ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বার্থ ডে হানিমুন ডেটিং ইত্যাদি মাঠ পর্যায়েও শোনা যাচ্ছে!

প্রকাশিত: ০৪:৪৪, ৩০ এপ্রিল ২০১৭

বার্থ ডে হানিমুন ডেটিং ইত্যাদি মাঠ পর্যায়েও শোনা যাচ্ছে!

সমুদ্র হক ॥ আধুনিকায়নের সামাজিক কালচার এখন শুধু নগরজীবনের বৃত্তেই নেই। এরর বাইরে মাঠ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ই-যোগাযোগ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এই ধারাকে দ্রুত এগিয়ে দিচ্ছে। বাঙালীর সংস্কৃতির ওপরই ই-আপগ্রেড কালচার শুরু হয়েছে। সামাজিক, পারিবারিক যোগাযোগ ও বন্ধন, ব্যক্তি যোগাযোগ ও বন্ধনের নতুন নতুন শব্দ, থিওরি কালচার আবিষ্কৃত হয়ে এর ব্যাপ্তি বাড়ছে; যা দেখে আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে পশ্চিমা সংস্কৃতি। তবে গভীরে গেলে স্পষ্ট ধারণা হবে, বাঙালীর হাজার বছরের শেকড়ের সংস্কৃতির ওপর তা আপগ্রেডেড হচ্ছে। তবে শঙ্কা এবং ভয় হলো : একশ্রেণীর উচ্চবিত্তের সোসাইটি আপগ্রেড সংস্কৃতিকে কলুষিত করে তুলেছে। এই ঘুণপোকা দিনে দিনে প্রবেশ করেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভেতরে। সেখান থেকে একেবারে মাঠ পর্যায়ে। একবিংশ শতকে বিশ্বায়নের এই যুগে ঠুনকো যুক্তি দিয়ে সংস্কৃতির ধারার সামাজিক কর্মকা- রুদ্ধ করে দিতে চাইলেও পার পাওয়া যাবে না। নদী যেমন আপন বেগে ছুটে সাগরে গিয়ে মিশে যায়; সংস্কৃতির সামাজিক স্রোতও নদীর মতোই বয়ে চলে। বাঁধ দিয়ে নদীর গতি হয়ত সাময়িক ঠেকানো যায় সাগরের টান থেকে ফেরানো যায় না। যেভাবেই হোক পথ খুঁজে নেয়। কখনও তীর ভেঙ্গে চলার পথ তৈরি করে। সামাজিক কর্মকা-ে জন্মদিন (বার্থ ডে), বিয়েবার্ষিকী (ওয়েডিং এ্যানিভার্সারি), মধুচন্দ্রিমা (হানিমুন) আপন গতিতেই প্রবেশ করেছে অনেক আগে। সামাজিক এই কালচার বর্তমানে আর শহুরে জীবনের বৃত্তের মধ্যে নেই। মাঠ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। হালে আরও কয়েকটি শব্দ যোগ হয়েছে : ডেটিং, এক্সট্রা মেরিটাল রিলেশন্স বা পোস্ট-মেরিটাল রিলেশন্স, লিভ টুগেদার, বয় ফ্রেন্ড-গার্ল ফ্রেন্ড (ডিপেন্ড অন জেন্ডার) এসব শব্দ শেকড় পর্যায়েও শোনা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসএ্যাপ, ভাইবার, ইমো, স্কাইপ) এসব দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে। বর্তমানে ডেস্কটপ, ল্যাপটপ নেটবুক রিপ্লেস হচ্ছে স্মার্ট এ্যানড্রয়েড ফোন, ট্যাবে। প্রযুক্তির নিত্যনতুন আপগ্রেড এত দ্রুত বাড়ছে যে তা ঠাহর করাই কঠিন। সামাজিক জীবনে এখন আর পারিবারিক বন্ধনে সেই ফাউন্টেন পেনে সাদা কাগজে লেখা চিঠি হলুদ খামে ভরে পোস্ট অফিসের বাক্সে ফেলতে হয় না। আজকের তরুণ পোস্টকার্ড চেনে না। একটা সময় চিঠি লিখে খামে ভরে ডাক বাক্সে ফেলার পর কয়েকটা দিন কাটত অধীর আগ্রহে; কখন ফেরত চিঠি আসবে! সেসব দিন এখন নিকট অতীত। বর্তমানের তরুণ পোস্ট বলতে বোঝে ফেসবুকে কোন কিছু পোস্ট করা। হাতের মুঠোর স্মার্টফোনে ফেসবুকে ই-ফ্রেন্ডের কাছে স্ট্যাটাস দেয়া। ফেসবুকে হোয়াটস অন ইউর মাইন্ডের ঘরে মনের কথা খুলে বলা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই কবে লিখেছেন “হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল... অনেক কথা যাও যে বলি কোন কথা না বলি...” এ ধরনের অনেক গান। সেদিনের প্রেক্ষাপটে ছিল এ রকম- মানব-মানবী কখনও গোপন অভিসারে গিয়ে ওই কথাগুলো বলার জন্য কতই না আকুলিবিকুলি...। আজকের দিনে ফেসবুকে একই ধরনের আকুলিবিকুলি। ডেটিং শব্দটির আভিধানিক বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়া যায় না। বলা হয় ডেটিং বিষয়টি এসেছে ইউরোপ থেকে। ডেটিং শব্দকে জগাখিচুড়ি করা হয়েছে। সাদামাটায় ডেটিং বলতে যা বোঝানো হয় তা হলো- কোন একটি নির্দিষ্ট তারিখে (বা সময়ে) নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে প্রণয়ের মানব-মানবী একসঙ্গে বসে কথা বলা। প্রণয়ের মানুষ ছাড়াও ডেটিংয়ে বন্ধুরা যেতে পারে। কোন বন্ধু তার বান্ধবীকে নিয়ে আবার কোন বান্ধবী তার বন্ধুকে নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে আড্ডা দিতে পারে। মনের কথা বলতে পারে। একটা সময় আমাদের সমাজে কোন ছেলের সঙ্গে মেয়ের বা মেয়ের সঙ্গে ছেলের বন্ধু থাকাকে আড় চোখে দেখা হতো। একবিংশ শতকে ছেলেমেয়ের মধ্যে নিটোল বন্ধুত্ব হতে পারে। এই বন্ধুত্ব দুই পরিণত বয়সের আবার মধ্যবয়সীদেরও হতে পারে। যার মধ্যে অস্বাভাবিক কোন কিছু থাকবে না। তারা একসঙ্গে কোথাও বেড়াতে যেতে পারে। একে অপরকে নিমন্ত্রণ করতে পারে। একে অপরের বাড়িতে বেড়াতে যেতে পারে। এই বন্ধুত্ব পারিবারিক বন্ধনের সঙ্গে যোগ হতে পারে। যা হতে পারে মধুময়তার এক নিবিড় বন্ধনের মধুছন্দ। এই ডেটিংকে আমরা ভিন্ন রূপ দিয়ে সুন্দর বন্ধুত্বের মধ্যে অযথা ঘুণপোকা ঢুকিয়ে দিচ্ছি। ডেটিং শব্দটিকে এক্সট্রা মেরিটাল রিলেশন্স বা পোস্ট-মেরিটাল রিলেশন্সের মধ্যে গুলিয়ে ফেলে সুন্দর সম্পর্ককে অসুন্দর করে ফেলছি। ডেটিংয়ের এই ধারায় নতুন প্রেমিক-প্রেমিকাও হতে পারে। বিয়ের আগে ডেটিংয়ে জীবনের ভাললাগার ভালোবাসার কথাগুলোই উঠে আসে। তারা একে অপরকে জানতে-চিনতে পারবে। যদিও প্রেমে পড়লে সবচেয়ে বেশি মিথ্যা কথা বলাবলি হয়। তারপরও বর্তমান প্রজন্ম নিজেদের মেধা দিয়ে একে অপরকে চিনতে পারবে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, টিন এজ; থার্টিন থেকে নাইনটিন অর্থাৎ ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভয় থাকে। তারা কল্পনা ও বাস্তবতাকে গুলিয়ে ফেলে। উচ্চ মাধ্যমিকের পর তারা নিজেদের বুঝতে শেখে। কল্পনা আর বাস্তবতার মধ্যে যে কত ব্যবধান তাও অনুভব করতে পারে। ফ্রয়েডের ভাষায় মানুষের বায়োলজি ও রসায়ন সেই আদিকাল হতেই বহু বর্ণে বিচিত্র। মানব-মানবীর মধ্যে বায়োলজি ও রসায়ন বিয়ের আগে ও বিয়ের পরে সুপ্ত অবস্থাতেই থাকে। এই রসায়ন থেকেই তৈরি হয় হৃদয়ের আকুল আকুতির চাওয়া- পাওয়া। তার অর্থ এই নয় যে সংসারের বাঁধন ছুটে গেল। একঘেয়ে জীবন থেকে কিছুটা সময় বের করে দু’জন মানুষ নিজের কথা শেয়ার করে ফের নীড়ে ফিরে আসা। এই সুন্দর রোমান্টিকতাকে আমরা ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নোংরা করে ফেলছি। বর্তমানে কি শহর, কি গ্রাম সব জায়গাতেই আধুনিকতার ছাপ পড়েছে। একটা সময়ে গাঁয়ের বধূ অবগুণ্ঠনে বসে থাকত। গ্রামের মেয়ে স্কুল-কলেজে যেতে ভয় পেত। আজ সেই গাঁয়ের বধূ মোবাইল ফোনে কথা বলে। গ্রামীণ নারী জিন্স, টি-শার্ট পরে স্কুল-কলেজে যায়। নগর-মহানগরী ছাড়িয়ে মাঠ পর্যায়েও নারী-পুরুষের বন্ধুত্ব হতেই পারে এবং এটাই স্বাভাবিক। সামজিক জীবনের রোমান্টিকতার সুন্দর মধুময়তার এই বিষয়গুলো একশ্রেণীর মানুষ নোংরা করে ফেলছে।
×