ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ড. এম মোফাজ্জল হোসেন

জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য ॥ শেখ জামালের সঙ্গে তানন্দুয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের এক টুকরো স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২৮ এপ্রিল ২০১৭

জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য ॥ শেখ জামালের সঙ্গে তানন্দুয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের এক টুকরো স্মৃতি

ভারতের উত্তর প্রদেশের দেরাদুন শহরে অবস্থিত সেনাবাহিনীর তানন্দুয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বসে দিন কাটছে তো রাত কাটছে না। অধীর প্রতীক্ষায় আছি। কখন ফিরে যাব যুদ্ধের ময়দানে! দেশে নির্ধারিত রণাঙ্গন বলতে কিছু নেই। সারাদেশেই যুদ্ধ চলছে। নির্বিচারে পাখির মতো গুলি করে কিংবা ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে হত্যা করছে বাঙালী নারী ও পুরুষদের। পাকিস্তানের নরপশুদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না অবুঝ শিশুরাও। তানন্দুয়া ক্যাম্পে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। আগস্ট মাসের শেষের দিকের ঘটনা। দিনের নিয়মিত প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে দুপুরে খানিকক্ষণের বিরতি দেয়া হয়েছে। খাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছি। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষক ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল ওবান আমার দিকে আসছেন। আমি এগিয়ে গেলাম। ক্যাম্পে তার আগমনের খবর পেয়ে সকল প্রশিক্ষণার্থীই ভিড় করলেন তার সামনে। সকলকে উদ্দেশ করে জেনারেল ওবান বললেন, ‘তোমরা জানো’ এই কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ইয়াহিয়া খান ও ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান।’ ওবানের কথায় আমরা অবাক হলাম। বিশেষ একটা উদ্দেশ্য নিয়ে জেনারেল ওবান তানন্দুয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সে দিন এসেছিলেন। তখন অবশ্য বুঝতে পারিনি। পরে জানতে পারি বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামালের খোঁজখবর নেয়ার জন্য তিনি ওই কেন্দ্রে গিয়েছেন। আমাদের সঙ্গে মিনিট পাঁচেক কথা বলার পর জেনারেল ওবান চলে গেলেন। আমি তার পেছনে ছুটলাম। উত্তর দিকে অন্য একটি ভবনে ঢুকলেন তিনি। আমিও পেছনে। ভবনের একটি রুম থেকে বেরিয়ে এলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামাল। এর আগে অবশ্য আমার জানা ছিল না যে শেখ জামাল এই কেন্দ্রেই অবস্থান করছেন। শেখ জামালকে কাছে টেনে নিলেন জেনারেল ওবান। তার পিঠে হাত দিয়ে বললেন, ‘চিন্তা কর না, ঠিক হয়ে যাবে সব।’ জেনারেল ওবানের দরদমাখা কথা আর পরম আদর পেয়ে শেখ জামাল আবেগাপুøত হয়ে পড়েন। দেখলাম শেখ জামালের দু’চোখ ভিজে গেছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে ওবানের কাছে জানতে চাইছেন দেশের খবর। বঙ্গবন্ধুর কী অবস্থা? তার পরিবারের অন্য সদস্যরা কেমন আছেন? জেনারেল ওবান তার সমস্ত প্রশ্নের একই উত্তর দিয়েছিলেন- সকলেই ভাল আছেন। শেখ জামালকে কাছে পেয়েও তার সঙ্গে কথা বলব নাÑ এটা কী করে হয়। বয়সের দিক থেকে শেখ জামাল আমার এক বছরের ছোট। জন্মগ্রহণের মাস একই। এপ্রিল। তারিখ ভিন্ন। তার ২৮। আমার ৮। সান্ত¡নামূলক নানা কথাবার্তা বলে ওবান বিদায় নিলেন। কৌশল করে আমি একটু অন্যদিকে ঘুরে এসে শেখ জামালের সঙ্গে দেখা করলাম। বললাম, ‘ভাই আমিও এই কেন্দ্রেই প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। যুদ্ধের ময়দানে ফিরে যাব খুব শীঘ্রই।’ শেখ জামাল বললেন, ‘মনোযোগ দিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। দ্রুত চলে যান দেশে। দেশ স্বাধীন করতেই হবে।’ দোয়া করবেন ভাইÑ বলে বিদায় নিলাম শেখ জামালের কাছ থেকে। শেখ জামালের সেই কথাগুলো আজও আমার কানে বাজে। আমার চোখে সেই দৃশ্যটা স্থির হয়ে আছে আজও। জেনারেল ওবান বিদায় বেলায় বলেছিলেন, আমি বাংলার বাঘকে স্বচক্ষে দেখিনি, তবে তার সাহসী সাবককে দেখেছি। কাজেই মুক্তিযোদ্ধাদের জয় সুনিশ্চিত। তানন্দুয়া কেন্দ্র থেকে কবে কখন যে শেখ জামাল যুদ্ধের ময়দানে এসেছিলেন সেটা আমার জানা নেই। তবে শেখ জামালের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান ছিল বেশ কিছু ঘটনাবহুল। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধু পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গে ছিলেন গৃহবন্দী। মধ্য আগস্টের একদিন সকালে বন্দী মা আবিষ্কার করেন তার ছেলে জামাল উধাও। বেগম মুজিব তার সন্তানকে অপহরণের অভিযোগ তুলেন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে। সারা বিশ্বে আলোড়ন, বিদেশী পত্রপত্রিকায় ছাপা হলো পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবের মেঝ ছেলেকে গায়েব করেছে। কিন্তু গৃহবন্দিত্ব থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর মুজিব বাহিনীর হয়ে ৫নং সেক্টরে তিনি যুদ্ধ করলেও বিষয়টা প্রবাসী সরকার কৌশলগত কারণে বেমালুম অস্বীকার করে। অন্যদিকে প্রবাসী সরকার ও ভারত সরকার শেখ জামালকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। শেখ জামালের বিষয়টা নিয়ে পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক মহলে বেশ বিপাকে ছিল। অথচ তখন রণাঙ্গনে ৫নং সেক্টরে শেখ জামাল দেশের জন্য লড়ছেন। তখনকার লন্ডনের সানডে টাইমসে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা এবিএম মূসা তাকে ৫নং সেক্টরের একটা পরিখায় যুদ্ধরত অবস্থায় আবিষ্কার করেন। এরপর সম্ভবত ২ ডিসেম্বর লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের যেসব আলোকচিত্র আসে তার একটিতে সীমান্তের ১০ মাইল ভেতরে একটি রণাঙ্গনে সাবমেশিনগানধারীদের একজন হিসেবে ছবি ওঠে জামালের। যুদ্ধ শেষে জামাল ফিরে সেনাবাহিনীর লে. কর্নেল পদে যোগ দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, নিরাপত্তার খাতিরে মুজিবনগর সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তিযোদ্ধা দুই সন্তানেরÑ শেখ কামাল ও শেখ জামালের অনেক কিছুই গোপন রাখতেন। আর এই সুযোগটা গ্রহণ করে স্বাধীনতাবিরোধীরা যুগের পর যুগ অপপ্রচার করে আসছিল। কিন্তু সত্য তো সর্বদাই সত্য। আমাদের দেশে যে কুলাঙ্গাররা বলে, মুজিবের পরিবারের লোকেরা কেউ যুদ্ধ করেননি তারা আজন্মই অন্ধ। আজ শেখ জামালের শুভ জন্মদিন। ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জš§গ্রহণ করেন শেখ জামাল। তিনি ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ থেকে ম্যাট্রিক ও ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। শেখ জামালের জন্মদিনে তার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা। দেরাদুনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা শুধু যে সমর অস্ত্রে পারদর্শী তা নয়, তাদের রাজনৈতিক আদর্শ ও সোনার বাংলা গড়ার সৈনিক হিসেবে তৈরি করেছিলেন। নিরাপত্তার কারণে এবং দেশের কল্যাণে দেরাদুনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক কিছু গোপন রাখতে হয়। আজও তাদের তালিকা বাংলাদেশে নেই। এখনও পরিণত বয়সে তারা দেশমাতৃকার সেবায় ও সোনার বাংলা গড়ার সৈনিক হিসেবে দৃঢ় প্রত্যয়ী এবং সঙ্কল্পবদ্ধ। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক ও পরিচালক ছাত্রকল্যাণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
×