ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

হাওড়ের ক্ষতি পোষাবে দক্ষিণের ফলনে ॥ আশা কৃষি সচিবের;###;কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে এগোচ্ছে সরকার

প্রাকৃতিক দুর্যোগে বোরোর বাম্পার ফলন নিয়ে শঙ্কায় কৃষক ॥ খাদ্য ঘাটতি হবে না

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৮ এপ্রিল ২০১৭

প্রাকৃতিক দুর্যোগে বোরোর বাম্পার ফলন নিয়ে শঙ্কায় কৃষক ॥ খাদ্য ঘাটতি হবে না

কাওসার রহমান/শাহীন রহমান॥ শেষ মুহূর্তে বোরোর বাম্পার ফলনে বাধা হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আগাম পাহাড়ী ঢল, বন্যা, অতিবর্ষণ, ঝড় ও শিলাবৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ; যা সম্ভাব্য বাম্পার ফলনকে শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল ও আগাম বন্যায় একের পর এক এলাকার বোরো ফসল তলিয়ে যাচ্ছে। খাসি পাহাড়ের ঢলে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে হাওড়ের বিপর্যয়ের পর দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও কৃষক কাঁচা কিংবা আধাপাকা বোরো ধান কেটে ফেলছে। ফলে বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে এবার সংশয় দেখা দিয়েছে। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী যদিও হাওড়ের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রণোদনা কার্যক্রম নিয়ে গত ১৩ এপ্রিল দৈনিক জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে বোরো ধানের ফলন ভাল হয়েছে। যদি আবহাওয়া অনুকূলে থাকে তবে এবারও বোরো উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি থাকবে। কৃষি সচিব মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহও গত রবিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, বন্যায় হাওড় অঞ্চলে দুই লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এতে ছয় লাখ টন চাল কম উৎপাদিত হবে। কিন্তু দেশের অন্য অঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন বেশি হয়েছে। তাছাড়া, আউশ ও আমন চাষে কৃষকদের প্রণোদনা দেয়া হবে। ফলে দেশে খাদ্য ঘাটতি হবে না। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর কারও হাত নেই। গত ২৯ মার্চ থেকে সিলেট অঞ্চলে শুরু হয় টানা বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢল। এপ্রিলে এসে সেই বর্ষণ সিলেট অঞ্চল থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে, এক সপ্তাহ ধরে দেশব্যাপী টানা বর্ষণ ও কালবৈশাখী ঝড়ে উঠতি বোরো ফসল নিয়ে চাষীকে শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে। সর্বশেষ, সিলেট অঞ্চলে শনির হাওড় পাহাড়ী ঢল ও বর্ষণে তলিয়ে যাওয়ায় বোরো ধানের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ২০ হাজার হেক্টর। তবে চূড়ান্ত হিসাবে এ ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে পারে। হাওড়ে প্রতিহেক্টরে তিন টন করে বোরো চাল উৎপাদন হয়। সেই হিসাবে, শুধু হাওড় অঞ্চলেই চাল আকারে বোরোর ক্ষতির পরিমাণ ছয় লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। হাওড়ের এই দুর্যোগ কাটতে না কাটতেই গত শনিবার থেকে সারাদেশে শুরু হয়েছে প্রবল বর্ষণ, শিলাবৃষ্টি ও কালবৈশাখী। এই ঝড় ও বর্ষণে দেশের বিভিন্ন জেলার নিচু এলাকার ফসল তলিয়ে গেছে। কৃষক তাদের উঠতি বোরো ফসল বাঁচাতে ব্যর্থ হয়ে আধাপাকা ধানই কেটে ফেলছে। বিশেষ করে হাওড়ের পর বড় দুর্যোগ এসেছে চলনবিলে। অকালবন্যায় ইতোমধ্যে দেশে সবচেয়ে বড় এই বিলের বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। বড় ক্ষতির আশঙ্কায় কৃষকদের কাঁচা ও আধাপাকা ধানই কেটে ফেলতে বলা হয়েছে স্থানীয় জেলা প্রশাসন থেকে। তবে এ বছর দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বোরো আবাদ ভাল হয়েছে। ফলে কৃষি বিভাগের ভরসা, দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বোরো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ওই অঞ্চলের বাড়তি ধান