ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুই হাজার কোটি টাকা অবদান রাখছে জাতীয় অর্থনীতিতে

ঢাকায় দশ বছরে গড়ে উঠেছে ৩শ’ প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানা

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২৯ এপ্রিল ২০১৭

ঢাকায় দশ বছরে গড়ে উঠেছে ৩শ’  প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানা

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ বর্তমানে দেশে ও বিদেশে প্লাস্টিক পণ্য বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেশ পরিবর্তন ঘটেছে দেশের প্লাস্টিক পণ্যে। একসময় বাংলার ঘরে ঘরে খাবার বাসন থেকে শুরু করে পানির কলস সবই ছিল মাটির তৈরি। কালের বিবর্তনে সেই জায়গাটি দখল করে এ্যালুমিনিয়াম, সিরামিক পণ্য। আর এখন দখল করে আছে প্লাস্টিকসামগ্রী। আগে শুধু ঘরের টুকিটাকি কাজে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে নিত্যপণ্যের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। খেলনাসামগ্রী, অফিসে ব্যবহারের জিনিসপত্র, পোশাক খাতের সরঞ্জাম, ঘরে ব্যবহারের বিভিন্ন তৈজসপত্র, গৃহনির্মাণসামগ্রী, জানালা ও দরজা, চিকিৎসার উপকরণ, গাড়ি ও সাইকেলের যন্ত্রাংশ, কৃষি খাতের জন্য পাইপ ও বড় চৌবাচ্চা, পোল্ট্রি ও মৎস্য খাতের বিভিন্ন পণ্য, কম্পিউটারের উপকরণ হিসেবে প্লাস্টিকের পণ্য তৈরি হচ্ছে। প্লাস্টিকের জিনিসপত্রের একদিকে যেমন দাম কম অন্যদিকে টেকসইও। এছাড়া প্লাস্টিকের পাত্র ভেঙ্গে গেলে তার ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায় না। ভাঙ্গা বা পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের পাত্র আবারও নতুন হয়ে আমাদের হাতে পৌঁছে। প্রাতিষ্ঠানিক হিসেবে যুক্ত না হলেও বর্জ্য প্লাস্টিক রিসাইক্লিং থেকে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান প্রায় ২ হাজার ৮ কোটি টাকার। প্লাস্টিক পণ্য ভেঙ্গে গেলে কিংবা নষ্ট হয়ে গেলে আমরা সেগুলো হয় ফেলে দিই, আর না হলে ভাঙ্গারিওয়ালাদের কাছে কেজি দরে বিক্রি করি। ভাঙ্গারিওয়ালাকে হয়তো আমরা জিজ্ঞেস করি ‘ভাই এগুলো নিয়ে আপনারা কী করেন?’ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা জবাব দেন মহাজনের কাছে বিক্রি করি। কিন্তু তারপরের টুকু হয়তো আমরা অনেকেই জানি না। কী হয় এসব ভাঙ্গা, অকেজো, পরিত্যক্ত প্লাস্টিক দিয়ে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে চোখে পড়ল অন্যরকম দৃশ্য। রাজধানীর লালবাগের ইসলামবাগের বেড়িবাঁধ এলাকায় গিয়ে আপনিও দেখতে পারেন। বৃহস্পতিবার সরেজমিনে বেড়িবাঁধ এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, বিভিন্ন রঙের প্লাস্টিক দানা রোদে শুকাতে দেয়া হয়েছে। গ্রামে যেমন ধান, গমসহ বিভিন্ন শস্য রোদে শুকানোর ধুম পড়ে। ঠিক তেমন দৃশ্যই সেখানে। দূর থেকে দেখে মনে হবে যেন রোদে কৃষকদের শস্য শুকানোর ধুম পড়েছে। ছোট ছোট বিভিন্ন রঙের প্লাস্টিকের দানা রোদে শুকানো হচ্ছে কেন আর এসব দিয়ে কী করা হয় এ বিষয়ে কথা হয় সেখানকার প্লাস্টিক ব্যবসায়ী আলতাবের সঙ্গে। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, পরিত্যক্ত প্লাস্টিক আমরা প্রথমে ভাঙ্গারিওয়ালাদের কাছ থেকে কিনি। তারপর বাছাই করে ভিন্ন রঙের প্লাস্টিক আলাদা করি। পরের ধাপ হচ্ছে সেগুলো কাটিং মেশিনে কেটে এভাবে ছোট ছোট টুকরো করা হয়। এগুলোকে আমরা প্লাস্টিক দানা বলি। তারপর এগুলো পানিতে ধুয়ে রোদে শুকাতে হয়। রোদে শুকানোর পর এগুলো পাঠানো হয় মেশিনে, যেখানে ছোট ছোট টুকরা গলিয়ে তাতে আবার প্রয়োজনীয় রং মিশিয়ে ‘গুলি’ বানানো হয়। এরপর সেই ‘গুলি’র সাহায্যে প্লাস্টিকের বিভিন্ন ছোট-বড় পণ্য তৈরি করা হয়।’ এভাবেই রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক থেকে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিক পণ্য তৈরি করা হয়। পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীরচর, ইসলামবাগ, লালবাগসহ রাজধানীর পুরান ঢাকার ৩০০ কারখানায় রিসাইক্লিং থেকে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে তৈজস প্লাস্টিক পণ্য। মাত্র ১০ বছরে এ ধরনের কারখানা হয়েছে প্রায় ৩০০। নগরীর কুটির শিল্প হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে এটি। প্রাতিষ্ঠানিক হিসেবে যুক্ত না হলেও বর্জ্য প্লাস্টিক রিসাইক্লিং খাত থেকে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান প্রায় ২ হাজার ৮ কোটি টাকার। শুধু ঢাকায় প্রতিদিন ৩৮১ দশমিক ৩৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। যা ১ বছরে দাঁড়ায় ১ লাখ ৪০ হাজার টন। প্রতিদিন হাজার হাজার বোতল নিয়ে কারবার করেন খাইরুল বারী। দশ বছরে আগে শুরু করেছিলেন এ ব্যবসা। এই দশ বছরেও ব্যবসার উন্নতি এবং গৌরব দুটিই বেড়েছে। খাইরুল বারী জনকণ্ঠকে বলেন, পরিত্যক্ত প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের ফলে ব্যাপক জলাবদ্ধতার হাত থেকে আমরা নিস্তার পাচ্ছি। আমরা এই মালগুলো রিসাইক্লিং করায় টোকাইরা এসব বোতল বিভিন্ন জায়গা থেকে তুলে এনে আমাদের কাছে বিক্রি করছে এবং বিনিময়ে টাকা নিচ্ছে। আমরা এগুলোকে রিসাইক্লিং করে বিদেশে পাঠাচ্ছি। সরকার আমাদের এটার ওপরে ১০ শতাংশ ইনসেন্টিভ দিচ্ছে।’ পরিত্যক্ত প্লাস্টিকগুলো রিসাইক্লিং করতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, কুমিল¬া, রাজশাহী ও বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ৫ হাজার কারখানা রয়েছে। আর এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছে প্রায় ১২ লাখ মানুষ। দেশের কয়েকটি কারখানা আমদানিকৃত ও রিসাইক্লিং প্লাস্টিক দানা ব্যবহার করে তৈরি করছে বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ, কৃষি সামগ্রীর মোড়ক, ইলেক্ট্রনিক্স ও বিল্ডিং সামগ্রী, পরিবহন যন্ত্রাংশ ও ফার্নিচারসহ নানা ধরনের গৃহস্থালি সামগ্রী। চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনামসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিকের গুঁড়ো রফতানি হচ্ছে। সেসব দেশে এই প্লাস্টিকের গুঁড়ো দিয়ে উন্নতমানের প্লাস্টিকের সুতা তৈরি হয়। আমাদের দেশের বিভিন্ন শিল্প কারখানায় প্লাস্টিকের গুঁড়ো আমদানি করা হচ্ছে। দেশে প্রতিবছর এক থেকে দেড় হাজার টন প্লাস্টিকের গুঁড়ো উৎপন্ন হয় এবং উৎপাদিত প্লাস্টিকের গুঁড়ো বিদেশে রফতানি করে প্রায় ১০০ কোটি টাকার মতো বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে মাথাপিছু ৫ থেকে ৬ কেজি প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহৃত হচ্ছে। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি পর্যন্ত প্লাস্টিক পণ্যে ৭ কোটি ৫৩ লাখ ডলার আয় হয়েছে। ফলে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৫ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্লাস্টিক পণ্য থেকে মোট রফতানি আয় আসে ৮ কোটি ৮৯ লাখ ৯৫ হাজার ডলার।
×