ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়;###;ডাঃ কামরুল হাসান খান

চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষা এবং জনগণের মানসম্মত চিকিৎসার ভরসাস্থল

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২৮ এপ্রিল ২০১৭

চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষা এবং জনগণের মানসম্মত চিকিৎসার ভরসাস্থল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চলমান স্বর্ণযুগের অন্যতম অবদান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। বর্তমানে দেশের মানুষের চিকিৎসা ও উচ্চ মেডিক্যাল শিক্ষার অন্যতম ভরসাস্থল। দেশের চিকিৎসক সমাজের তিন দশকের দাবি ছিল একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের। বহু সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে; কিন্তু বাস্তবায়নের কোন পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে সেই দাবি আবার উত্থাপিত হয় ১৯৯৭ সালে। শেখ হাসিনার কাছে কোন দাবি উত্থাপন করতে হয় না, শুধু বোঝাতে হয় এটি দেশের জন্য প্রয়োজন এবং জনগণ উপকৃত হবেÑ তাহলেই সেটি হয়ে যায়। এমনি এক মাহেন্দ্রক্ষণে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক নূরুল ইসলামের নেতৃত্বে ২০ জুলাই, ১৯৯৭ দেশের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন অন্য একটি বিষয়ে, সেখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গটি এসে যায়। প্রধানমন্ত্রী দেশে একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের যৌক্তিকতায় সম্মতি দেন। পরেরদিন তৎকালীন আইপিজিএমআরের পরিচালক অধ্যাপক মোঃ তাহির তৎকালীন শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমাকে ডেকে সরকারের কাছে একটি আবেদন করার কথা বলেন। ২৪ জুলাই, ১৯৯৭ আমরা আইপিজিএমআর শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে তৎকালীন স্বাস্থ্য সচিব মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে সাক্ষাত করে একটি আবেদনপত্র হস্তান্তর করি। মানুষের জীবনে কিছু কিছু ঘটনা সারাজীবন আবেগময় এবং প্রচ- অনূভূতিপ্রবণ করে রাখে। সেদিনের সে ঘটনাও আমার জীবনে তাই। দেশের প্রথম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ড্রাফটি আমার করার বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল এবং এর নামকরণটিও আমি করেছিলাম। জাতির পিতার নামে হবে এটি সর্বসম্মতি সিদ্ধান্ত ছিল; কিন্তু জাতির পিতার নামটি কিভাবে হবে সেটি নির্ধারণ করার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। আমি অনেক ভেবে-চিন্তে নামটুকু নির্ধারণ করেছিলাম। আমরা আবেদনের বিষয়টি নিয়ে চুপচাপ ছিলাম। মজার ব্যাপার হলো ২৩ জুন, ১৯৯৭ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল নেতারা যেন মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ৩১ জুলাই, ১৯৯৭ রাতের বিটিভির ৮টার খবর দেখছিলাম। হঠাৎ ঘোষণা ‘সরকার আইপিজিএমআর’-কে রূপান্তর করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আমি বিস্মিত হয়েছিলাম ভেবে মাত্র ৭ দিনের ব্যবধানে এরকম একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত, যা তিন দশকের অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে হয়নি। চিকিৎসকরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। পরেরদিন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণীর নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারী বিরোধিতা শুরু করে। তাদের বক্তব্য ছিল এতে তারা চাকরিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও এর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে সকল শিক্ষক ঐক্যবদ্ধ ছিলেন, সঙ্গে ছিল কিছুসংখ্যক নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারী। প্রতিদিন ক্যাম্পাসে পাল্টাপাল্টি সভা-সমাবেশ, মিছিল, এমনকি বিরোধীদের পক্ষে ঘেরাও কর্মসূচীও পালন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রয়াত সালাহ উদ্দীন ইউসুফ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি প্রায় প্রতিদিনই আমাদের সঙ্গে বসতেন। