ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যুবক-যুবতীর প্রেম ও পলায়নের ঘটনার জের ॥ উদ্ধার তৎপরতায় বিজিবি

ফটিকছড়িতে সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে ৭৮ জন জিম্মি

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৭ এপ্রিল ২০১৭

ফটিকছড়িতে সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে ৭৮ জন জিম্মি

মোয়াজ্জেমুল হক/ইউনূস মিয়া ॥ ত্রিপুরা উপজাতীয় যুবতীর সঙ্গে বাঙালী যুবকের প্রেম ও পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাহাড়ী অজ্ঞাতনামা একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ ২১ পরিবারের ৭৮ নারী-পুরুষ ও শিশুকে অপহরণের মাধ্যমে জিম্মি করেছে। ৫ দিন ধরে গহিন অরণ্যে জিম্মি করে রাখার এ ঘটনা ফাঁস হয়েছে বুধবার। অপহৃতদের মধ্যে অধিকাংশই ত্রিপুরা জাতির সদস্য। তবে ওরা নেপালী বংশোদ্ভূত। ব্রিটিশ আমল থেকে বংশ পরম্পরায় চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে কাজ করে আসছে। অপহৃতদের মধ্যে বাঙালী সম্প্রদায়ের স্বল্পসংখ্যক সদস্যও রয়েছে বলে জানা গেছে। ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ভুঁজপুর থানাধীন খাগড়াছড়ি-রামগড় উপজেলা সীমান্তের দুর্গম পাহাড়ী এলাকার দাঁতমারায়। ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর বিজিবির সিন্ধুকছড়ি জোনের পক্ষ থেকে উদ্ধার অভিযান শুরু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশন কার্যালয় সূত্র। তবে বুধবার সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অপহৃতদের কোন এলাকায় জিম্মি করে রাখা হয়েছে তা নিশ্চিত করা যায়নি। ২১ পরিবারের ৭৮ সদস্যকে জিম্মি করার ঘটনাটি ঘটে গত শুক্রবার। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, এলাকার যুগ্যারছোলা ইউনিয়নের উপজাতীয় ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের যুবতী শব্দমালা ত্রিপুরার (২০) সঙ্গে একই এলাকার বাঙালী সুরত আলীর ছেলে আরিফের (২৬) সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দীর্ঘদিন সম্পর্কের পর গত বৃহস্পতিবার শব্দমালা ও আরিফ এলাকা থেকে পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পর ভারতের সাবরুম সীমান্তবর্তী বাংলাদেশী অঞ্চলের ওই এলাকার গহিন অরণ্যের সশস্ত্র সন্ত্রাসী একটি গ্রুপ ফটিকছড়ির দাঁতমারা ইউনিয়নের নাছিয়া চা বাগানে কর্মরত এসব ত্রিপুরা ও বাঙালী সম্প্রদায়ের ৭৮ নর-নারী ও শিশুকে অপহরণ করে জিম্মি করে ফেলেছে। অপহরণকারীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সূত্রে প্রশাসনকে সুনির্দিষ্টভাবে দাবি পেশ করা হয়েছে, ত্রিপুরা যুবতী শব্দমালাকে ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত ৭৮ জনকে জিম্মি করে রাখা হবে। উল্লেখ্য, পালিয়ে যাওয়া যুবতী শব্দমালা চা বাগান শ্রমিক তসিরাম ত্রিপুরার কন্যা। আর আরিফ একই চা বাগানের শ্রমিক সুরত আলীর পুত্র। উল্লেখ্য, পুরো ফটিকছড়ি এলাকাটি ৭৮০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে। এক সময়ের বৃহৎ এ উপজেলায় আরও একটি থানা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নাম ভুঁজপুর। ঘটনাটি ভুঁজপুর থানার অধীনে। এ এলাকায় সেনাবাহিনীর কোন কর্মকা- নেই। তবে বিজিবির সিন্ধুকছড়ি জোনের অধীনে রয়েছে। এলাকাটি ফটিকছড়ির পূর্বে এবং মানিকছড়ির