ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মগবাজার মৌচাক ফ্লাইওভার প্রকল্প ॥ চার কিলোমিটার সড়কে মহাদুর্ভোগ

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২৭ এপ্রিল ২০১৭

মগবাজার মৌচাক ফ্লাইওভার প্রকল্প ॥ চার কিলোমিটার সড়কে মহাদুর্ভোগ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ শাজাহানপুর মোড় থেকে মগবাজার ওয়্যারলেস গেট পর্যন্ত সড়কে ছোট বড় অসংখ্য গর্ত। টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে ডুবেছে সড়ক। ডুবু-ডুবু হয়ে চলছে রিক্সা। পাশাপাশি ছোট ছোট যান উল্টে যাবার ঘটনাও অহরহ ঘটছে। আহত হচ্ছেন যাত্রীরা। ঝুঁকি নিয়ে হেলেদুলে চলে অন্যান্য গাড়ি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, অন্তত ছয় দিন ধরেই এমন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। গত কয়েকদিনের বৃষ্টি দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে বলে জানান তারা। বলছেন, উন্নয়ন কাজের নামে প্রায় তিন মাস ধরে বন্ধ রয়েছে মৌচাক থেকে মালিবাগ রেলগেট পর্যন্ত সড়কের একাংশ। গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কের একপাশ বন্ধ থাকা মানে দুর্ভোগ কোন মাত্রায় যেতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। বাস্তবতা হলো, কর্তৃপক্ষ তবুও দুর্ভোগ দেখেন না। তাদের চোখে অনেক কিছুই স্বাভাবিক। একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে দায় সারতে চায় একাধিক দায়িত্বশীল সংস্থা। খবর নিয়ে জানা গেছে, তিনটি সংস্থার উন্নয়ন কাজ চলছে মগবাজার-মৌচাক প্রকল্প এলাকার রাস্তায়। এর মধ্যে এলজিইডির তত্ত্বাবধানে উড়াল সড়ক। এছাড়াও সিটি কর্পোরেশন ও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ ড্রেন নির্মাণের কাজ চালাচ্ছে তিন মাসের বেশি সময়। কবে কাজ শেষ হবে এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না। জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ প্রায় ছয় মাস ধরেই চলছে। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, মগবাজার-মালিবাগ-মৌচাক-শান্তিনগর ও রাজারবাগ মিলিয়ে প্রায় চার কিলোমিটার সড়কে জনদুর্ভোগ চরমে উঠেছে। লাব্বাইক পরিবহনের চালক ফিরোজ জানান, মগবাজার ওয়্যারলেস গেট থেকেই দুর্ভোগের শুরু। যা শেষ হয়েছে শাজাহানপুর মোড়ে গিয়ে। অনেক সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়। বৃষ্টি না থাকলেও কয়েক মাস ধরে সড়কের দু’পাশ ডুবে থাকে। বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হওয়ায় দিন দিন সড়কটি চলাচলের অযোগ্য হচ্ছে বলেও জানান তিনি। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা রাজারবাগের রাস্তা থেকে শুরু করে মৌচাক-মালিবাগের আবুল হোটেল-শান্তিনগরসহ ওয়্যারলেস গেট পর্যন্ত সড়কটি। এক সঙ্গে একাধিক উন্নয়নকাজ এবং কাজের ধীরগতির কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের ভোগান্তি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন মালিবাগের বাসিন্দা কাওসার। একই সময়ে একই রাস্তায় তিনটি উন্নয়নকাজ করা হচ্ছে। ফলে এই অস্বাভাবিক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে আমাদের। এসব কাজ ধাপে ধাপে করলেও তো ভোগান্তিটা আমাদের কম হতো। এছাড়া দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য বেশি যন্ত্রপাতি ও লোকবল নিয়োগ করলেও উন্নয়নের নামে এই নিগ্রহ থেকে আমরা রেহাই পেতাম। আবুজর গিফারী কলেজের ছাত্র