দিয়ে এবারের বোরোর লক্ষ্যমাত্রা কাছাকাছি থাকবে। কিন্তু টানা বর্ষণ ও ঝড়ে উপকূলের নিম্নাঞ্চলের বোরো ধানও হুমকির মুখে। সেই সঙ্গে উজানের পানি ও বৃষ্টির পানি যখন এক হয়ে বঙ্গোপসাগরে নামতে শুরু করবে তখন উপকূলীয় অঞ্চলও তলিয়ে যেতে পারে। তার ওপর দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বোরো ধান এবার থোড় পর্যায়ে ‘নেক ব্লাস্ট’ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। বিশেষ করে যশোর ও খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্লাস্ট রোগের এমন ব্যাপকতা নিকট অতীতে দেখা যায়নি। যদিও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্লাস্ট রোগে ক্ষতি খুব বেশি হবে না। কারণ বেশিরভাগ স্থানেই ধানের পাতা ব্লাস্টে আক্রান্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেক ব্লাস্ট ছত্রাক জাতীয় রোগ। বৈরী আবহাওয়ার কারণেই এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ধানগাছ এ রোগে আক্রান্ত হলে ধানের ৭০ ভাগ পর্যন্ত ক্ষতি হয়ে যায়। নেক ব্লাস্ট রোগে প্রথমত ধানগাছের পাতায় চোখের মতো দাগ দেখা যায়। পরে গিঁট, গোড়া ও দানাও আক্রান্ত হয়। পাতার রং সাদা হয়ে যায় ও ভিজে দাগ ধরে। ধানের শীষে চিটা হয় এবং ধানগাছ মারা যায়। তবে ধানের শীষ বের হওয়ার আগেই জমিতে ফিলিয়া, এমিস্টার টপ, ট্রপার, নাটিভো জাতীয় তরল কীটনাশক ব্যবহার করলে এ রোগ থেকে ধানক্ষেত অনেকটাই রক্ষা করা সম্ভব। সব মিলিয়ে, বৈরী আবহাওয়ার কবলে এবারে বোরো ফসলের অবস্থা খুব একটা ভাল না। শেষ মুহূর্তে এসে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবারের উঠতি বোরো ফসলকে শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে। ফলে দেশের বৃহত্তম এই খাদ্যশস্যের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বেশি কঠিন হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এই অবস্থায় বোরোর প্রকৃত উৎপাদন হিসাব করে, খাদ্য ঘাটতি হলে তা মোকাবেলায় আগাম ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে বিশেষজ্ঞ মহল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, এ বছর বোরো মৌসুমে সারাদেশে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৪৮ লাখ হেক্টর জমি। এই পরিমাণ জমি থেকে চাল আকারে বোরো উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ কোটি ৯১ লাখ ৫৩ হাজার মেট্রিক টন চাল। ইতোমধ্যে সারাদেশে বোরো আবাদ হয়েছে ৪৭ লাখ ৯৭ হাজার হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে ৮ লাখ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ধান, উফশী বোরো আবাদ হয়েছে ৩৯ লাখ ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে। আগের বছর ১ কোটি ৯০ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হলেও উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৮৯ লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন। এদিকে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে এবার শুধু হাওড় অঞ্চলেই সোয়া দুই লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এছাড়া, সারাদেশে গত কয়েকদিন ধরে যে টানা বর্ষণ হয়েছে এর ফলেও ধানের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে ধান মাটিতে লুটিয়ে পড়ায় কিছু কিছু এলাকায় ধানের দানা কম হতে পারে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছত্রাক দেখা দিতে পারে। আর যদি আরও বৃষ্টিপাত হয় বা টানা বর্ষণ অব্যাহত থাকে তাহলে বোরোর উৎপাদনে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৈশাখ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোন কোন এলাকায় কৃষকের ধান কাটাও শুরু হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ বৈরী আবহাওয়ার কারণে যারা ধান কাটতে শুরু করেছিলেন তারা মাঠ থেকে ধান আনতে পারেনি। ফলে পানিতে ধান পচে গেছে। এছাড়া ধানগাছ মাটিতে লুটিয়ে পড়া ও পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কিছু কিছু বোরো