ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিনা খরচে আইনী সহায়তায় অসচ্ছলদের অধিকার প্রতিষ্ঠা

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ২৮ এপ্রিল ২০১৭

বিনা খরচে আইনী সহায়তায় অসচ্ছলদের অধিকার প্রতিষ্ঠা

আরাফাত মুন্না ॥ মনসুরুজ্জামান খান বসবাস করেন রাজধানীর সূত্রাপুরে। ১৯৫৬ সালে তার পিতার দায়ের করা মামলার দায়িত্ব পান উত্তরাধিকার সূত্রে। মনসুরুজ্জামানের পিতা মোমেন খান যাত্রাবাড়ী এলাকার মাতুয়াইলের ৩.৭৫ শতাংশ একটি জমি নিয়ে মামলাটি করেছিলেন। অনেক কষ্ট করে পিতার দায়ের করা এই মামলা চালাচ্ছিলেন শারীরিক প্রতিবন্ধী মনসুরুজ্জামান। বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টে তার পক্ষে রায় আসার পর প্রতিপক্ষ সুপ্রীমকোর্টে লিভ টু আপীল করে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল হওয়ায় আপীল বিভাগে মামলা চালানো তার প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এমন অবস্থায় সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির দারস্থ হন মনসুরুজ্জামান খান। সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করে মামলা চালানোর দায়িত্ব নেয়ার পর অবশেষে আপীল বিভাগও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। অবশেষে মাতুয়াইলের ওই পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা হয় মুনসুরুজ্জামানের। শুধু মনসুরুজ্জামানই নন, তার মতো এমন দরিদ্র ও অসচ্ছল বিচার প্রার্থীদের বিনা খরচে আইনী সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা। উচ্চ আদালতে সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি এবং জেলাগুলোতে জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি এই কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এই সেবা জনগণের ঘরে ঘরে নিয়ে যেতে প্রতিটি উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও ইউনিয়ন লিগ্যাল এইড কমিটি কাজ করছে। এছাড়া চৌকি আদালতেও বিনা খরচে আইনী সহায়তা প্রদান করে লিগ্যাল এইড কমিটি কাজ করছে। ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা ২ লাখ ৩১ হাজার ৬২৬ জনকে বিনা খরচে আইনী সেবা দিতে সক্ষম হয়েছে। এদিকে আজ ২৮ এপ্রিল পঞ্চমবারের মতো পালিত হচ্ছে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান দিবস। ‘বিরোধ হলে শুধু মামলা নয়, লিগ্যাল এই অফিসে আপোসও হয়’ এই প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে এবার জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস পালন করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। এদিকে আজ শুক্রবার সকাল ১০টায় রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে দিবসের অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া, তৃণমূল পর্যায়ে সরকারী আইনী সেবার বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্য সারাদেশে লিগ্যাল এইড র‌্যালি, মেলা, পথ নাটিকা, টক-শো, গোলটেবিল বৈঠক, সভা-সেমিনার, মাইকিং ও রক্তদান কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়েছে। হেল্পলাইনে মিলছে আইনী সেবা শুধু আদালতে মামলা পরিচালন ছাড়া টেলিফোনেও নানা ধরনের আইনী পরামর্শ দিচ্ছে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা। সংস্থার হেল্পলাইনের (১৬৪৩০) যে কেউ ফোন করে আইনী যে কোন বিষয়ে জানতে চাইলে আইনী পরামর্শ দিচ্ছে সংস্থাটি। গত বছর জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই হেল্পলাইন উদ্বোধন করেন। সংস্থার এই নম্বরে ফোন করতে কোন টাকা খরচ হবে না বলেও জানান সংস্থার উপপরিচালক ও যুগ্ম জেলা জজ আবেদা সুলতানা। তিনি বলেন, আমাদের টোল ফ্রি এই নম্বরে যে কেউ ফোন করে যে কোন ধরনের আইনী পরামর্শ চাইতে পারবে। আমাদের কর্মীরা পারলে সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্যার সমাধান দেয়ার চেষ্টা করেন। যদি সম্ভব না হয় তাহলে পরবর্তীতে তাকে ফোন করে তার সমস্যা সংক্রান্ত পরামর্শ জানিয়ে দেন। গত বছর ২৮ এপ্রিল হেল্পলাইন চালু হওয়ার পর ৪ হাজার ৬৫২ জন নারী ও ৯ হাজার ৮৩৫ জন পুরুষ টেলিফোনে আইনী পরামর্শ নিয়েছেন বলেও জানান সংস্থার এই কর্মকর্তা। যেসব সেবা দেয়া হয়, যারা পান সরকারী আইনী সেবার মধ্যে রয়েছে আইনগত পরামর্শ, দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী নিয়োগ, ফি পরিশোধসহ মামলা-সম্পর্কিত সব ধরনের ব্যয়, ডিএনএ পরীক্ষার যাবতীয় ব্যয়, জেল আপীল প্রভৃতি। যে ব্যক্তির আয় বছরে ১ লাখ টাকার নিচে, তারা জেলা ও অন্যান্য আদালতে সরকারী খরচে আইনগত সহায়তা পাওয়ার যোগ্য হবেন। সুপ্রীমকোর্টে কোন মামলা আইনগত সহায়তা পেতে হলে বার্ষিক আয় দেড় লাখ টাকার নিচে হতে হবে। তবে বেকার, শিশু, মানবপাচারের শিকার ব্যক্তি, ভবঘুরে, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃ-গোষ্ঠী, পারিবারিক সহিংসতার শিকার ব্যক্তি, প্রতিবন্ধী, দুস্থ নারী ও বৃদ্ধ, এসিড দগ্ধ নারী ও শিশু, অর্থের অভাবে আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারছেন না এমন ব্যক্তিরাও সরকারী খরচে আইনগত সহায়তা পাবেন। জেলা ও অন্যান্য আদালতে বিনা খরচে আইনী সহায়তা পেতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বার্ষিক আয়ের সীমা দেড় লাখ। আইনগত সহায়তার জন্য আবেদন কোথায় সুপ্রীমকোর্ট ও প্রতিটি জেলা জজ কোর্টে অবস্থিত ‘লিগ্যাল এইড অফিস’ (আইনগত সহায়তা অফিস), জেলখানা বা কারাগারের কর্মকর্তাদের কাছে, জেলা বা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদকের কার্যালয়, জেলা কমিটির সহায়ক কর্মকর্তা এবং অফিস সহকারীর কাছে; জেলা আদালতগুলোর বেঞ্চ সহকারীর কাছে; জাতীয় মহিলা সংস্থার জেলা ও উপজেলা কার্যালয়ে এই সেবা পাওয়া যাবে। যিনি দরখাস্তকারী তিনি নিজে বা তার মামলা তদারককারী বা তদবিরকারী লিগ্যাল এইড অফিসে সরাসরি আবেদন জমা দিতে বা দাখিল করতে পারেন। তা ছাড়া কারাগার কর্তৃপক্ষ, ইউনিয়ন-পৌরসভার চেয়ারম্যান বা মেয়র, কমিশনার, সমাজসেবা কর্মকর্তা বা বিভিন্ন এনজিওর কর্মকর্তার মাধ্যমেও আইনগত সহায়তার আবেদনপত্র লিগ্যাল এইড অফিসে পাঠানো যায়।
×