জুয়েল মিয়া জানান, কলেজে আসতে আমাদের মহাদুর্ভোগ পোহাতে হয়। সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা ও ফ্লাইওভারের কাজ চলায় একটি রাস্তা বন্ধ। অন্য রাস্তাটি দিয়ে চলাচলের উপায় নেই। তাই অনেক গাড়ি মৌচাক মোড় থেকে আমাদের কলেজের সামনে দিয়ে ঢুকছে। দিনভর সড়কটিতে যানজট থাকায় শিক্ষার্থীদের চলাচলে অসুবিধা হয়। তাছাড়া পানি মাড়িয়ে আমাদের রাজারবাগ পর্যন্ত যেতে হয় প্রতিদিন। আমরা চাই দ্রুত দুর্ভোগের নিরসন হবে। অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, জনবল সঙ্কটের কারণে উড়াল সড়কের কাজে একেবারেই গতি নেই। কোন রকম কাজ চালিয়ে যাওয়ার মতো। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের অবহেলার কারণে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল নেয়া হচ্ছে না। এর নজির হিসেবে অনেকে বলছেন, এক বছর ধরে চলা মালিবাগ ও মালিবাগ রেলগেট এলাকায় কাজের তেমন কোন অগ্রগতি নেই। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়ক প্রকল্পের পরিচালক সুশান্ত কুমার বিশ্বাস জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী জুন মাসের মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করে জুন মাসে উদ্বোধন করা হবে। এরপর যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে ফ্লাইওভারটি। তিনি বলেন, চলতি মাসের মধ্যে এফডিসি গেট থেকে সোনারগাঁও হোটেল পর্যন্ত প্রস্তুত হওয়া লুপটিও খুলে দেয়া হবে। জনভোগান্তির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, আমরা সাধারণ মানুষের ভোগান্তির বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রেখে নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, এখন ফ্লাইওভার নির্মাণকাজের জন্য কোন ভোগান্তি হচ্ছে না। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে প্রকল্প এলাকার বেশকিছু স্থানে ড্রেন নির্মাণ করা হচ্ছে। ড্রেনের পানি রাস্তায় এসে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে আমাদের কাজও অনেক সময় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, পানি জমে থাকার কারণে অনেক স্থানে রাস্তা নষ্ট হচ্ছে। আবার যেসব স্থানে রাস্তা নষ্ট হয়ে আছে সেগুলো আমরা মেরামত করতে পারছি না। এসব সমস্যার জন্য সাধারণ মানুষ আমাদের দোষারোপ করছে। কিন্তু আমরা তো কোনভাবেই দায়ী নই। নানা প্রতিকূলতা থাকলেও দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি। তবে মালিবাগ রেলগেট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের কারণে সড়কের একপাশ বন্ধ রাখা হয়েছে ১৫ দিনের বেশি। আইল্যান্ড কেটে রাস্তা করা হয়েছে। এক সড়ক দিয়ে চলছে দুই লেনের গাড়ি। এতে জনদুর্ভোগ বেড়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নিষ্কাশন নালার জন্য এলাকায় খোড়াখুঁড়ি করছে বলেই জলাবদ্ধতা হয়েছে- এমন দাবি করেন ফ্লাইওভার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোঃ শরীফুল ইসলাম। তার ভাষ্য, জলাবদ্ধতা নিরসনে তাদের কিছুই করার নেই। তিনি বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে এখানে ব্যবস্থা নেয়ার কিছু নাই। কারণ ড্রেন কাটতেছে বলে সবকিছু বন্ধ করে রাখছে। আমরা কিভাবে পানি নিষ্কাশন করব? এ অভিযোগ অস্বীকার করে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন অঞ্চল-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ হানিফ পাটোয়ারী বলেন, এ এলাকার দুর্ভোগের জন্য সিটি