ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শেখ মিরাজুল ইসলাম

ধা রা বা হি ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ২৮ এপ্রিল ২০১৭

ধা  রা  বা  হি  ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

(পূর্ব প্রকাশের পর) আগুন-জ্বলা মসলিন সারা দুপুর লাল কেল্লার ঝুল বারান্দা হতে দূরে নদীপারের তাজমহলের দিকে ঠায় তাকিয়ে ছিলেন সম্রাট শাহজাহান। ক্লান্তিহীন এক দৃষ্টিতে তিনি মমতাজ বেগমকে যেন দেখছিলেন। -দেখো, তোমার ছেলেদের কাণ্ড? দিল্লি হতে এখানে পালিয়ে আসতে হলো। শাহজাহান আসতে চাননি। চেয়েছেন দিল্লিতে বসেই সমস্যার মোকাবেলা করবেন। কিন্তু দারা প্রায় জোর করে স্বাস্থ্য রক্ষায় হাওয়া বদলের অজুহাতে তাঁকে লাল কেল্লায় নিয়ে এসেছেন। দারা’র ধারণা এই স্বাস্থ্য নিয়ে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতে তিনি আরো অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। আওরঙ্গজেব আর মুরাদের মধ্যে সন্ধি হয়েছে। তাঁরা দুই ভাই নর্মদা পার হবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দারা’র দৃষ্টিতে আগ্রাই এখন দুইদিক হতে আক্রমণ সামলাবার জন্য উপযুক্ত স্থান। আগ্রার পরিবেশ এমনিতে রুক্ষ। এই শীতকালেও দুপুরে রোদের তেজ অনেক কড়া। ইব্রাহীম লোদী যদি তাঁর রাজধানী আগ্রায় না করে কাশ্মীরে করতেন তবে ভালো হতো। অন্তত গরমকালের কাঠ ফাটানো কষ্টের মাসগুলো আরামে কাটানো যেত। শাহজাহান একাকী নিজের সঙ্গে কথা বলতে থাকলেন। এটা সত্য, পানিপথের যুদ্ধ জয়ের পর বিজয়ী বাবরের অধিকাংশ সৈন্য হতে শুরু করে উপদেষ্টা বা সেনাপতি সবাই আগ্রা লুট করে কাবুলে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। তখন ছিল প্রখর গরমকাল। তাঁবু ছেড়ে যমুনার ঠা-া পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে সবাই বসে থাকতো সারা দিন। যমুনার নীল পানি বহুদিন ঘোলা হয়ে ছিলো সৈন্য-সামন্তদের দাপাদাপিতে। হিন্দুস্তান গরম দোযখের মতো লাগছিলো সবার। কিন্তু অটল ছিলেন বাবর। মুঘলদের যাযাবর জীবনের অবসান ঘটাতে এর চেয়ে বড় সুযোগ আর আসবেনা। স্থানীয় রাজপুত রাজাদের সঙ্গে সন্ধি আর নেংটিপরা সরল মানুষগুলোর কাঁধে চড়ে বিপুল ঐশ্বর্যশালী মহাদেশ শাসনের স্বপ্ন তখন তাঁর চোখেমুখে। বিশেষ করে আগ্রার লোদীদের সম্পদের স্তূপ দেখে বাবর বাহিনীর মাথা নষ্ট হবার যোগাড়। সোনা-রূপা-হীরা-জহরত কি নেই সেখানে? বাবর তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধু ও সেনাধ্যক্ষ খাজা কালান’কে কাবুলের শাসক নিযুক্ত করে কাবুলবাসী প্রত্যেকের জন্য একটি করে রূপার মোহর উপহার পাঠিয়েছিলেন। লোকে বলে বাবর নাকি তাঁর কাবুল ফেরতগামী অনুসারীদের বলতেন, গজনীর চেয়ে হিন্দুস্তানের তীব্র গরম ও কনকনে ঠাণ্ডায় তিনি মরতেও রাজী। আসল সত্য হচ্ছে, আগ্রার রাজকোষ নতুন