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বিএমএ’র তৎকালীন মহাসচিব ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। দীর্ঘ প্রায় সাত-আট মাস এ আন্দোলন আমাদের প্রতিহত করতে হয়েছিল। একদিকে আন্দোলন ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার জন্য ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে, অন্যদিকে বিএমএ’র পক্ষ থেকে খসড়া আইন প্রস্তুতির বিশাল কর্মযজ্ঞ। বিএমএ’র পক্ষ থেকে ’৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশকে অনুসরণ করে একটা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯৮ খসড়া’ সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয়। এ প্রস্তাবসহ অন্য আরও কয়েকটি আইন দেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯৮ মহান সংসদে অনুমোদিত হয়ে ৫ এপ্রিল ১৯৯৮ তারিখে গেজেট হিসেবে প্রকাশিত হয়। এখানেও আমার একটি বিশেষ অনুভূতির বিষয় রয়েছে, সংসদে যে খসড়াটি বিতরণ করা হয় তার মুখবন্ধটি আমার লেখার সুযোগ হয়েছিল। অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে ১৯৯৮ সালের ৩০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম শুরু হয় প্রথম ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক এম এ কাদেরীর মাধ্যমে। কেন আমরা বিশ্ববিদ্যালয় চেয়েছিলাম? দেশে মেডিক্যাল শিক্ষা ত্রয়ী প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে। সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের ভর্তি নীতিমালা ও পরীক্ষা, ছাত্র ভর্তি, শিক্ষক নিয়োগ ও বদলি এবং শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ ইত্যাদি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। কোর্স কারিকুলাম তৈরি ও নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল। একাডেমিক কারিকুলাম, পরীক্ষা পরিচালনা ও সনদ প্রদান করে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়। উপরের ত্রয়ী নিয়ন্ত্রণে যে সকল কাজ সম্পাদিত হচ্ছে তা বিশ্বে প্রচলিত ধারা অনুযায়ী একা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। সে কারণে আমরা চেয়েছিলাম দেশের সকল মেডিক্যাল প্রতিষ্ঠানকে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা। তখন সবটা হয়নি; কিন্তু এখন ধাপে ধাপে সবই হচ্ছে। আরও দুটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, সেখানে আমাদের লক্ষ্য আরও এক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসন এবং শিক্ষক সমিতি মিলেমিশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রম এগিয়ে নিতে লাগল। বিশেষ করে সকল শিক্ষকের উৎসাহ-উদ্দীপনা প্রতিটি ক্ষেত্রে লক্ষণীয় ছিল। বিধি, প্রবিধি, সংবিধি প্রণয়নে সবাই একযোগে কাজ করেছে। প্রশাসন সকল কাজে শিক্ষক সমিতির সহযোগিতা নিয়েছে। স্বচ্ছ আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং উচ্চ মেডিক্যাল শিক্ষায় রেসিডেন্সি কোর্স চালু করা ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। শিক্ষক সমিতি শিক্ষকদের পদোন্নতি, ডীনদের কার্যক্রম পরিচালনা, ছাত্রদের শিক্ষা কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগী ভূমিকা রাখে। প্রথম ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক এম এ কাদেরীর নেতৃত্বে শিক্ষক, চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে সকল কার্যক্রম গতিশীল হয়, গড়ে ওঠে সুচিকিৎসা এবং উচ্চ মেডিক্যাল শিক্ষার নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে নেমে আসে এক গভীর সঙ্কট। সারাদেশের