ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার সোনালি দিন

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ৩০ এপ্রিল ২০১৭

প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার সোনালি দিন

॥ পর্ব- পাঁচ ॥ এর আগে চার সপ্তাহজুড়ে আমরা এই বিষয়ের চারটি পর্ব প্রকাশ করেছি। যারা বাংলা ভাষাকে নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগেন বা যারা মনে করেন বাংলা ভাষার কোন ভবিষ্যত নেই তাদের জন্য সেই চার পর্বে আমরা বাংলা ভাষার সাম্প্রতিকতম অগ্রগতির কথা বর্ণনা করেছি। প্রাসঙ্গিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের গ্রহণ করা ১৫৯ কোটি টাকার প্রকল্পটি নিয়েও আলোচনা করেছি। এই প্রকল্পটিতে কি আছেÑ বাংলা ভাষার জন্য কোন কোন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে সেসব বিষয়ও আলোচনা করেছি। আমাদের এই পর্বটি উপসংহারের ও শেষ পর্ব] অপ্রিয় হলেও সত্য যে, ভাষার ভিত্তিতে জন্ম নেয়া রাষ্ট্রে বাংলা ভাষাকে বিপন্ন করার প্রয়াস সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। বাংলাভাষীরাই মনে করে যে- বাংলা কঠিন ভাষা। এটি লেখা কঠিন। সম্ভবত সঠিক প্রমিত উচ্চারণ করাও কঠিন। তাদের ধারণা, ইংরেজী ছাড়া এখন এই দুনিয়াতে বেঁচে থাকা যাবে না। আমরা লক্ষ্য করে যাচ্ছি যে, সেই কারণে মোবাইলের এসএমএস হোক বা ফেসবুকের স্ট্যাটাস হোক রোমান হরফের রাজত্ব চলে। অনেকে বাংলা লিখতে না পারার জন্য এই কাজটি করে থাকেন। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে কোন ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলা লেখার কোন ধরনের সীমাবদ্ধতা নেই। কিন্তু বাংলাভাষীদের অক্ষমতার জন্য আজ বাংলা ভাষা ও বঙ্গলিপি নির্বাসিত হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে ব্যবহারিক জীবনসহ সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে বাংলার ব্যবহার কমছে। ডিজিটাল করার নামে অবস্থা আরও খারাপ করা হচ্ছে। সরকারের অনেক প্রকল্প ডিজিটাইজ করার নামে বাংলাকে বিসর্জনই দিয়ে রেখেছে। সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে, বাংলা ভাষা দিয়ে দুনিয়াতে টিকে থাকা যাবে না। ফলে যেখানে বাংলা ব্যবহার করা যায় সেখানেও ইংরেজী ব্যবহার করা হয়। আমার নিজের ধারণা তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ব্যবহার করার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সক্ষমতার বিষয়টি খুব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। বাংলা ভাষায় যদি ও.সি.আর ব্যবহার করা যায় তবে সবচেয়ে বড় উপকারটি হবে যে আমরা আমাদের প্রাচীন বইপত্রসহ বাংলার তথ্য উপাত্ত খুব সহজে ডিজিটাল করতে পারব। বাংলার যান্ত্রিক অনুবাদ বিশ্ব জ্ঞান ভা-ারকে বাংলায় আনা সম্ভব হবে। কথা থেকে লেখা ও লেখা থেকে কথার প্রযুক্তি এবং বাংলা বানান ও ব্যাকরণ শুদ্ধিকরণ সেইসব মানুষকে সহায়তা করবে যারা বাংলা ব্যবহার করতে চান না। বস্তুত বর্তমানে আমরা তথ্য প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা ব্যবহার করার ক্ষেত্রে যেসব প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কথা অনুভব করি। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের এই প্রকল্পের সহায়তায় সেটি অতিক্রম করা যেতে পারে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, বিশ্বের অন্যতম সেরা বাংলা ভাষা এর ফলে সহস্র বছরের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে বিশ্বের সেরা প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ ভাষায় পরিগণিত হবে। প্রসঙ্গত এই কথাটি মনে রাখা দরকার যে ইংরেজী ছাড়া বিশ্বের ভাষাসমূহ প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার জন্য পিছিয়ে পড়েছিল। স্মরণ করা যেতে পারে বাংলা ভাষা ১৪৫৪ সালে আবিষ্কৃত মুদ্রণ যন্ত্র ব্যবহারে সক্ষম হয় ১৭৭৮ সালে। আমরা ১৮৭০ সালের টাইপরাইটার পাই ১৯৭২ সালে। কিন্তু ১৯৮৭ সালে আমরা দুনিয়ার সঙ্গে ডেস্কটপ প্রকাশনা বিপ্লবে অংশ নিতে পারি। এখন প্রযুক্তি আমাদের জন্য সুসময় নিয়ে এসেছে। আজকের দিনে আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করে রোমান বা ইংরেজী ছাড়া অন্য ভাষাসমূহকেও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা দিতে পারি। আমরা চাইলেই আমাদের নিজেদের সন্তানদের দিয়েই বাংলা ভাষার উন্নয়নে অনেক প্রযুক্তিগত সক্ষমতা তৈরি করতে পারব। আমি প্রকল্পটি গ্রহণ করার পর নানাভাবে নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখেছি যে তারা অনেকেই নিজেদের মতো করে অনেক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। অনেকে এসব প্রযুক্তি প্রকাশ করতে পারেননি বা তাদের কাজ তারা শেষ করতে পারেননি। এই প্রকল্পের একটি বড় সার্থকতা হতে পারে যে এই স্বেচ্ছাসেবী জনগোষ্ঠীকে সমন্বিতভাবে বাংলা ভাষার উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারি। আমি লক্ষ্য করেছি যে কেবল বাংলাদেশ নয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গও বাংলা ভাষার উন্নয়নে কাজ করছে। এই প্রকল্পের কাজের সময় তাদের কাজগুলোর কথাও মাথায় রাখা যেতে পারে। আমি একটি কাজের বিবরণ পেলাম যেটা আমাদের কাজগুলোর সঙ্গে সমন্বিত হতে পারে। খড়গপুরের আইআইটি বাংলা সার্চ ইঞ্জিন তৈরির জন্য দুই বছর মেয়াদী একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। আমাদের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ও পিপীলিকা নামে একটি বাংলা সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করেছে। দুটিকে সমন্বিতও করা যেতে পারে। সূত্র:যঃঃঢ়://িি.িবঢ়ধঢ়বৎ.বরংধসধু.পড়স/উবঃধরষং.ধংঢ়ীরফ=৩১০৯৪্নড়ীরফ=১৫৪৪৬৪১৯ এই প্রকল্পটি গ্রহণ করার জন্য ধন্যবাদ দেবার পাশাপাশি আমি মনে করি যে এটি বাস্তবায়ন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এতদিন আমাদের শঙ্কা ছিল যে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার উন্নয়নে অর্থের সংস্থান হবে কেমন করে। এখন সম্ভবত সেই ভাবনাটি আমাদের ভাবতে হচ্ছে যে, এই কাজগুলো সম্পন্ন হবে কেমন করে। বাংলার ভাষাবিজ্ঞানী ও তথ্যপ্রযুক্তি বিজ্ঞানী উভয়ের সমন্বিত প্রচেষ্টায় আমরা এই প্রকল্পের সফলতা কামনা করি। ভাষার জন্য রক্ত দেয়া জাতি হিসেবে আমরা কোনভাবেই এটি সফল হবার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হতে পারি না। আশা করি তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ প্রকল্পটিকে অন্য দশটি প্রকল্পের মতো বিবেচনা করবেন না। আমি অপ্রিয় হলেও এই কথাটি বলতে চাই যে, অতীতে বাংলা ভাষা নিয়ে যারা কাজ করেছেন তারা সমন্বিতভাবে সেটি করেননি। যারা যে কাজের দায়িত্বে রয়েছেন তারাও সমন্বিতভাবে কাজটি করাননি। একই কাজ বহুজনে করেছেন। বস্তুত বার বার চাকা আবিষ্কারের ঘটনা ঘটেছে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বাংলা ভাষার এই টুলসগুলো উন্নয়ন করার জন্য আমাদের সক্ষমতা কি হতে পারে তার অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখেছি যে বাংলা নিয়ে কাজ কেবল আমাদেরই করার বিষয় নয়। এরই মাঝে এ্যাপল, মাইক্রোসফট, গুগল ও ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠান বাংলা নিয়ে কাজ করছে। তাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা সন্দেহাতীত বলেই তাদের উন্নয়ন করা প্রযুক্তিগুলো যদি সরকার সংগ্রহ করতে পারে তবে অনেক ক্ষেত্রেই এই প্রকল্পটিতে সহায়তা পাওয়া যাবে। তবে এসব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নিজেদের ব্যবসার বিষয়টি ঠিক রেখে এবং অন্যদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতাকে প্রতিযোগিতার কোন স্তরে দেখবেন তার ওপরে নির্ভর করবে যে তারা এই প্রকল্পে কতটা সহায়তা করবে। তবে তাদের কর্মকা- থেকে এই কথাটি খুব সহজেই বলা যায় যে, বাংলাভাষী বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রতি এই সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোরও নজর পড়েছে। তারাও চাইছে তাদের প্রযুক্তিতে যেন বাংলা ভাষার ব্যবহার সহজ হয়। আমরা এটাও জানি যে, এটুআই-এর সহায়তায় ইউনাইটেড বিশ্ববিদ্যালয়, আইআরডিসির সহায়তায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারের সহায়তায় স্টিম ইঞ্জিন ও.সি.আর ও অন্যান্য প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেছে। এরই মাঝে আমি আরও অনেককে এসব প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন বলে দাবি করতে জেনে আসছি। আমি আশা করব তারা সবাই মিলে বাংলা ভাষার প্রযুক্তিগত সক্ষমতার বিষয়টি ইংরেজীর সমকক্ষ স্তরে উন্নীত করতে পারবেন। ভেবে দেখুন তো যদি কেউ বাংলায় কথা বলে এবং সেটি অন্য কেউ সেটি ইংরেজীতে অনূদিত অবস্থায় শুনতে পায় বা কেউ ইংরেজীতে কথা বললে আমি যদি বাংলায় বুঝতে পারি তাহলে তথাকথিত ইংরেজী প্রীতির বিষয়গুলো হারিয়ে যেতে পারে। যদি এমন হয় যে আমি মুখে বাংলায় কথা বললাম আর কম্পিউটার সেটি টাইপরিটেন অবস্থায় রূপান্তর করল বা ডিজিটাল যন্ত্রই লিখিত বাংলা পাঠ করে দিলে বাংলার অক্ষমতাসম্পন্ন মানুষগুলো অনেকটাই হাঁফ ছেড়ে বেঁচে যাবে। আমি নিজে মনে করি যে এখন আমরা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে এমনভাবে প্রয়োগ করতে পারি যা ইংরেজীসহ দুনিয়ার অন্য কোন ভাষাও ব্যবহার করেনি। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের আলোচিত প্রকল্পের আওতায় মোট ষোলোটি টুলসের কথা বলা হলেও বস্তুত এর পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। কারণ, প্রতিদ্বন্দ্বী বা উপজাতীয় উভয় শ্রেণীতেই একাধিক টুলস উন্নয়ন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আবার বাংলার জন্য উন্নয়ন করা টুলসগুলোর বেশ কটি উপজাতীয় ভাষার জন্যও করা যেতে পারে। এই টুলসগুলো কয়েকটি হয়ত প্রথাগত, তবে অনেকগুলোতেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা বিগ ডাটা বিশ্লেষণের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। সর্বশেষ অবস্থা : সরকারের এই প্রকল্পটির সর্বশেষ অবস্থা হচ্ছে যে ড. জিয়া নামক একজনকে এই প্রকল্পের পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি কাজে যোগ দিয়েছেন এবং প্রকল্পের জনবল ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্পটি নিয়ে একটি বড় পরিসরের আলোচনা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাও করা হয়েছে। এরই মাঝে এই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নিজেও সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গেই প্রকল্পটি নিয়ে কথা বলেছেন। এই মুহূর্ত পর্যন্ত সকল স্তরের মানুষদের কাছ থেকেই প্রকল্পের জন্য সহায়তা পাবার আশ্বাস পাওয়া গেছে। যতদূর জেনেছি প্রকল্পের জন্য পরামর্শক নিয়োগের কাজও চলছে। (সমাপ্ত)
×