ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আসছে-বর্ষার ইলিশ মৌসুম

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৩০ এপ্রিল ২০১৭

আসছে-বর্ষার ইলিশ মৌসুম

শংকর লাল দাশ ॥ ইলিশ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্রমে শক্ত অবস্থান করে নিচ্ছে। সরকারের নানামুখী উদ্যোগ-আয়োজনে ইলিশের প্রজনন প্রায় নির্বিঘ্ন হয়েছে। জাটকা নিধন অনেক কমে এসেছে। বেড়েছে জেলেদের সচেতনতা। সাধারণ মানুষও ইলিশ রক্ষায় উদ্যোগী হয়ে উঠেছে। চলছে ব্যাপকভিত্তিক সরকারী-বেসরকারী গবেষণা। যে কারণে সময়ের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ইলিশের সংখ্যা। বাড়ছে আকারে-ওজনে। বিনিয়োগে সৃষ্টি হয়েছে নতুন ক্ষেত্র। অনাহারী জেলেদের মুখে ফিরেছে হাসি। এভাবেই নানা অবয়বে ইলিশ আবার ফিরে আসছে নতুন গৌরবে। ইলিশ শুধু বাংলাদেশের জাতীয় মাছ নয়, বাঙালীর গর্ব। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে ইলিশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। ইলিশ প্রকৃতির অন্যতম সম্পদ। শত শত বছর ধরে এ অঞ্চলের লাখো মানুষ ইলিশের ওপর নির্ভর করে আসছে। গভীর সমুদ্রে যাত্রা-সেটিও ইলিশের হাত ধরে উপকূলের মানুষ শুরু করেছিল অনেক কাল আগে। স্বাদ-গন্ধ-রূপের পাশাপাশি এর রয়েছে যথেষ্ট পুষ্টিগুণ। ইলিশ নিয়ে আশা ভঙ্গের বেদনাও আছে। গত শতকের আশির দশক থেকে ইলিশের উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যেতে থাকে। সাগরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছাড়াও একটা সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অন্তত একশ’ নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। যা ওই সময় থেকে হ্রাস পেতে শুরু করে। ইলিশনির্ভর জীবিকাসন্ধানী পরিবারগুলোতে নামে ঘোর অমানিশা। আশার কথা, সে অবস্থা এখন অনেকটাই পাল্টে গেছে। গত কয়েক বছরে সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টায় ইলিশ খাতে সুদিন ফিরে এসেছে। একমাত্র প্রজনন মৌসুমকে নির্বিঘœ করার কারণেই ইলিশের সংখ্যা বেড়েছে কয়েক হাজার গুণ। ইলিশের জীবনচক্র পরিচালিত হয় স্বাদু বা মিঠাপানি থেকে সমুদ্রে আবার সমুদ্র থেকে মিঠাপানিতে অভিপ্রয়াণের মাধ্যমে। বাংলাদেশের জলজ ইকোসিস্টেমে শতকরা অন্তত ৩০ ভাগ ইলিশ সবসময় ডিম বহন করে। প্রজননের ভরা মৌসুমে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগে। মা ইলিশ পরিপক্ব হয়ে যে ডিম ছাড়ে, তা পুরুষ ইলিশ দ্বারা নিষিক্ত হয়ে নতুন প্রজন্ম গঠন করে। ইলিশের ডিম ফুটে যে লার্ভা বের হয়, তা স্বাদু, মিঠা বা কম নোনাপানির নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে ৬-১০ সপ্তাহ বিচরণ করে জাটকায় রূপ নিয়ে পরিপক্বতার জন্য গভীর সমুদ্রে চলে যায়। এক- দেড় বছরের মধ্যে পরিপক্ব হয়ে আবার সে ইলিশ প্রজননের জন্য ফিরে আসে স্বাদু বা মিঠাপানিতে। ইলিশ প্রায় সারা বছর কমবেশি প্রজনন করলেও মূলত আশ্বিন-কার্তিক (অক্টোবর) মাসের পূর্ণিমার আগের ৪ দিন এবং পূর্ণিমাসহ পরবর্তী ১৮ দিন, মোট ২২ দিন প্রধান প্রজনন মৌসুম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সরকার এ সময়ে ইলিশ আহরণে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। প্রজননকে নিরাপদ ছাড়াও সরকার গত কয়েক বছরে জাটকা নিধন বন্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করে আসছে। ৬টি অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা ছাড়াও দেশের সকল নদীতে ১ নবেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৮ মাস জাটকা ধরা, বিক্রয়, মজুদ ও পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। প্রজননকে নির্বিঘœ রাখা এবং জাটকা নিধন বন্ধ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের গবেষণা, জেলেদের পুনর্বাসন, পরিবেশের উন্নয়ন, ব্যাপক প্রচার-প্রচারণাসহ বহুমুখী কর্মকা-ের কারণে ইলিশের উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি এর আকার-আয়তনও অনেক বেড়েছে। ওয়ার্ল্ড ফিশের তিন বছর ধরে চলা এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৩ সালে গড়ে ৫১০ গ্রাম, ২০১৪ সালে ৫৩৫ গ্রাম ও ২০১৫ সালে ৬২৮ গ্রাম ওজনের ইলিশ বেশি সংখ্যায় ধরা পড়েছে। অর্থাৎ প্রতিবছরই ইলিশ আকার ও আয়তনে বাড়ছে। অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রগুলোতে যে ইলিশ এসেছে তার মধ্যে ২০১০ সালে শতকরা ৩৩ দশমিক ৬৯ ভাগ, ২০১১ সালে ৩৬ দশমিক ২৭ ভাগ, ২০১২ সালে ৩৫ দশমিক ৭৯ ভাগ, ২০১৩ সালে ৪১ দশমিক ০২ ভাগ, ২০১৪ সালে ৩৮ দশমিক ৮৯ ভাগ ও ২০১৫ সালে ৩৬ দশমিক ৬০ ভাগ ছিল স্পেন্ট ইলিশ। প্রত্যেকটি ইলিশ ওজনে ছিল ৯০০ গ্রামের কাছাকাছি এবং ডিম ছাড়ার উপযোগী। এ পরিসংখ্যান ইঙ্গিত দিচ্ছে ইলিশ আবার কেজি ওজনে ফিরে যাচ্ছে। যা নিঃসন্দেহে জেলে, মহাজন থেকে শুরু করে সকলের জন্য শুভ সংবাদ। সর্বশেষ গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩ লাখ ৮৭ হাজার ২০০ টন ইলিশ ধরা পড়ে। যা দেশের মোট মাছ উৎপাদনের (৩ দশমিক ৬৮ মিলিয়ন টন) শতকরা ১০ দশমিক ৫ ভাগ এবং জিডিপির এক ভাগ। আর্থিক বিচারে এর বাজার মূল্য সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরে নিঃসন্দেহে ইলিশের উৎপাদন আরও অনেক বেড়েছে। কর্মসংস্থানেও ইলিশ ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। আর দিন কয়েকের মধ্যে শুরু হচ্ছে বর্ষা। আকাশ নদী সাগর উঠবে ফুলে ফেঁপে। ইলিশ তার জীবনচক্রের ধারাবাহিকতায় প্রজননের জন্য উপকূলের স্বাদু বা মিঠাপানিতে ছুটে আসবে ঝাঁকে ঝাঁকে। জেলেদের কাছে এ সময়টাই ইলিশের ভর মৌসুম। উপকূলের জেলেদের তাই ইলিশ আহরণের প্রস্তুতি প্রায় শেষ। এখন অপেক্ষা কেবল ঘন বরষার।
×