মতো এটিও আক্রমণের শিকার হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের যত জায়গায় জাতির পিতার নাম লেখা ছিল সব জায়গায় রাতের অন্ধকারে দুষ্কৃতকারীরা কালি লেপন করে দেয়। এমনকি আমাদের প্রাণপ্রিয় ম্যুরালটি ভেঙ্গে ফেলে। গোটা দেশে চলছে বিএনপি-জামায়াত জোটের তা-ব, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট আর ধর্ষণ। অনেকের সঙ্গে কথা বললাম একটা কিছু করা দরকার। অনেকেই সায় দিল না, সাহস পেল না। আমরা তখন শিক্ষক সমিতির কয়েকজন প্রতিবাদ-আন্দোলন শুরু করলাম এবং এটিই ছিল জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের বিরুদ্ধে ওই সময়কার বাংলাদেশে প্রথম প্রতিবাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থীরা সিদ্ধান্ত নিল বিশ্ববিদ্যালয়কে আগের আইপিজিএমআর-এ ফিরিয়ে নিতে হবে। আমরা প্রতিবাদ করলাম। আবার শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয় রক্ষার দীর্ঘ আন্দোলন। শিক্ষক সমিতিকেই আবার নেতৃত্ব নিতে হয়েছিল যুক্ত হয়েছিল সমমনা চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। গণমাধ্যমের একদল তরুণ আমাদের পাশে দাঁড়ালো শক্তভাবে। তখন বিটিভির পরে একমাত্র চ্যানেল একুশে টিভি। একুশে টিভির নিউজ বিভাগের প্রধান মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলের সাহসী ভূমিকা অবশ্যই স্মরণ করতে হয়। সঙ্গে মুন্নী সাহা, মোস্তফা ফিরোজ, শাহনাজ মুন্নী, জনকণ্ঠের মাসুদ কামাল, প্রথম আলোর মুস্তাফিজ শফি, যুগান্তরের রফিকুল ইসলাম রতন, ডেইলি স্টারের নাইমুল হক এবং সাংবাদিক প্রভাষ আমিন উল্লেখযোগ্য। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়কে আইপিজিএমআর-এ ফিরিয়ে নেয়ার। আমরা প্রতিদিন সভা-সমাবেশ, মিছিলের মাধ্যমে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুললাম- জাতির পিতার নামে প্রতিষ্ঠানের কোন পরিবর্তন আমরা মানি না-মানব না। প্রায়ই তখন একুশে টেলিভিশনের খবরে আমাদের সাক্ষাতকার যেত। একদিন সকালে অফিসে এসে দেখি ঙহব চড়রহঃ ঈড়ষষবপঃরড়হ ঈবহঃৎব-এর আনোয়ার নিচে দাঁড়িয়ে ভীতসন্ত্রস্ত চেহারা। বলল- ‘স্যার আপনাকে কর্মচারীরা মারতে আসবে, আপনি সতর্ক হোন।’ আমি আমার প্যাথলজি বিভাগে গেলে অসীম স্যার আমাকে তাঁর রুমে ঢুকিয়ে বাইরে তালা লাগিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পরেই জঙ্গী মিছিল সেøাগানসহ। আমাকে না পেয়ে আমার পিয়ন নুরুজ্জামানকে মেরে চলে গেছে (তারিখ : ১৫.১১.২০০১ ইং; দৈনিক জনকণ্ঠ, প্রথম আলো ও যুগান্তর)। আরেকদিনের কথা মনে পড়েÑ আমরা টিচার্স লাউঞ্জে শিক্ষক সমিতির সভা করছিলাম। হঠাৎ ওরা আমাদের ঘিরে ফেলল এবং এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করল। আমরা আড়াই ঘণ্টা আটকে থাকলাম। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা মিছিল নিয়ে বেরোব। পুলিশ আমাদের বার বার বাধা দিচ্ছিল। এক সময় আমরা ঝুঁকি নিয়ে পুলিশের ব্যূহ ভেদ করে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। সামনে-পেছনে কর্মচারীরা আমাদের আক্রমণ করল। আমরা বটতলায় সভা করে প্রেসক্লাব পর্যন্ত মিছিল নিয়ে গিয়েছিলাম (তারিখ : ২৩/১১/২০০১ ইং; ভোরের কাগজ, জনকণ্ঠ, প্রথম আলো ও যুগান্তর)। আমরা শিক্ষক সমিতি থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম সংবাদ সম্মেলনের। সব অয়োজন সম্পন্ন। প্রেসক্লাবে যাব। তখন প্যাথলজি বিভাগের চেয়ারম্যান নাহার ম্যাডাম আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, কামরুল, সবাই বলছে প্রেস কনফারেন্সটা না করলে হয় না? আপনাকে কেউ বলতে পারছে না, তাই আমাকে বলেছে। আমি সোজা বললাম, না ম্যাডাম, সংবাদ সম্মেলন হবেই। সে সংবাদ সম্মেলনে আমাদের সম্মানিত ডীনগণসহ অনেক সিনিয়র শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। এ সংবাদ সম্মেলন সেদিন সরকারের সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল। অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয় অন্য কোথাও সরেও যায়নি বা আইপিজিএমআর-এ ফিরে যায়নি। সম্ভব হয়েছিল আমাদের সমমনাদের ঐক্যবদ্ধ কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে (তারিখ : ০৬/১২/২০০১ ইং; দৈনিক সংবাদ, যুগান্তর, প্রথম আলো ও ইত্তেফাক)। কিন্তু শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার লক্ষ্যে সকল অনিয়ম আর দুর্নীতি। ভর্তি পরীক্ষায় অনিয়ম, লোক নিয়োগে অনিয়ম, রেসিডেন্সি বাতিল করে সনাতনী কোর্সে ফিরে যাওয়া, অবৈধ শিক্ষক নিয়োগ-পদোন্নতি, টেন্ডারে দুর্নীতি ইত্যাদি। হারিয়ে ফেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অর্জন, মানুষের আস্থা এবং প্রশ্নবিদ্ধ হলো উচ্চ মেডিক্যাল শিক্ষা। ২০০৯-এ শেখ হাসিনা নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতার দায়িত্ব পাওয়ায় ফিরে এলো আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। পুনর্প্রবর্তিত হলো উচ্চশিক্ষার রেসিডেন্সি কোর্স। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্ত করলেন একনেকের মাধ্যমে ৫২৫ কোটি টাকার ঈবহঃৎব ভড়ৎ ঊীপবষষবহপব চযধংব ওও-এর প্রকল্প, অটিজম শিশুদের চিকিৎসার প্রাণকেন্দ্র, ১২ বিঘা জমি, শাহবাগের পুরাতন বেতার ভবনের জমি, গ্র্যাজুয়েট নার্সিং ইনস্টিটিউটসহ অনেক নতুন পরিকল্পনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আবার উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে নিয়োজিত হলেন উন্নতমানের মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মাণে। কাদেরী স্যারের পরে বিভিন্ন সময় অধ্যাপক মাহমুদ হাসান, অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এবং অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত তাঁদের সাধ্যমতো বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। নজরুল স্যারের সময় চযধংব ওও প্রকল্পটি চূড়ান্ত রূপ লাভ করে, যা প্রায় বাতিল হওয়ার উপক্রম ছিল (সূত্র : অধ্যাপক রুহুল আমিন মিয়া, সাবেক প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলর), যেটি অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্তের সময় একনেকে অনুমোদিত হয়ে বাস্তবায়ন শুরু“হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সাবেক উপাচার্য প্রাণ গোপাল দত্ত তাঁর শেষ দু’বছরে অনেকের যথার্থ সহযোগিতা পাননি, বরং অনেকের কাছে পেয়েছেন প্রচ- বিরোধিতা। যে কারণে অনেক কাজ বিঘিœত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনায় প্রো-ভিসি, কোষাধ্যক্ষসহ সকল কর্মকর্তা, নার্স, কর্মচারীদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস জরুরী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সুদৃষ্টি এবং সার্বিক সহযোগিতা উন্নয়নের প্রধান প্রেরণা। আমি ২০১৫ সালের ২৪ মার্চ উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। প্রশাসনের পরিবর্তনের সময় স্বাভাবিকভাবেই এক ধরনের স্থবিরতা থাকে। এমনকি আমার প্রশাসনের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি রেজিস্ট্রার এবং প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলর (প্রশাসন) ছিলেন না। এক ধরনের সমন্বয়হীনতা বিরাজ করছিল। জীবনের শ্রেষ্ঠ দায়িত্ব মনে করে আমার ব্যক্তিগত জীবন উপেক্ষা করে সবাইকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীতের ধারাবাহিকতা এবং ঐতিহ্য ধারণ করে রাত-দিন পরিশ্রম করে সকল ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে নিয়ে আসি আমি দ্রুততম সময়ের মধ্যে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বন্ধুত্বপূর্ণ কর্মপরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে সকল সেবা, শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ হয় সকল