ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ঝরে পড়ছে ৫০ হাজার মেট্রিক টন এবার মৌসুমি পাকা আম পাড়তে বিধিনিষেধ নেই

চাঁপাইয়ে ঝরে পড়া আমের জমজমাট ব্যবসা

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৯ এপ্রিল ২০১৭

চাঁপাইয়ে ঝরে পড়া আমের জমজমাট ব্যবসা

ডি, এম তালেবুন নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ দীর্ঘ দুই মৌসুম শেষে এবার আগাম স্বস্তি ফিরে এসেছে আম চাষী ও আম বাগান মালিকদের মধ্যে। কারণ, এবার প্রশাসন প্রাকৃতিকভাবে পাকা আম পাড়া বা বাজারজাতকরণে এখন পর্যন্ত কোন ধরনের বিধিনিষেধ জারি করেনি। তবে ফরমালিন ছাড়া বিষমুক্ত আম নিয়ে কোন ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি হতে না পারে তার জন্য সজাগ দৃষ্টি রেখেছে। প্রশাসন স্থানীয়ভাবে উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাগার, কৃষি সম্প্রসারণ ও কল্যাণপুর হর্টিকালচারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেছে। তাদের পরামর্শ মোতাবেক প্রাকৃতিকভাবে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কোন্ কোন্ গুটি গাছে আম পাকতে শুরু করলে, তা বিষমুক্ত রেখে বাজারজাতকরণে আম চাষীদের কোন ধরনের অসুবিধা এবার হবে না। তবে কেউ কোনভাবে কাঁচা আম গাছ থেকে নামিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে ফরমালিন কিংবা কারবাইড দিয়ে পাকানোর চেষ্টা করলে তাদের বিরূদ্ধে প্রশাসন সর্বোচ্চ কঠোরতা দিয়ে তা মোকাবেলা করতে একটুও দ্বিধা বোধ করবে না। আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম গবেষক ও উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানান প্রাকৃতিকভাবে কোন গাছের আম পাকলে এবার প্রশাসন কোনভাবেই প্রতিহত না করে সহযোগিতা দেবে। যাতে করে কোন আম চাষী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। বিষয়টি নিয়ে তাদের একাধিকবার প্রশাসনের সঙ্গে কথা হয়েছে। খুব সম্ভব আম পাকতে শুরু করলেই মে মাসের কোন এক সময়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে বলে জানা গেছে। এবার ম্যাংগো ইয়ার হওয়ার কারণে এবং মৌসুম অনুকূলে থাকায় জেলাজুড়ে আমের ফলন দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। জেলায় এবার আমের উৎপাদন সাড়ে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। তবে প্রচ- খরা ও তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস অতিক্রম করায় এবং জেলার প্রধান নদী পদ্মা, মহানন্দা, পাগলায় পানি প্রবাহ কমে আসার কারণে শিবগঞ্জ, গোমস্তাপুর ও ভোলাহাট অঞ্চলের বড় আম বাগানের শতাব্দী প্রবীণ গাছের শিকড় ভূগর্ভের পানি পাচ্ছে না। ফলে গাছের ডগার আমে পানি সরবরাহ করতে পারছে না। একদিকে খরা ও অপরদিকে ভূগর্ভের পানি একবারে তলানিতে (দেড়শ ফুটের নিচে) চলে যাওয়ার কারণে রাতদিন মিলিয়ে প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় ঝরে পড়েছে আমের গুটি। যার পরিমাণ প্রায় প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন। আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও আম গবেষক ড. স্বরূপের মতে, জেলায় সবচেয়ে বেশি গুটি ঝরে পড়েছে উন্নত জাত ল্যাংড়া আমের গাছ হতে। গত বছরে একটি সমীক্ষার রেশ টেনে তিনি বলেন, উত্তর-দক্ষিণে ৮.