নারাজ। এর জন্য যা কিছু দরকার সব কিছু করবে। সরকার থেকে শুরু করে যত মাধ্যম আছে সব তারা ব্যবহার করবে, শুধু ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার রুখতে। যা ইতোমধ্যে আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে বাংলাদেশের সকল শিল্প সেক্টরে। বিশেষ করে গার্মেন্টস সেক্টরে এর প্রভাব বেশি। ১৮৮৬ সালের আন্দোলনের মূলে ছিল মালিক শ্রেণীর অমানুষিক খাটুনি খাটানো। অর্থাৎ কাজের নির্দিষ্ট সময় এবং অবসর সময় না থাকা। এই খাটুনি থেকে মুক্তির জন্য নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা দাবি ছিল সর্বাগ্রে। সেদিনের আন্দোলনে শ্রমিকের রক্ত বেয়ে আসে, আজকের দুনিয়ার শ্রমিক শ্রেণীর জন্য আট ঘণ্টা কর্মঘণ্টা। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, আজকের বাংলাদেশের শিল্পকারখানাসহ সর্বত্র আট ঘণ্টা শ্রমঘণ্টা নেই। সর্বত্র ১০-১২ ঘণ্টা নির্দিষ্ট শ্রম। তাদের ওপর ১৬-১৮ ঘণ্টা। অবশ্য ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টার মধ্যে ১০-১২ ঘণ্টার পরেরটা ওভার টাইম হিসেবে বলা হয়। তাও আবার প্রচলিত নিয়ম-কানুনের বাইরে। অর্থাৎ ওভার টাইমের নিয়ম অনুযায়ী ওভার টাইমের মজুরি মূল বেতনের দ্বিগুণ। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, আমাদের দেশে গার্মেন্টসে তা নেই বললেই চলে। গার্মেন্টসের বাইরেও বেশিরভাগ মালিকানা কারখানায় নিয়ম-কানুনের বালাই নেই। সকল ক্ষেত্রের চিত্র একই রকম এবং নির্দিষ্ট শ্রমঘণ্টা ও একই রকম। তাছাড়া স্বল্প বেতন, নারী-পুরুষের বেতনের বৈষম্য, নেই চাকরির নিশ্চয়তা, নিরাপত্তা, সর্বত্র মৃত্যুর মিছিল। নেই চাকরির নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, স্থায়ী হওয়ার নিয়ম-কানুন। নেই বেতন ছাড়া অন্য কোন সুযোগ-সুবিধা, অনেক কারখানায় নেই সাপ্তাহিক ছুটির ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন বিশেষ ছুটির ব্যবস্থা। বিগত দিনগুলোতে শ্রমিক শ্রেণীর শ্রম আইন অনুযায়ী যে সকল সুযোগ- সুবিধা পেত এবং অধিকার লাভ করত, বর্তমানে তার বিন্দুমাত্র নেই বললে চলে। বলা যায়, কারখানাসমূহ দেশের প্রচলিত আইনের বাইরে মালিকের নিজস্ব নিয়মনীতির দ্বারা পরিচালিত। আমার কারখানা আমার নিয়ম, আমার দুনিয়া আমার আইনে; যেন সে রকম অবস্থা। অথচ ১ মের আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণীর যে দাবিসমূহ দুনিয়াব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছিল বর্তমানে এ দাবিসমূহে দাসযুগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। মালিক মিল বানাবে, গ্রাম থেকে লোক নিয়ে আসবে, খাওয়া-পরার বিনিময়ে কাজ করাবে, সকাল থেকে সন্ধ্যা থাকবে কোম্পানির বানানো ঘরে। বেয়াড়া শ্রমিকদের জন্য থাকবে সে আগের মতো চাবুকধারী ম্যানেজার, দারোয়ান। যারা কাজ করবে না, চাবুক দ্বারা পেটাবে। বেতন চাইলে মারবে, গাধার খাটুনি, কথা বলা যাবে না। বিস্তারিত বিশ্লেষণ না করেও বর্তমানের সামান্য চিত্র যা আমাদের সকলের জানা, দেখার মধ্যে, তাতেও আন্দাজ করা যায় যে, শ্রমিক শ্রেণীর আগামী দিনগুলো নিঃসন্দেহে সেই আদিযুগের অর্থাৎ ১৮৮৬ সালের সময়ের মতো হতে চলছে। বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার এবং তাদের অবস্থার উত্তরণের জন্য আইএলওসহ বিভিন্ন দেশ-বিদেশী এনজিও কাজ করছে। যে ধারণা নিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন, তাতে মুক্তি আসবে কিনা জানি না। বিগত দিনে যে আন্দোলন ছিল বর্তমানে তা অনুপস্থিত। তাছাড়া বিগত দিনের নেতা এবং বর্তমানের নেতাদের নীতি, আদর্শ, চিন্তাধারা আকাশ-পাতাল। তফাৎ বিগত দিনের নেতারা শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে লড়াই করতেন। নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করতেন না। বর্তমান যুগ সম্পূর্ণ বিপরীত। আজকের নেতারা নিজের স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত অবশ্য সকলের ক্ষেত্রে এ কথা সত্য নয়। এখনও অনেক আছেন, যারা চেষ্টা করেন শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার। সমস্যা হলো, তারা যে ধারার আন্দোলনে বিশ্বাস করতেন বর্তমানে তা অনুপস্থিত। আইএলওসহ কতিপয় দেশী, বিদেশী এনজিও এবং কতিপয় নেতানেত্রী শ্রমিক আন্দোলনকে বাক্সবন্দী করে ফেলেছেন। বাক্সবন্দী বলতে, ট্রেনিং প্রোগ্রাম, আইন-কানুন, নিয়ম-নীতির দোহাই দিয়ে আন্দোলনকে মূল জায়গা থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন বর্তমানে হয় না বললেই চলে। মালিক শ্রেণী, সুবিধাবাদী শ্রেণী এবং ক্ষমতাসীনরা আইন-কানুনের দোহাই দিয়ে আন্দোলন করা থেকে দূরে রাখছে। দেশীয় মালিক শ্রেণী এবং শোষক শ্রেণী আইন-কানুনের অসংখ্য ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ লাভ করে। তার সঙ্গে থাকে ক্ষমতাসীনদের মালিকদের প্রতি ভালবাসা এবং সমর্থন। আইন নিয়ম-নীতি যদিও শ্রমিক শ্রেণীসহ সর্বস্তরের আন্দোলনের পূর্বশর্ত। আমার অভিজ্ঞতায় শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন যেহেতু শোষকের বিরুদ্ধে শাসিতের সেহেতু তাদের ঐক্যবদ্ধ রাজপথের আন্দোলনই, সঠিক আন্দোলন। যা শোষকের হৃদপি-ে কম্পন ধরায়। যা অতীতের অভিজ্ঞতা এবং বর্তমানেও...। এদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকরা যখন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে রাজপথে নেমে গিয়েছিল এবং রাজপথ কাঁপিয়ে দিয়েছিল, সেদিন থেকে মালিক, সরকার, আমলা-কামলা সবাই তাদের ব্যাপারে কিছু করার দরকার এ কথা অনুধাবন করেন। পাশাপাশি বিদেশী ক্রেতাদের চাপ। বাংলাদেশের শ্রমিক নেতাদের আন্দোলন এবং সংগঠনসমূহের ভূমিকা খুবই গৌণ। পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী (১৯৮০ সাল পর্যন্ত) রাজপথে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন শাসকগোষ্ঠি, মালিকগোষ্ঠী এবং শোষকগোষ্ঠির ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। আদায় করেছিল ন্যায্য দাবি। সে অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমানে এদেশীয় মালিকরা দেশী-বিদেশী সুবিধাবাদী শ্রেণী এনজিও আন্তর্জাতিক এজেন্সিসমূহ কৌশলে শ্রমিক শ্রেণী যাতে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে, ট্রেড ইউনিয়ন করতে না পারে, রাজপথে নামতে না পারে, তার জন্য শ্রমিক আন্দোলনকে নিয়ম-নীতি, আইন-কানুনের বেড়াজালের আটকে রেখেছে। আইন জানো, নিয়ম জানো, রাস্তায় নেমো না, এই নীতিতে কাজ করে যাচ্ছে। একথা পরিষ্কার যে, অতীত অভিজ্ঞতায় বলে, একতা আন্দোলনের হাতিয়ার, ট্রেনিং অধিকার তার পূর্বশর্ত এবং রাজপথ কাঁপানোর আন্দোলনের