মুঘল পাদশাহ বাবরের চোখ খুলে দিয়েছিল। তিনি জেনেছিলেন হিন্দুস্তানের বাদবাকী রাজ্যেও আছে বিপুল ধনসম্পদ। সব হাতের মুঠোয় না নিয়ে তিনি কেন আবার মরু আফগানে ফেরত গিয়ে শুকনো রুটি আর খোরমা চিবাবেন? শাহজাহান আলগোছে পাগড়ির ভেতর হতে ঢাউস আকারের হীরার টুকরোটি হাতে তুলে নিলেন। হীরাটি পায়রার ডিমের চেয়ে একটু বড়। প্রায় চার তোলা ওজন। দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ রতœ এই হীরক খণ্ডটির অপার্থিব সৌন্দর্য দেখে বাবর নাম দিয়েছিলেন ‘দরিয়া-এ-নূর’, আলোর নদী। কেউ বলেন কোহিনূর, মানে আলোর পাহাড়। দিল্লি হতে আসার পর এটি হাতছাড়া করছেন না শাহজাহান। জানেন ময়ূর সিংহাসন ছাড়াও এর লোভে তাঁর তিন ছেলে তাঁকে কেটে টুকরো টুকরো করে যমুনায় ভাসিয়ে দিতে পারে। - এটা আমার, শুধুই আমার ... বলতে বলতে ঘোর লাগা কণ্ঠে হীরার টুকরাটির গায়ে হাত বুলাতে থাকেন সম্রাট। আরো ভালো করে দেখতে সূর্যের আলোর দিকে তুলে ধরেন পাথরটিকে। ঝিলমিল আলোর বন্যায় দিনদুপুরে যেন ভেসে গেল পুরো খাস মহল। আঙুরবাগ হতে এই হঠাৎ আলোর ঝলকানি ঠিকই দেখতে পেলেন জাহান আরা। দুইজন দাসীর কাঁধে ভর দিয়ে শাহজাহান খোলা বাগানে এসে বসলেন। শতরঞ্জি বিছানো আরাম তাকিয়ায় হেলান দিলেন। রূপার বাক্সে তামাক আর সোনার বাক্সে আফিম সাজানো হয়েছে। জাহান আরা দাসীদের সঙ্গে নিয়ে সম্রাটকে সঙ্গ দিতে এলেন। - আব্বাজান, আবার কোহিনূর নিয়ে বাচ্চাদের মতো একা একা খেলছিলেন? আফিম খেতে খেতে আদুরে কণ্ঠে বললেন জাহান আরা। - না বেটি, তোমার আম্মাজানকে এর জ্যোতি দেখাচ্ছিলাম। সম্রাটও নেশাচ্ছন্ন হয়ে উঠছেন। - বাহ! তিনি দেখেছেন? - মনে হয় দেখেছেন! কারণ এক নতুন বাঈজীকে দেখলাম আজ সকালে। বিলকুল তোমার আম্মাজানের মতো দেখতে। -আব্বাজান, আপনার তবিয়ত এখনও ঠিক হয়নি। কপট শাসনের সুর শাহজাদীর কণ্ঠে। ম্লান হয়ে উঠলো শাহজাহানের চেহারা। তাঁর এই আদরের কন্যাটি আচার-আচরণে হয়েছে বিলকুল সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের মতো। যদিও নূরজাহান ছিলেন সৎ দাদী, নিঃসন্তান। সব কিছু আগলে রাখার অভ্যাস ছিল তাঁর। নূর জাহানের মতো জাহান আরার নিজস্ব বাণিজ্য জাহাজ আছে সুরাট বন্দরে। ইংরেজ ও হল্যান্ডের বণিকদের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। শাহজাহান নিজেও ভক্ত ছিলেন তাঁর আরেক দাদীজান যোধা বাঈ-এর। মহামতি আকবরের প্রিয় স্ত্রীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতমা। দাদা-দাদীর একই সোনার থালে খেতে বসতেন তিনি। আদর করে মুখে তুলে খাওয়াতেন তাঁকে যোধা বাঈ। তাঁর মতো পরমা সুন্দরী মহিলা শাহজাহান তাঁর সারা জীবনে একজনও দেখেন নি। - কি করবো বলো? এখন তো আমি তোমাদের ইচ্ছের অধীন। হতাশা ঝরে পড়লো সম্রাটের কণ্ঠে। - তওবা তওবা! আব্বাজান এভাবে বলবেন না। আপনিই তো হিন্দুস্তানের