ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কাজী জয়নুল আবেদীন বীরপ্রতীক

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান কোন্ পথে

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ৩০ এপ্রিল ২০১৭

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান কোন্ পথে

(গতকালের পর) স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে উপজাতীয় নেতা চারু বিকাশ চাকমার নেতৃত্বে কয়েকজন উপজাতীয় নেতা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের অনেক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে দেখা করে উপজাতীয়দের জন্য পৃথক সাংবিধানিক রক্ষাকবচের দাবি জানান। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত করলে তিনি তাদের আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, সরকারী চাকরিতে তাদের জন্য বিশেষ কোটার ব্যবস্থা থাকবে। তাদের ঐতিহ্য ও কৃষ্টি পুরোপুরিভাবে সংরক্ষণ করা হবে এবং তাদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু উপজাতিদের চাওয়া ছিল তার চেয়ে বেশি। ক’দিন পর মং রাজা মং প্রু চাঁইয়ের নেতৃত্বে একটি দল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। সে দলে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, বিনিতা রায়, কেকে রায় প্রমুখ নেতা ছিলেন। তারা যেসব দাবি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন তার মধ্যে ছিল : ক. পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হবে এবং এর একটি নিজস্ব আইন পরিষদ থাকবে। খ. উপজাতীয় জনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্য ১৯০০ সালের রেগুলেশন-১-এর মতো অনুরূপ বিধি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। গ. পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয় নিয়ে কোন শাসনতান্ত্রিক সংশোধন বা পরিবর্তন যেন না হয় এরূপ বিধি ব্যবস্থা সংবিধানে থাকবে। ঘ. উপজাতীয় রাজাদের দফতর সংরক্ষণ করতে হবে। উপজাতি নেতাদের উপরোক্ত দাবিগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তারা ছয় দফার মতো দাবি উত্থাপন করে শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার লক্ষ্যে অগ্রসর হতে চেয়েছেন। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য স্বায়ত্তশাসন এবং পৃথক আইন পরিষদ দাবি করেছেন। ১৯০০ সালের রেগুলেশন-১-এর অনুরূপ বিধান দাবি করার অর্থ হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালীদের প্রবেশ ও বসবাস নিষিদ্ধকরণ। পরবর্তী সময় তাদের ৫ দফা দাবির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী বাঙালীদের প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবি ছিল। তারা কখনও তাদের এসব দাবি থেকে সরে আসেনি। পার্বত্য এলাকায় ১৩/১৪টি জাতিগোষ্ঠী মিলে উপজাতিদের লোকসংখ্যা ১৯৭৪ সালের আদমশুমারি মোতাবেক ৫,০৮০০০, ১৯৮১ মোতাবেক ৮,০৮৪৫০ এবং ৯১ মোতাবেক ৯,৬৭৪০০ জন। ১৩/১৪টি জাতিতে বিভক্ত সে সময়ের ৭ লাখ লোকের এই জনগোষ্ঠীর জন্য পার্বত্য অঞ্চলের নেতারা স্বায়ত্তশাসন এবং পৃথক আইন পরিষদ দাবি করেছে। ’৭২ সালেই উপজাতি নেতারা জনসংহতি সমিতি গঠন করেন। পরে সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে শান্তিবাহিনী গঠন করেন। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। সে সময় উপজাতি নেতাদের কয়েকজন আমাকে বলেছিলেন যে, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাসহ যারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তারা বঙ্গবন্ধুকে নাকি বলেছিলেন যে, ‘আমাদের উপজাতিদের কিছু সমস্যা রয়েছে সে ব্যাপারে আলোচনা করতে এসেছি।’ তখন বঙ্গবন্ধু নাকি বলেছিলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে কোন উপজাতি থাকবে না। আমরা সকলেই এক জাতি’। বঙ্গবন্ধুর এ কথার প্রেক্ষিতেই উপজাতি নেতারা প্রচার করেছেন, বঙ্গবন্ধু তাদের বাঙালী হতে বলেছেন। যেহেতু স্বাধীন গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষ সমান মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করে থাকে। যেহেতু উপজাতি কথাটির মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন বৈষম্য রয়েছে, হয়ত সে কারণেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘স্বাধীন দেশে কেউ উপজাতি নেই, সবাই বাংলাদেশী।’ কিন্তু বামপন্থী উপজাতি নেতারা সেটার ভুল ব্যাখ্যা করে প্রচার করেছেন যে, ‘বঙ্গবন্ধু সবাইকে বাঙালী হতে বলেছেন।’ ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু যখন রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ উদ্বোধনের জন্য গিয়েছিলেন তখন তিনি উপজাতি নেতাদের উপস্থিতিতে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে বলেছিলেন, ‘লারমা তুই কি চাস বল। তুই যা চাইবি সেটাই হবে।’ লারমা বাবু তখন বঙ্গবন্ধুর পা ধরে সালাম করেছেন। বঙ্গবন্ধু তাকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সেরকম উপজাতি নেতাদের অনেকে আমাকে এ কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বিষয়টি রাজনৈতিকভাবেই মীমাংসা হয়ে যেত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর যখন জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখল করলেন তখন তাকে উপজাতি নেতারা তাদের সমস্যার কথা অবগত করেছেন এবং সমাধান চেয়েছেন। জিয়াউর রহমান আলোচনার মাধ্যমে উপজাতিদের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের দিকে না গিয়ে বল প্রয়োগ করে সমাধান করতে চেয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অতিরিক্ত সেনা নিয়োগ করা হলো, ভূমিহীন বাঙালী পরিবারদের নিয়ে গিয়ে প্রত্যেক বাঙালী পরিবারকে ৫ একর জমি দিয়ে সেখানে তাদের বসতি স্থাপন করা হলো। উপজাতিরা ভয় পেয়ে ৫০ হাজারের বেশি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে গিয়ে আশ্রয় নিল। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছে শুনেছি উপজাতিদের অনেকে রাখাইন রাজ্যে গিয়ে বসবাস করছে। তবে তারা সে সময় গিয়েছে কিনা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা সেটা বলতে পারে না। উপজাতিরা শান্তিবাহিনী গঠন করে দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সন্ত্রাস চালিয়েছে। তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল সেখানে বসবাসরত বাঙালীরা এবং সেনাবাহিনী। এতে বহু বাঙালী ও সেনা সদস্য হতাহত হয়েছে, উপজাতিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘ সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত আতঙ্কাগ্রস্ত এবং অনিরাপদ অঞ্চল ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা আন্তর্জাতিক সমস্যার রূপ লাভ করেছিল। অবশেষে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা উপজাতি নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে শান্তি চুক্তি করেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হলো। সেখানে শান্তি ফিরে এলো। ফিরে আসছি মূল প্রসঙ্গেÑ রোহিঙ্গা সমস্যা একটি ধর্মীয় ও জাতিগত সাম্প্রদায়িক সমস্যা। যুগে যুগে বিশ্বের দেশে দেশে গোত্রে গোত্রে, জাতিতে জাতিতে ধর্মীয় বা জাতিগত বিদ্বেষের কারণে সংঘর্ষ হয়েছে। মানুষ, মানবতা, সম্পদ ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সকল ধর্মই হিংসা-বিদ্বেষ, সন্ত্রাস ও সংঘর্ষের বিরুদ্ধে এবং শান্তির পক্ষে। কিন্তু ধর্মের কারণে আজও দেশে দেশে সন্ত্রাস ও সংঘর্ষ হচ্ছে। মানুষ, মানবতা ও ধর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার কারণে ভারত ভেঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান দুটি শত্রু রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে, বাংলা বিভক্ত হয়ে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। হিন্দু-মুসলমান দুটি প্রতিপক্ষ জাতিতে বিভক্ত হয়েছে। ভারত বিভাজনের সময় সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় উভয় সম্প্রদায়ের অর্ধকোটি মানুষ হতাহত হয়েছে। দুই কোটির বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। উভয় জাতির মধ্যে চিরশত্রুতা সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টির পিছনে বাঙালী মুসলমানরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু পাকিস্তানে বাঙালীরা অবজ্ঞা, অবহেলা, বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে। তাদের কবল থেকে মুক্ত হতে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালী শহীদ হয়েছে, ৪ লক্ষাধিক নারী নির্যাতিত হয়েছে, কোটি কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু পূর্ব বাংলার মুসলমানরা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। বৌদ্ধ ধর্মের মূলমন্ত্র শান্তি। কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সে দেশের রাখাইন মুসলমানদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহতভাবে নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়ে আসছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রাখাইন রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের গণহত্যা, গণধর্ষণসহ সকল প্রকার মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকারে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের রক্ষার ব্যবস্থা না করে রাষ্ট্রীয়ভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়ন চালাচ্ছে। তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে তাদের রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে। আত্মরক্ষার জন্য রোহিঙ্গারা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমার সরকার তাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার যে কোন প্রকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে উগ্র ধর্মবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী রয়েছে, তারা রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। মিয়ানমারের সঙ্গে একই উপকূলের মুসলিম রাষ্ট্র মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশের মুসলমানদের অনেকেই রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। সিরিয়া এবং ইরাকে মুসলিম উগ্রবাদীরা খেলাফত প্রতিষ্ঠার নামে সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত রয়েছে। প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, অসহায় রোহিঙ্গারা এসব মুসলিম উগ্রবাদীদের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তন হলে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে এ অঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে, যা কারও জন্যই মঙ্গলজনক হবে না। মিয়ানমার সরকারের উচিত হবে রোহিঙ্গা সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান করা। রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের নাগরিক সেটা স্বীকার করে বাংলাদেশসহ যেসব দেশে রোহিঙ্গারা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে তাদের ফিরিয়ে নিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। (সমাপ্ত) লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি
×