কর্পোরেশন দায়ী নয়। ফ্লাইওভার নির্মাণকাজের জন্যই লোকজনের দুর্ভোগ হচ্ছে। আমরা সেখানে কাজ শুরু করেছি ছয় মাস আগে। আর ওই ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ আরও দুই বছর আগে শেষ হওয়ার কথা। সেটা ঠিক সময়ে শেষ হলে আমাদের প্রজেক্টের সঙ্গে কনফ্লিক্ট করত না। মূল ব্যাপার হল দীর্ঘদিন ধরে তারা নির্মাণকাজ করছে। এ কাজ করার সময় ওয়াসার নিষ্কাশন নালা ভরাট হয়ে পানি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে সড়কে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের নিষ্কাশন নালা তৈরি হয়ে গেলে মৌচাক ও মালিবাগ এলাকার জলাবদ্ধতা থাকবে না বলে জানান হানিফ পাটোয়ারী। তবে এ বছর কোন সুসংবাদ দিতে পারছেন না তিনি। এ বছর আমাদের কাজ চলায় একটু কষ্ট হবে। আশা করি আগামী বছর থেকে এ এলাকায় আর জলাবদ্ধতা হবে না। মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভার প্রকল্প এলাকায় গত তিন মাস ধরে শান্তিনগর চৌরাস্তা থেকে মালিবাগ, রাজারবাগ, মৌচাক হয়ে আবুল হোটেল পর্যন্ত সড়কে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। গত তিন দিনের বৃষ্টিপাতের পর সড়কে পানি আরও বেড়েছে। অথচ ড্রেনেজ নির্মাণের কাজ এখনও অনেক বাকি। ইতোমধ্যে আগাম বর্ষা শুরু হয়েছে। সেইসঙ্গে সড়কে তৈরি হয়েছে অসংখ্য খানাখন্দ, যাতে প্রায়ই যানবাহন বিকল হচ্ছে, ঘটছে দুর্ঘটনা। মৌচাক মোড় থেকে মালিবাগ রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়কের একপাশে পয়োনিষ্কাশনের পাইপ বসানোর কাজ করছে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। গর্ত খুঁড়ে রাস্তায় মাটি ফেলে রাখায় সড়কের এই অংশে বন্ধ রয়েছে চলাচল। ভাঙাচোরা এই সড়কে পানি জমে থাকায় প্রতিদিন যানজট হচ্ছে বলে জানান মৌচাকে দায়িত্ব পালনকারী ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট নূরতাজুল ইসলাম। সামনে গর্ত আছে এই ভয়ে অনেক গাড়ি সামনে এগুতে চায় না। এছাড়া প্রায়ই গাড়ি বিকল হয়ে যায়। ধীরগতিতে চলে যানবাহন। ফলে পেছনে গাড়ির লম্বা লাইন তৈরি হয়ে যায়। সড়কে পানি জমে থাকায় ফুটপাথের দোকানগুলোও খোলা যাচ্ছে না বলে জানালেন ফুটপাথের দোকানি মতি মিয়া। মালিবাগ চৌরাস্তা থেকে মৌচাক হয়ে রামপুরা যেতে এ সড়কের এক পাশে পানি জমে আছে। সড়কে তৈরি হয়েছে ছোটবড় অসংখ্য গর্ত। দুর্ভোগ এড়াতে খিলগাঁও হয়ে আসা রামপুরাগামী যানবাহন খিলগাঁও কমিউনিটি সেন্টারের সামনের সড়ক হয়ে আবুল হোটেল পর্যন্ত যাতায়াত করে। কিছু বাস চললেও ছোট যানবাহন চলতে দেখা যায়নি। সড়কের এ অংশে কোন রিক্সা চলে না। দেশের দীর্ঘতম মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারটির দৈর্ঘ্য ৮ দশমিক ২৫ কিলোমিটার। এর মোট তিনটি অংশ। গত বছরের ৩০ মার্চ ফ্লাইওভারের সাতরাস্তা থেকে হলি ফ্যামিলি পর্যন্ত ২ দশমিক ১১ কিলোমিটার দৈর্র্ঘ্যরে প্রথম অংশটির উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাকি অংশ এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। জানা গেছে, ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) তত্ত্বাবধানে এ উড়াল সড়কের নির্মাণকাজ শুরু হয়। যা ২০১৫ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। সব মিলিয়ে কয়েক দফা সময় বৃদ্ধি হয়েছে। এখন প্রকল্পের কাজ শেষ করার সর্বশেষ সময়সীমা চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ২০১১ সালে একনেকে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়।
×