ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আহা কী চমেৎকার দেখা গেল, এই বারেতে দেখা গেল...!

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২৯ এপ্রিল ২০১৭

আহা কী চমেৎকার দেখা গেল, এই বারেতে দেখা গেল...!

সমুদ্র হক ॥ ‘আহারে কী চমেৎকার দেখা গেল। শাহজাহানে তাজমহল বানাইলো। কী চমেৎকার তাজমহল। দেখো দেখো কুতুব মিনার উঁচা কতো। লালবাগের কেল্লা দেখো। এই দুনিয়া দেখা গেলো। যমুনা নদী দেখ। কেমনে ভাইস্যা গেল। আরও কত দেখা গেলো। এইবারেতে দেখা গেল......’। এগুলো বায়োস্কোপের ধারা বর্ণনা। একটা সময় বড় একটা বাক্সো নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরত বায়োস্কোপওয়ালা। তা দূর অতীত। তবে আজও বিভিন্ন মেলায় প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে ঘুরে বেড়ায় কোন বায়োস্কোপওয়ালা। বিনোদনের ঐতিহ্যের এমন বাক্স আজও তারা টিকিয়ে রেখেছে বায়োস্কোপ। সত্তরের দশকে টেলিভিশনকে শখ করে বলা হতো বায়োস্কোপের বাক্স। বায়োস্কোপ সিনেমার আদি নাম। দূর অতীতে এই বায়োস্কোপ ছিল বিনোদনের সঙ্গে শিক্ষনীয় অধ্যায়। বায়োস্কোপকে আধুনিক করে টমাস আলভা এডিশন আবিষ্কার করেন সিনেমাটোগ্রাফ যন্ত্র। এই আবিষ্কারের পরও কিছুটা সময় সিনেমায় শুধু চলমান দৃশ্যই দেখা যেত। সংলাপ শোনা যেত না। বলা হতো নির্বাক ছবি। লোকজন বলত বোবা টকি। টকিজ অর্থ সবাক চিত্র। একটা সময় আমাদের দেশের অনেক সিনেমা হলের নামের সঙ্গে টকিজ যুক্ত করা হতো। সেদিনের লোকজন সিনেমা দেখাকে দুইভাবে বলত। যেমন টকি দেখে আসি। কেউ বলত চল বই দেখে আসি। বই দেখা অর্থ যারা সিনেমা নির্মাণ করতেন তারা কোন সাহিত্যের গল্প বেছে নিতেন। যে কারণে সিনেমার পরিচিতও ছিল বই দেখে আসা। সিনেমার আদি যুগে এই বায়োস্কোপ স্থির ছবি প্রদর্শনের সঙ্গে তথ্য, শিক্ষা ও বিনোদন দিত। বায়োস্কোপের কাঠের বাক্সের একধারে ৪ থেকে ৬টি গোলাকৃতির ম্যাগানিফাই গ্লাস (আতস কাচ) বসানো থাকে। এই কাচে চোখ লাগিয়ে দর্শকরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের স্থির ছবি বাক্সের ভেতরের পর্দায় দেখতে পায়। অঙ্কিত বেশ কয়েকটি ছবি একটি রিলের সঙ্গে পেঁচিয়ে রাখা হয়। বাক্সের ওপরে একটি হাতলের ঘূর্ণনের মাধমে ছবিগুলো একের পর এক পার করা হয়। বিশেষ ব্যবস্থায় টর্চের মাধ্যমে পেছন দিক থেকে প্রদর্শিত ছবির ওপর আলো ফেলা হয়। বায়োস্কোপওয়ালার এক হাতে থাকে বাদ্যযন্ত্র খঞ্জনি। আরেক হাতে টিনের চোঙ্গা মাইক। তিনি বাক্সের ওপরের এক ছিদ্র দিয়ে দেখে নেন কি ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে। তারপর ৩০ সেকেন্ড থেকে এক মিনিট ওই ছবির বর্ণনা দেন। ছোট্ট বর্ণনায় তথ্যের সঙ্গে শিক্ষা ও বিনোদন থাকে। বায়োস্কোপওয়ালা এমনভাবে রসময়ের সঙ্গে কথা বলেন যা শুনে দর্শকরা হেসে ওঠে। সহজে মনেও রাখতে পারে। বায়োস্কোপের বাক্সে কোন ছবি ক্রমানুসারে সাজানো আছে তা যিনি চালান তার মনে থাকে। তিনি ছবিগুলোর তথ্য জেনে সুন্দরভাবে বর্ণনা করেন। বর্ণনার সময় খঞ্জনি যন্ত্রটি তালে তালে ঝুমঝুম করে বাজান। বাঙালী সংস্কৃতির অংশ এমন বায়োস্কোপ আজও দেখা যায়। বগুড়ার বৈশাখী মেলায় দেখা মেলে এক বায়োস্কোপওয়ালার। তার নাম নিফাজ আলী। বয়স ৬০ অতিক্রম করেছে। তারুণ্যের বেলা থেকেই তিনি বায়োস্কোপ দেখান। উত্তরাধিকারী সূত্রে তিনি এই বায়োস্কোপের বাক্স পেয়েছেন। বললেন তার দাদা বায়োস্কোপ দেখাতেন। আগে বায়োস্কোপের ছবি কোন অঙ্কন শিল্পী এঁকে দিত। বর্তমান রঙিন চিত্র প্রিন্ট করে সাজিয়ে নেয়া হয়। ছোট ছবি ম্যাগনিফাই গ্লাসে বড় দেখা যায়। বর্তমানে শিশু কিশোররা এই ছবি দেখে আনন্দ পায়। কৌতূহলী হয়ে বড়রাও বায়োস্কোপ দেখে। বগুড়ার তরুণ নাট্যশিল্পী সিজুল বায়োস্কোপ দেখে বললেন, ছেলেবেলায় বায়োস্কোপের কথা শুনেছেন। বায়োস্কোপ দেখে মনে হয়েছে একে আধুনিকায়ন করা যায়। এক তরুণ দর্শক বললেন, ডিজিটাল যুগে উদ্যোগ নিয়ে বায়োস্কোপের আদল ঠিক রেখে কোন ডিভাইসের মাধ্যমে চলমান ছবির সঙ্গে ধারা বর্ণনাজুড়ে দিয়ে প্রদর্শন করা যেতে পারে। তাহলে প্রাচীন ঐতিহ্য ঠিক থাকে বায়োস্কোপ আধুনিকায়ন হয়। বায়োস্কোপওয়ালা নিফাজ আলীর বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার পান্দাইল গ্রামে। কৃষিকাজ করেন। কোথায় মেলা হলে সেখানে গিয়ে বায়োস্কোপ দেখিয়ে কিছু অর্থ রোজগার করেন। তার বায়োস্কোপের বাক্সে ২০টি ছবি আছে। শহরাঞ্চলে প্রতিজনে দেখার জন্য ৫ টাকা থেকে ১০ টাকা নেন। গ্রামের মেলায় ও হাটে যে যা পারে তাই দেয়। একবার শো চালাতে দশ মিনিট সময় লাগে। ছবি কম দেখালে ৪-৫ মিনিটেই শেষ হয়। নিফাজ আলী বললেন, গ্রামে বা শহরে কোন ঘটনা ঘটলে তার ছবি সংগ্রহ করে প্রদর্শন করেন। বন্যায় কিভাবে নদী ভেঙ্গে যায় তাও দেখান। বর্ণনা দেয়ার সময় তার তথ্য সংগ্রহ করে নিতে হয়। বায়োস্কোপের দর্শকরা যাতে মজা পায় তা তিনি কথা মালায় সাজিয়ে নেন। বায়োস্কোপওয়ালা নিফাজ আলী দাবি করেন দেশে আর কোন বায়োস্কোপওয়ালা নেই। তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান। একজন অধ্যাপক বললেন, প্রাচীন এতিহ্য জাদুঘরে রাখা যেতে পারে।
×