শিক্ষক, চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা, কর্মচারী। ফলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের একটি জায়গা তৈরি হয়। চব্বিশ ঘণ্টা চিকিৎসক উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ, সান্ধ্যকালীন রাউন্ড ও ক্লাসের মাধ্যমে নতুন করে মুখরিত হয় ক্যাম্পাস। টিএসসির সংযোজন শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত করে। দীর্ঘ সময় শিক্ষক চিকিৎসকদের ক্যাম্পাসে থাকা মানেই অধিক চিকিৎসা, অধিক লেখাপড়া। পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ যে কর্মসূচীগুলো বিশেষ গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করে দ্রুত বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছেÑ ১. শিক্ষা কার্যক্রম। ২. গবেষণা কার্যক্রম। ৩. ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসক উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ। ৪. ছঁধষরঃু অংংঁৎধহপব কার্যক্রম। ৫. পূর্ণাঙ্গ চধষষরধঃরাব ঈধৎব বিভাগ চালু করা। ৬. ওচঘঅ কার্যক্রম আরও জোরদার করা। ৭. মাস্টার প্ল্যান তৈরি। ৮. ১০০০ শয্যা বিশিষ্ট ঝঁঢ়বৎংঢ়বপরধষরুবফ ঐড়ংঢ়রঃধষ নির্মাণ। ৯. নার্সিং সেবা ও শিক্ষা উন্নয়ন। ১০. ল্যাবরেটরি সার্ভিস ২৪ ঘণ্টা চালু করা। ১১. নিয়মিত মাসিক ও বিভাগীয় সেমিনার আয়োজন করা। ১২. মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার বিশেষ ব্যবস্থা করা। ১৩. ইমার্জেন্সি চালু করা। ১৪. অটোমেশন কার্যক্রম। ১৫. ঙহব ঢ়ড়রহঃ পযবপশঁঢ় পবহঃৎব চালু করা। ১৬. নতুন ঙঞ, ওঈট চালু করা। ১৭. সর্বস্তরে প্রশাসনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ১৮. বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উচ্চমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করা। ১৯. দেশের সিনিয়র সিটিজেনদের চিকিৎসার সুবিধার্থে এবৎরধঃৎরপ গবফরপরহব চালু করা। ২০. ইড়হব গধৎৎড়ি ঞৎধহংঢ়ষধহঃধঃরড়হ চালু করা। ২১. করফহবু ঞৎধহংঢ়ষধহঃ ধহফ ঈযড়পযষবধৎ ওসঢ়ষধহঃ কার্যক্রম বৃদ্ধি করা। ২২. শিক্ষক, কর্মকর্তা ও নার্সদের যথাসময়ে নিয়োগ ও পদোন্নতির ব্যবস্থা করা। ২৩. সেন্টার ফর এক্সিলেন্সের তৃতীয় পর্যায়ের প্রকল্প গ্রহণ করা। ২৪. ডে কেয়ার সেন্টার চালু করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারীদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় দেশে-বিদেশে সমাদৃত, মানুষের আস্থা, ভরসারস্থল। এ কারণেই গত ডিসেম্বরে বিশ্বসেরা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্মত চিকিৎসা এবং গবেষণা কার্যক্রমের জন্য। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে স্পেনের সিমাগো রিসার্চ গ্রুপ ও যুক্তরাষ্ট্রের স্কপাস পরিচালিত জরিপে দেশে ৫ম এবং বিশ্বে ৬৪০তম অবস্থানে স্থান পায় দেশের একমাত্র এই মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। জরিপে দেখা যায়, ভারতের একটি ইনস্টিটিউট এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে আছে অন্যান্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সমগ্র জীবন, ব্যক্তিগত আকাক্সক্ষা, পারিবারিক জীবন ত্যাগ করে শুধু চেয়েছেন বাঙালীর স্বাধীনতা এবং সুখী-সমৃদ্ধ জীবন। আমরা যারা তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করি আমাদের কোন ত্যাগ করতে হবে না, শুধু আমাদের নিজ নিজ দায়িত্বটুকু যথাযথভাবে পালন করে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি। আমরা সবাই মিলে জাতির পিতার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের মানুষের সর্বোচ্চ সেবা প্রদানে এবং বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষিত চিকিৎসক তৈরিতে বদ্ধপরিকর- এটাই হোক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ২০তম দিবসের অঙ্গীকার। লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×