ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিস্ফোরণ ঘটিয়েই জঙ্গীরা আত্মহত্যা করেছে বলে ধারণা

চাঁপাইয়ের আস্তানাটি ছিল জঙ্গীদের বিস্ফোরকের ভাণ্ডার

প্রকাশিত: ০৪:৪৪, ৩০ এপ্রিল ২০১৭

চাঁপাইয়ের আস্তানাটি ছিল জঙ্গীদের বিস্ফোরকের ভাণ্ডার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চাঁপাই-নবাবগঞ্জের আস্তানাটি ছিল জঙ্গীদের বিস্ফোরকের ভা-ার। সেখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে বিস্ফোরক এনে মজুদ করা হতো। পাশাপাশি বিস্ফোরক দিয়ে সেখানেই তৈরি করা হতো শক্তিশালী গ্রেনেড। ওই গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়েই জঙ্গীরা আত্মহত্যা করেছে বলে সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে মনে হচ্ছে। বিদেশ থেকে জঙ্গীদের অর্থায়ন করা হয়ে থাকতে পারে। শনিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ডিআইজি মনিরুল ইসলাম এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে গত ২২ এপ্রিল ঝিনাইদহ ও ২৬ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের জঙ্গীবিরোধী দুই অভিযানের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন তিনি। তিনি জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের আস্তানাটি ছিল জঙ্গীদের বিস্ফোরকের ভা-ার বা স্টোর হাউস। সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে মনে হয়েছে, এই বাড়িতে বিভিন্ন জায়গা থেকে বিস্ফোরক এনে মজুদ করা হতো। মজুদকৃত বিস্ফোরক দিয়ে সেখানেই শক্তিশালী গ্রেনেড তৈরি হতো। জঙ্গীদের তৈরিকৃত ওই গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়েই জঙ্গীরা আত্মহত্যা করেছে বলে মনে হয়েছে। অভিযানকালে বারবার জঙ্গীদের আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু তাতে সাড়া দেয়নি জঙ্গীরা। উল্টো পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা ও গুলি চালায়। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। অভিযানে পুলিশের কেউ হতাহত হয়নি। আস্তানা থেকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয় এক নারী ও এক শিশুকে। পরবর্তীতে শিবগঞ্জের মোবারকপুর ইউনিয়নের ত্রিমোহিনী গ্রামে আমবাগান ঘেরা আধাপাকা ওই বাড়িতে বৃহস্পতিবার দু’দিনের অভিযান শেষ করে পুলিশ। অভিযানে আস্তানা থেকে চারজনের লাশ, আগ্নেয়াস্ত্র ও সুইসাইডাল ভেস্ট উদ্ধার হয়। নিহতদের মধ্যে দুজন আত্মঘাতী বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাকি দুজন পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলির সময় মারা যেতে পারে। নিহতদের একজন স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল আলম আবু। আবুর স্ত্রী সুমাইয়া ও এক সন্তানকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়। নিহত অপর তিনজনের মধ্যে নব্য জেএমবির নেতা আবদুল্লাহ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত ২২ এপ্রিল ওই বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছিল। নিহতদের দুজন ঝিনাইদহ থেকে আস্তানায় এসেছিল বলে জিজ্ঞাসাবাদে সুমাইয়া জানায়। ঝিনাইদহ থেকে আসা দুজন বিস্ফোরক নিয়ে আস্তানায় এসেছিল। এ পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, খোলা বাজার থেকে ওই সব বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহার হওয়া বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সংগ্রহ করা হয়েছিল। সেগুলো খুব শক্তিশালী বা উন্নত ছিল না। তবে পরিমাণে বেশি দিয়ে তৈরি করার কারণে বিস্ফোরকগুলো অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। আস্তানায় পাওয়া বিস্ফোরক দিয়ে অন্য নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা ছিল। আস্তানা থেকে সুইসাইডাল ভেস্টের পাশাপাশি চারটি অবিস্ফোরিত বোমাও উদ্ধার হয়। স্ত্রীর হাত ধরে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে নিহত জঙ্গী আবু স্থানীয়দের বরাত দিয়ে ডিআইজি মনিরুল ইসলাম জানান, নিহত আবুর (৩০) পিতার নাম আফসার আলী। সে একজন দিনমজুর। বাড়ি জঙ্গী আস্তানার পাশে চাচরা গ্রামে। আবু চাচরা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করত। