ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

সচল ধলেশ্বরী অচল অপেরা

প্রকাশিত: ০৭:১২, ২৭ এপ্রিল ২০১৭

সচল ধলেশ্বরী অচল অপেরা

গাভী ঘাস খায় কিন্তু দেয় দুধ। অপরদিকে সাপ দুধ খায় কিন্তু দেয় বিষ। অনেকটা তেমনিভাবে অনুবাদক-ভাবানুবাদক কিংবা রূপান্তকারীর অক্ষমতায় কিংবা দক্ষতায় এক ভাষার সাহিত্য অপর ভাষায় অনুবাদ-ভাবানুবাদ কিংবা রূপান্তরে বিষামৃত কিংবা অমৃত হয়ে ধরা দেয়। সে পথের যাত্রী হয়ে নাট্যকার নির্দেশক অভিনেতা পান্থ শাহ্রিয়ারের রচিত নির্দেশিত ও অভিনীত শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ অবলম্বনে নাটক ধলেশ্বরী অপেরা। ম্যাকবেথ অবলম্বনে কিন্তু ম্যাকবেথ না বরং অন্য গল্পের ভেতর দিয়ে ম্যাকবেথের গল্প খোঁজার উচ্চাকাক্সক্ষা ও করুণ পরিণতির নাটক ধলেশ্বরী অপেরা। রেপাটরি নাট্যদল আগন্তুকের দ্বিতীয় প্রযোজিত নাটক ধলেশ্বরী অপেরা মঞ্চায়িত হলো গত ১৯ এপ্রিল শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল হলে। এক্সপেরিমেন্টাল হলে কিংবা স্টুডিও হলে তাপস সরকার কিংবা মিলন কান্তি দের আবেদনের প্রেক্ষিতে যাত্রা মঞ্চায়নের দিনক্ষণ মিললেও কাল্পনিক যাত্রা দল ধলেশ্বরী অপেরা কোথায় যাত্রা করে সে কথা জানা না গেলেও ধলেশ্বরী অপেরার অন্দর মহলের কথা জানা যায় নাট্য মঞ্চায়নের সুবাধে। যাত্রা দলের সংদের ভবিষ্যদ্বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে নটবর মুরাদ সিং এবং প্রধান অভিনেত্রী নয়নতারা ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছাতে মিলেমিশে যাত্রা দল প্রধান অঘোরনাথকে খুন করে। ভবিষ্যত এর কাঁটা ভেবে দলীয় কর্মী বদিকেও নির্মূল করে। মাঝখান থেকে এক সময়ের দলের প্রধান অভিনেত্রী পরীমণি হিসাব নিকাশের দোলাচলে মুরাদ সিংকে হত্যা করে। অপরদিকে অপরাধের অনুশোচনা এবং আত্মসম্মান হারিয়ে নয়নতারা আত্মহুতি দেয়। আত্মহত্যা আর হত্যার অবসানে ‘দলপ্রধান হওয়াটাই বড় কথা নয় বরং হয়ে থাকাটাই বড় কথা’ মর্মবাণী উচ্চারণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় নাটক ধলেশ্বরী অপেরা। অপেরা সার্কাসে থাকে ক্লাউন, নাটকে থাকে সূত্রধর আর যাত্রায় বিবেক। সেই হৃদয়স্পর্শী বিবেক আজ আর নেই বরং আছে মগজ বাস্তবতায় কৌশলী আচরণ। ফলে শরীকানা বিরোধ, কেলেঙ্কারির অপরাধ কিংবা অশুভ শক্তির আক্রমণে দলপ্রধানের পরিবর্তনের বিপরীতে ধলেশ্বরী অপেরা নাটকে খুনোখুনির কারণ হয়ে দেখা দেয় পাওয়ার ট্রান্সফারে। যেটি বাংলা যাত্রাপালার প্রেক্ষাপট নয়। দ্বিতীয়ত, থিয়েটার এবং যাত্রার লোকবল কমে যাওয়ার ক্ষয়িষ্ণুকালে দলপ্রধানদের বিপরীতে অভিনেতা-অভিনেত্রী তথা নটবরদের রিভল্ট বা বিদ্রোহ প্রকাশ প্রকারান্তরে শিল্প মাধ্যম দুটির ক্ষতি সাধনে উদ্বুদ্ধকরণ। তৃতীয়ত, সেক্সসুয়াল হ্যারেজমেন্ট কিভাবে হয় একটি দলের পথচলার প্রধানতম প্রবহমানতা! নাট্যকার পান্থ শাহ্রিয়ার দক্ষ ম্যাকবেথ অনুধাবনে, চৌকস চমৎকার রূপান্তরে কিন্তু চূড়ান্ত ব্যর্থ শেক্সপিয়ারকে বাঙালীকরণে। আর যাই হোক ধলেশ্বরী অপেরায় শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথের ছায়া পাওয়া যায় কিন্তু ধলেশ্বরী অপেরায় বাংলার যাত্রা পালাকে এবং তৎসংশ্লিষ্ট জীবনকে পাওয়া যায় না। অশুভ শক্তি জানে যাত্রা-নাটক-পুতুল নাচ প্রভৃতি শিল্প মাধ্যম সত্য কথা বলে। তাই তারা তাদের কদাকার মুখ ঢেকে রাখতে বিভিন্ন উসিলায় এসব মাধ্যমের বিপরীতে অবস্থান নেয়। তাই বলে শুভশক্তির প্রতিভূ পান্থ শাহ্রিয়ার এবং আগন্তুক শেক্সপিয়ারের ফ্যাশনে গাঁ ভাসিয়ে লুপ্ত প্রায় যাত্রার ভরাডুবিকে করবে আরও ত্বরান্বিত- তা ভাবা যায় না। ভাবা যায় না কত লিমিটেড সুযোগ অথচ আনলিমিটেড অভিনয় দক্ষতায় যাত্রাদল প্রধান অঘোরনাথকে জীবন্ত করে তুলে ধরা যায় সাধনা-কৌশল আর জীবন বাস্তবতায়। সেটিই করে দেখালেন অন্তরে সরল কিন্তু বহিঃরাঙ্গে গরল অভিনেতা শতাব্দী ওয়াদুদ। বহিরাঙ্গে আকর্ষনীয়া, অন্তরাত্মায় উচ্চাভিলাষী, সঙ্কটে অভয়দাত্রী, স্বার্থাঘতে জিঘাংসী, প্রণয়ে ছলনাময়ী আর আত্মসম্মান হারিয়ে পাগলিনী তথা আত্মঘাতীরুপী নয়নতারা চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে অভিনেত্রী ত্রপা মজুমদার নান্দনিক এবং অনবদ্য। অনবদ্য অভিনয়ের কারণেই অভিনেত্রী ত্রপা মজুমদারের কাছে সবিনয় নিবেদন, অন্তর-বাহির, প্রেম-কাম, তাচ্ছিল্য-শ্রদ্ধা যেমন এক না তেমনি নয়ন তারা আর ত্রপা মজুমদার এক না। নয়ন তারা সেখানে বহির্মুখী, ত্রপা মজুমদার সেখানে অন্তর্মুখী। অন্তর্মুখী মানুষের পক্ষে অন্তর্যাত্রাভিনয়ই আদৃত। সেক্ষেত্রে হোক না খানিকটা সময়ের বিলম্ব। বিলম্ব নয় বরং উদ্বোধনী মঞ্চায়নের প্রাক্কালেই আগন্তুক তাদের এই প্রযোজনায় প্রণতি জানিয়েছেন ম্যাকবেথখ্যাত অভিনেতা আলী যাকের এবং লেডি ম্যাকবেথখ্যাত অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদারের প্রতি। বিষয়টা আনন্দের কিন্তু বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবনে কথা থাকে। সকল কিছু সরলীকরণ আর পাবলিক করণের এই সস্তাকালে যা বলবার তা হল কাকে ঠোকরানো ফল পূজায় লাগে না। স্ক্রিপটি থেকে প্রোডাকশনের কোথাও তাদের পথনির্দেশনা চাওয়া বা নেয়া হলো না অথচ ধূম করে প্রণতি- একি কথা! তাদের নেয়ার মতো কিংবা দেয়ার মতো হলো কিনা তাও তো ভাবা চাই। শুধু ভাবা না বরং এমন ধলেশ্বরী অপেরা হওয়া চাই যা ধলেশ্বরী নদীর চর সরিয়ে অপেরাকে পুনর্সচল করে।
×