ধান নষ্ট হয়েছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত কয়েকদিন ধরে অব্যাহত বৃষ্টিপাতের প্রকোপ ইতোমধ্যে কমে এসেছে। সামনে ভারি বৃষ্টিপাতের কোন আশঙ্কাও নেই। পুবালী ও পশ্চিমা বায়ুর মিলনে বাংলাদেশসহ আশপাশের এলাকায় কয়েকদিন ধরে অবিরাম বর্ষণ হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে এ বছরের এপ্রিল মাসে যে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৯৮১ সালের পর এপ্রিল মাসের এই সময়ে এত বৃষ্টি আর দেখা যায়নি। গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় উঠতি ফসলে বেশ ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে এই সময়ের ফসল বোরো ধানের পাশাপাশি মরিচ, তরমুজ, সয়াবিনসহ অন্যান্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ১৮ এপ্রিল সকাল ছয়টা থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় মোট বৃষ্টি হয়েছে ১৫৮ মিলিমিটার। গড়ে প্রতিদিন বৃষ্টি হয়েছে ২২ দশমিক ৫৮ মিলিমিটার। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে কুমিল্লায় ৬৯ মিলিমিটার। এরপর থেকে বৃষ্টিহীন হয়ে গেছে প্রায় পুরো দেশ। আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান বলেন, সামনের পাঁচ-ছয় দিন বৃষ্টি না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে রংপুর ও সিলেট অঞ্চলে বৃষ্টি হতে পারে। বৃষ্টিহীন এলাকার ওপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মঞ্জুরুল হাসান বলেছেন, হাওড় অঞ্চল বাদে দেশের অন্য এলাকায় বোরো ধানে বৃষ্টির প্রভাব সেভাবে পড়েনি বলে আমরা তথ্য পাচ্ছি। তবে বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে ধানের ক্ষতি হবে বলে তিনি জানান। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইং শাখার পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুহু জনকণ্ঠকে বলেন, এখন পর্যন্ত অকালবন্যার কারণে হাওড় এলাকায় বোরো ধানের সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, হাওড় এলাকায় এখন পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ মনে করা হচ্ছে। এর বাইরে দেশের অন্যান্য জেলায় বৃষ্টির কারণে বোরো ধানের বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, বৃষ্টির কারণে বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র ব্যাহত হবে না। কৃষক পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ বছর বোরো ধানের ফলন নিয়ে কৃষক খুশি হলেও শেষ মুহূর্তের বৃষ্টির কারণে তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ঝড়োহাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় কৃষকের পাকা ধান কাটা ব্যাহত হচ্ছে। ধানের মাঠ বৃষ্টির পানিতে নিমজ্জিত হয়ে তা ঝরে ঝরে পড়ছে। অনেক কৃষক এই ধান ঘরে তোলার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। এতে কৃষকের আর্থিক ক্ষতি বাড়ছে। কৃষক মনে করছেন, বৃষ্টির কারণে ধান মাটিতে লুটিয়ে পড়ায় উৎপাদনের পরিমাণ কমে যাবে। ফলে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যাবে না। এছাড়াও জমিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় পানিতে ধান পচে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তাদের। আবার ধান ভালভাবে শুকানো ও বীজ সংরক্ষণের বিষয়েও কৃষকদের মধ্যে দুচিন্তা রয়েছে। বোরো ধানের সার্বিক উৎপাদন নিয়ে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের কৃষি বিষয়ক কর্মসূচীর পরিচালক ড. সিরাজুল ইসলাম মনে করেন, যদিও বোরোর ফলন এবার ভাল হয়েছে কিন্তু এই বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে এই পর্যায়ে বেশি ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তিনি বলেন, অতিবৃষ্টি বোরো ধানের জন্য খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়। বৃষ্টি বন্ধ না হলে ধান তোলার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে। ধান ভালভাবে না শুকালে গুণগত ক্ষতি হবে। বীজ রাখার ক্ষেত্রেও ক্ষতি হবে।
×