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ মসলা বিক্রেতা ছিল। প্রায় নয় বছর আগে সুমাইয়া খাতুনের সঙ্গে বিয়ে হয়। সুমাইয়ার বাড়ি একই উপজেলার আব্বাস বাজারে। আবু শ্বশুরবাড়িতেই থাকত বলে তার মা ফুলছানা বেগম জানান। শুক্রবার রাতে আবুর চাচা ইয়াসিন আলী লাশ গ্রহণ করেন। পরে এ নিয়ে আবুর চাচার ওপর অসন্তুষ্ট হয় পরিবারের লোকজন। পরে পুলিশের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয় পরিবারের তরফ থেকে। আবু ও তার স্ত্রীর পরিবার জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। স্ত্রীর মাধ্যমেই স্বামী-স্ত্রী জামায়াতে ইসলামী ছেড়ে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। জঙ্গীদের অর্থের উৎস সম্পর্কে মনিরুল ইসলাম জানান, জঙ্গীবাদের অর্থের উৎস সম্পর্কে এখনও পুরোপুরি তথ্য মেলেনি। জঙ্গীবাদে কিভাবে অর্থায়ন হচ্ছে তা জানতে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। কোন কোন ঘটনায় কোন কোন ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের জঙ্গীবাদে অর্থায়ন করার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে সবক্ষেত্রে নয়। কোন কোন জঙ্গীর তাদের সম্পত্তি বিক্রি করে সংগঠনে অর্থায়ন করার তথ্য মিলেছে। আবার কেউ কেউ চাকরি করে সংগঠনের তহবিলে অর্থের যোগান দিয়ে থাকে। আবার বিদেশ থেকেও কিছু লোক জঙ্গী অর্থায়ন করে থাকে। যারা বিদেশ থেকে জঙ্গী অর্থায়ন করছে, তারা বাংলাদেশী। এদের অনেকেই বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। আবার অনেকেই চাকরি বা অন্য কোন কাজে বিদেশে থাকে। তিনি আরও জানান, জেএমবি জাল মুদ্রা ব্যবসার মাধ্যমে সংগঠনে অর্থায়ন করে থাকে। একটি বিশেষ দেশে জাল মুদ্রা তৈরি হয়। এর মধ্যে ভারতীয় জাল মুদ্রার পরিমাণই সবচেয়ে বেশি। বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার সম্পৃক্ততার কথা বিভিন্ন সময় তদন্তে এসেছে। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দূতাবাসের একাধিক কর্মকর্তাকে জঙ্গী অর্থায়নের দায়ে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে জঙ্গী অর্থায়নে সহযোগিতা করার অভিযোগে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মকর্তা মাযহার খানকে এবং একই বছরের শেষদিকে ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি (রাজনৈতিক) ফারিনা আরশাদকে প্রত্যাহার করে নেয় পাকিস্তান। সংবাদ সম্মেলনে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান, প্রলয় কুমার জোয়ারদার, রাকিবুল ইসলামসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। নিহত জঙ্গীদের দাফন সম্পন্ন স্টাফ রিপোর্টার চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে জানান, শিবগঞ্জ উপজেলার শিবনগর-ত্রিমোহিনীর জঙ্গী আস্তানায় নিহত চারজনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। শুক্রবার রাত ২টার দিকে শহরের পৌরসভার কবরস্থানে পুলিশের তত্ত্বাবধানে তাদের মরদেহ দাফন করা হয়। সদর থানার ওসি সাবের রেজা জানান, জঙ্গী আবুর মরদেহ তার পরিবার গ্রহণ না করায় এবং বাকি তিনজনের পরিচয় না পাওয়ায় চারজনের মরদেহ দাফন করা হয়েছে। ওই জঙ্গী আস্তানা থেকে বৃহস্পতিবার বিকেলে নিহত আবুর ছয় বছরের শিশুকন্যা সাজিদাকে আহত এবং তার স্ত্রী সুমাইয়াকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। সুমাইয়া বর্তমানে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এবং মেয়ে সাজিদাকে আদালতের মাধ্যমে সেফ হোমে পাঠানো হয়েছে। ওই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে শিবগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে। মামলার বাদী হয়েছেন শিবগঞ্জ থানার এসআই আব্দুস সালাম। মামলায় নিহত জঙ্গী আবুর স্ত্রী সুমাইয়া বেগমকে একমাত্র আসামি করা হয়েছে।
×