৫ মিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে ৮.২ মিটার বিস্তৃত ও উচ্চতায় ১২ মিটার একটি ল্যাংড়া গাছ থেকে ৩৮ হাজার গুটি ঝরে পড়ার পরেও কৃষকের কাক্সিক্ষত ফলন হয়েছে। যার পরিমাণ প্রায় পরিপক্ব অবস্থায় ১০ থেকে ১২ মনের কাছাকাছি। জেলায় ৩০ হাজার ১২ হেক্টর জমিতে ২২ হাজার ৪১২টি ল্যাংড়া আম গাছ রয়েছে। তবে ল্যাংড়া আমের অধিকাংশ গাছ বড়। ছোট জাতের গাছের সংখ্যাও কম নয়। জেলায় ১১টি জাতের প্রায় ২১ লাখ আম গাছ রয়েছে। তার মধ্যে গোপালভোগ, খিরসাপাত ও বোম্বাই জাতের গাছ রয়েছে প্রায় ৭ লাখের কাছাকাছি। ফজলী ও আশ্বিনা রয়েছে ৯ লাখের কাছাকাছি। এছাড়াও লক্ষণভোগ, আম্রপলি, মল্লিকাসহ শতাধিক গুটি জাতের গাছ রয়েছে প্রায় ১০ লাখের মতো। এর মধ্যে খিরসাপাতের ঝরে পড়ার আনুপাতিক হার কম হলেও অধিকাংশ জাতের ঝরে পড়ার হার ৮০ শতাংশের কাছাকাছি। তাই প্রতিদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, বারঘরিয়া, মহারাজপুর, রানীহাটি, শিবগঞ্জ, কানসাট, রহনপুর, ভোলাহাটসহ প্রায় সহস্রাধিক বাজারে ঝরে পড়া টক গুটি আমের বাজার বসে সকালে। যার মোট পরিমাণ হাজার টনের কাছাকাছি। প্রকার ভেদে এসব ঝরে পড়া টক গুটি আমের বিক্রি বাট্টা হয়ে থাকে ২০ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে। এর বাইরেও প্রতিদিন প্রায় শতাধিক ট্রাক এসব আমের গুটি নিয়ে চলে যাচ্ছে দেশের বিশেষ বিশেষ গন্তব্যে। এই অঞ্চলে প্রবাদ রয়েছে, প্রতি গাছে যে হারে আম ধরে বা পাকার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত টিকে থাকলে একটি গাছেরও ডালপালা থাকবে না। ভেঙ্গে পড়বে। প্রতিটি গাছে আনার এক পাই আম (শতকরা ১-২ ভাগ) টিকলেও কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এখন পর্যন্ত খরা ছাড়া জেলায় কোন বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা কালবৈশাখী বয়ে যায়নি। তবে এখনও এ ধরনের বিপদমুক্ত নয় আম বাগান। আম পাকা পর্যন্ত যে কোন সময় প্রাকৃতিক বিপর্যয় হতে পারে। আর একবার প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে আম চাষীরা নিশ্চিত পথে বসে যায়। যার কারণে লাভ হলে ছাপ্পড় ফেড়ে হয়। আর বিপর্যয় হলে টাকা দূরে যাক পয়সার মুখও দেখতে পাই না। এবার প্রথম থেকেই আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আম বাগান মালিক থেকে শুরু করে আম চাষী ও সংশ্লিষ্ট কয়েক লাখ মানুষ দারুণভাবে উৎসাহিত হয়ে লাভের আশায় চাতকের মতো চেয়ে রয়েছে। বাড়তি আশ্বাস মিলেছে, প্রশাসনের কাছ থেকে। এবার প্রাকৃতিকভাবে পাকা আম গাছ থেকে নামাতে বা বাজারজাতকরণে বাধা দেবে না প্রশাসন। তাই কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ৮২ হাজার ৯৮ হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৫ লাখ মেট্রিক টন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা নেমে ৩৫ লাখ মেট্রিক টন ছুঁই ছুঁই করবে। তবে দেশের একমাত্র বৃহত্তর আম উৎপাদনকারী এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী অঞ্চলে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বেড়েছে। ঠেকেছে গিয়ে ৫০ হাজার হেক্টরে। এ দুটি জেলায় আম উৎপাদনের পরিমাণ আশা করা হচ্ছে গতবারের চেয়ে দ্বিগুণ। এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ গুটি প্রায় মিনিটে মিনিটে বেড়ে আকার বড় হচ্ছে। তার পরেও আম পাড়তে এবার মে মাসের অর্ধেক হয়ে যাবে। তবে এবার আম মৌসুমের সঙ্গে রোজা এসে পড়ায় বাজারে আমের চাহিদা থাকবে খুবই বেশি। কৃষকরা দামও পাবে আশানুরূপ। তবে কৃষি সম্প্রসারণ ও আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর ফল গবেষণাগার খুবই সজাগ রয়েছে আমের পোকার যে কোন রোগ দমনে। এবার চাঁপাই জেলাজুড়ে আমের ফাংগাস দমনে আম গবেষকরা নানান ধরনের কীটনাশক প্রয়োগের পরামর্শ দিয়ে চলেছে। মৌসুমে প্রায় আড়াই থেকে চার কোটি টাকার কীটনাশক বিক্রি হয়। এছাড়াও জেলার প্রায় ৮ লাখ ছোট বড় আম বাগানে পোকার আক্রমণ ঠেকাতে নিবিড় পরিচর্যা চলছে। তবে দিনের বেলায় প্রচ- গরম ও রাতের বেলায় ঠা-া থাকায় মহা পোকার আক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ার কারণে আম চাষীরা কিছুটা হলেও দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে। ইতোমধ্যেই ছত্রাকের আক্রমণ কোন কোন বাগানে দেখা দিয়েছে। জেলার আম গবেষণাগার বলছে, প্রচ- খরায় আমের কিছুটা ক্ষতি হলেও তা রুখে দিতে আম চাষীদের মাঝে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। পাশাপাশি আম চাষীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তবে অভিযোগ উঠেছে, কিছু এনজিও প্রশিক্ষণের নামে সমাবেশ করলেও তাতে আম চাষী দেখা যাচ্ছে না। এনজিও তাদের বরাদ্দ পয়সা খরচ করে প্রচার চালাচ্ছে প্রশিক্ষণের। গত বছর সরকারী হিসাবে আমের উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। এবার আমের জমি বেড়ে আম বাগানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ হাজার হেক্টরের কাছাকাছি। গত বছর থেকে ব্যাপকহারে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম রফতানি হওয়া শুরু হয়েছে। চাঁপাই চেম্বারের এক সেমিনারে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান বেগম মাফরুহা সুলতানা বলেছেন এ বছর এখান থেকেই ১ লাখ মেট্রিক টন আম রফতানি হবে। আম বাংলাদেশের অতি জনপ্রিয় ও সুস্বাদু ফল। বর্ণ গন্ধে অতুলনীয়। পাকা আমের মতো এত ক্যারোটিন কোন ফলে নেয়। একটি পাকা আমে ক্যারােটিন রয়েছে ৮৩০০ মাইক্রোগ্রাম। ভিটামিন সি ৪১ মিলিগ্রাম। ভিটামিন বি ও খনিজ উপাদানেও ভরপুর। তাই জাতীয় বৃক্ষ আম গাছের ব্যাপক বিস্তৃতির জন্য সম্প্রসারণ হচ্ছে পাহাড়ীসহ সমগ্র দেশে। তবে নামলা জাত গৌড়মতি সাড়া জাগিয়েছে সমগ্র দেশে। পাশাপাশি চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র (সাবেক আম গবেষণাগার) চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৩টি জাত অবমুক্ত করায় একাধিক সুস্বাদু ও উচ্চ ফলনশীল জাত উপহার দিতে পেরেছে। তার মধ্যে বারি-৩ জাত কাঁচা অবস্থায় খুবই সুস্বাদু ও মিষ্টি। পাকলে এর তুলনা হয় না। যত খরা ততই আমের মিষ্ঠতা বেড়ে চলবে। এক কথায় জেলায় বেড়েছে কাঁচা-মিষ্টি আমের উৎপাদন।
×