অধিকার পাওয়ার অন্যতম পথ। যতক্ষণ এ ধারণা না আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণী তার অধিকার কতটুকু পাবে, তা জানি না। এখনকার মালিক শ্রেণী এদেশীয়। তাদের আছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বেশিরভাগই সাংসদ, মন্ত্রী, উপমন্ত্রী এমনকি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনদের অংশীদার বা ক্ষমতাধর কোন ব্যক্তি। তাদের রয়েছে বহুমাত্রিক ক্ষমতা। এই বহুমাত্রিক ক্ষমতার সঙ্গে লড়ার একমাত্র পথ রাজপথ এবং আইন বা নিয়মের বেড়াজালে তাদের আটকে অধিকার আসবে না। আসবে বঞ্চনা, যন্ত্রণা, লাঞ্ছনা যদিও গণতান্ত্রিক ভাষায় আইন, নিয়ম, কানুন আন্দোলনের পূর্বশর্ত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মালিক শ্রেণীর ক্ষমতা রাজনীতির চরিত্র, সরকারের চরিত্র সব মিলিয়ে এই ধারা কতটুকু প্রযোজ্য তা ভাবনার বিষয়। রাজপথ বলতে বোঝাতে চেয়েছি, যে শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্যবদ্ধ শক্তির পথ দর্শন, ভাঙচুর বা অন্য কোন পন্থা নয়। মালিক শ্রেণী শ্রমিক শ্রেণী বা শোষিত শ্রেণীর ঐক্যবদ্ধ শক্তি প্রদর্শনকে যতটা ভয় পায় অন্য কিছুতে ততটা ভয় পায় না। আইন তাদের কাছে খেলার বস্তু। সুতরাং, আইন দ্বারা শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার প্রাপ্তির আশা অরণ্যে রোদন মাত্র। কারণ, মালিকের ক্ষমতার দাপট এবং আইনের সহস্র ধারা গরিব মানুষের কাছে আইনের অধিকার প্রাপ্তি দূরাশামাত্র। বাংলাদেশের শ্রম আদালতে যে শ্রমিক একবার কোন মামলা করে থাকে এর অভিজ্ঞতায় জীবনে কখনও মামলার নাম নেবে না। এবং কাউকে শ্রম আদালতে মামলা করতে বলবে না। পুরোটা ব্যাখ্যা নাইবা করলাম। কারণ, বাংলাদেশের শ্রম আদালত সম্পর্কে কমবেশি সবার অভিজ্ঞতা রয়েছে। বিশেষ করে, শ্রমিক নেতা এবং ভুক্তভোগী শ্রমিক-কর্মচারীর। বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণীর বর্তমান অবস্থা আন্দোলন-সংগ্রামের চিত্র, তাছাড়া আইন, নিয়ম-কানুন, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারসহ সার্বিক বিষয়ের দিকে তাকালে মনে হয়, ১৮৮৬ সালের মে মাসে শ্রমিক শ্রেণী যে অধিকারগুলোর জন্য লড়াই করেছে সেই লড়াইয়ের ফসল আমরা বর্তমান দিনগুলোতে ভোগ করছি। ক্রমশ আমরা শ্রমিক শ্রেণীর সেই ১৮৮৬ সালের দিনগুলোর মতো দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হচ্ছি। সকল প্রকার আধুনিক শোষণযন্ত্র দ্বারা শোষিত হচ্ছি। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দরকার, নতুন আন্দোলন, আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, শ্রমিক সংগঠনগুলোর কার্যকরী আন্দোলনের কর্মসূচী এবং নিঃস্বার্থ মনোবৃত্তি। দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার কার্যক্রম গ্রহণ ও পরিচালন। ফলে সম্ভব হবে শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার ফিরে পাওয়ার এবং ১৮৮৬ সালের ১ মে তারিখের শ্রমিক শ্রেণীর রক্তের সার্থকতা। অন্যথায় অচিরেই এদেশের শ্রমিক শ্রেণী দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হবে, মালিক শ্রেণীর হাতে থাকবে চাবুক, শ্রমিক শ্রেণী হবে হুকুমের গোলাম। লেখক : শ্রমিক নেতা, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন, কেন্দ্রীয় কমিটি
×