মালিক। আদেশ করুন যা ইচ্ছে হয়। এরপর ইশারায় নির্দেশ দিলেন শাহজাদী। প্রধান দাসী’র কানে কানে চুপি চুপি বললেন, - যাও, রাজমালীকে বলো সম্রাটের খাস বিছানায় ইতর-ই-নওরস শাহী গাছের পাতা বিছিয়ে দিতে। আর জেসমিন আর লেবু ফুলে পুরো কক্ষ ভরিয়ে দিও। এইসব ভেষজ পাতা আর ফুলের গন্ধে যে কারোর মধ্যেই কামনার আদি রস উথলে উঠবে। তবে এই প্রস্তুতি শাহজাহানের জন্য নয়। এই আয়োজন বাঈজী শাহীন আরা’র জন্য। সম্রাটের প্রতি এই অল্প বয়সী মেয়েটার ইচ্ছের কোন কমতি যেন না হয়। - খুদা হাফেজ আব্বাজান। সন্ধ্যায় শায়ের মেহফিলে আবার দেখা হবে। দারা’কেও আসতে বলেছি। মসলিনের ওড়নায় মুখ ঢেকে লজ্জিত কণ্ঠে বললেন জাহান আরা। দাসীদের সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন জাহাঙ্গীর মহলের দিকে। - ততক্ষণে তুমিও সাবধানে থেকো। সবুজ মসলিনের চুড়িদার পরা শাহজাদীর পোশাকের দিকে ইঙ্গিত করে ইশারায় কুশল বিনিময় করলেন শাহজাহান। মেয়ের মসলিন কাপড় পরা পছন্দ করেন না তিনি। এই মসলিন পোশাকে আগুন লেগে বারো বছর আগে মরতে বসেছিলেন জাহান আরা। আগুনে পোড়া হাত আর কাঁধের অনাববৃ অংশটুকু দেখে সেই কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। একত্রিশতম জন্মদিনের উৎসবে মোমের আলো হতে সেই আগুনের সূত্রপাত। চারজন দাসী শাহজাদীর শরীরের-পোশাকের আগুন নেভাতে গিয়ে নিজেরাই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। রাজহেকিমরা আগুনে পোড়া শাহজাদীর জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। প্রায় চার মাস দগ্ধ যন্ত্রণায় কাতর কন্যার সেবা করেছিলেন শাহজাহান নিজ হাতে। প্রতিরাতে মানত করতেন এক হাজার একটি রৌপ্য মুদ্রা। আরিফ নামের এক সেবা দাসকে সারা রাত শাহজাদীর সেবায় নিযুক্ত করা হয়েছিল। সারা শরীরে হাত বুলিয়ে বিশেষ কবিরাজী মলম লাগাতে পারদর্শী ছিল সে। এক পর্যায়ে শাহজাদী তার প্রেমে পাগল হয়ে যান। সবাই জানে, প্রচুর স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে সেই দাসটিকে আরাকানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শাহজাহান। কিন্তু কন্যার খেদমতগার আরিফকে যাত্রাপথেই হত্যা করা হয়েছিল। প্রিয় কন্যার গোপনাঙ্গ স্পর্শ করা কোন অধম এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকবে তা সম্রাট বরদাশত করতে পারেন নি। তবে সেই সময় একটা বিশেষ সুযোগ হাতিয়ে নিয়েছিলেন ডাঃ গ্যাব্রিয়েল ব্রাউটন নামের এক বৃটিশ ব্যবসায়ী। জাহান আরা’কে সুচিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলার বিনিময়ে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পক্ষে বাংলার সঙ্গে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্র আদায় করে নেন। কন্যার জীবনের বিনিময়ে সম্রাট শাহজাহানের কাছে সেটা ছিল এক তুচ্ছ ব্যাপার। (চলবে)
×