পশ্চিমাংশে। এরপরই ভারতীয় সীমান্ত। ওপারে সাবরুম। দুই দেশের সীমান্ত এলাকার এ অঞ্চলটি গহিন অরণ্য হওয়ায় সেখানে চা বাগান শ্রমিকদেরই বসবাস বেশি। পুরো এলাকায় রয়েছে ৬টি চা বাগান। যেগুলোতে শ্রমিক সংখ্যা তিন সহস্রাধিক। নাছিয়া চা বাগানের বিপুলসংখ্যক কর্মচারী গত শুক্রবার থেকে কাজে আসছে না প্রত্যক্ষ করে বাগান ম্যানেজার খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন এদের একদল পাহাড়ী সন্ত্রাসী গ্রুপ আলোচনার নামে ডেকে নিয়ে জিম্মি করেছে। চা বাগান ম্যানেজার মুনির হায়দার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে ৫ দিন পর বুধবার মৌখিকভাবে থানা পুলিশকে অবহিত করেন। পাশাপাশি বিজিবি কর্তৃপক্ষকেও জানান। এর ফলে ঘটনাটি ফাঁস হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বুধবার সকলেই ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। তবে বিস্তারিত তারা অবহিত এখনও হননি। বিজিবি সদস্যদের উদ্ধার প্রস্তুতি কার্যক্রমে নিয়োজিত করা হয়েছে। ফটিকছড়ি দাঁতমারা ইউপি চেয়ারম্যান জানে আলম জানিয়েছেন, সন্ত্রাসী গ্রুপের নেতাদের সঙ্গে তিনি মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন। গ্রুপের পক্ষ থেকে তাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, শব্দমালা ত্রিপুরাকে ফেরত বা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত অপহৃত ৭৮ জনকে তারা জিম্মি করে রাখবে। চেয়ারম্যান বিষয়টি রামগড় বিজিবির জোন কমান্ডার, রামগড় পাতাছড়ার ইউপি চেয়ারম্যানসহ সকলকে অবহিত করেছেন। তবে ভুঁজপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল লতিফ জানিয়েছেন, তিনি এ ধরনের ঘটনার কথা লোকমুখে শুনেছেন। কিন্তু অভিযোগ আকারে পাননি। সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশনের অফিস সূত্রে জানানো হয়েছে, পাহাড়ে উপজাতীয় নর-নারীরা এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটালে তাদের সম্প্রদায়ের সদস্যদেরই শাস্তির আওতায় আনা হয়। এটাও অনুরূপ একটি ঘটনা। যে কারণে ত্রিপুরা উপজাতি সম্প্রদায়ের যুবতী শব্দমালা ত্রিপুরা অন্য সম্প্রদায়ের যুবকের সঙ্গে ভালবাসা ও পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় ওই এলাকার বেশিরভাগ ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের সদস্যদের জিম্মি করা হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শব্দমালা ত্রিপুরা ও আরিফ প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর পালিয়ে গেলে এলাকার সোনারখিলস্থ গহিন জঙ্গলে অবস্থানকারী উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের পক্ষ থেকে ওই গ্রামে বসবাসকারী সদস্যদের বিষয়টি নিয়ে আলোচনার কথা বলে ডেকে নিয়ে যায়। এরপরই তাদের জিম্মি করে ফেলে। বিজিবি সূত্রে জানানো হয়েছে, জিম্মি করে রাখার বিষয়টি সঠিক। তারা জানতে পেরেছে পালিয়ে যাওয়া যুবতী শব্দমালাকে তার পিতার জিম্মায় ছেড়ে দিলে ৭৮ জিম্মিকে ছেড়ে দেবে, এর আগে নয়। এ ঘটনা নিয়ে নাছিয়া চা বাগানসহ অপরাপর বাগানগুলোতে কর্মরত শ্রমিকদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এলাকায় চলছে তোলপাড়। কিন্তু অপহরণ করে রাখার এলাকাটি এতই গহিন অরণ্যে যে সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দ্রুত পৌঁছানো সহজ ব্যাপার নয়। এর পাশাপাশি সশস্ত্র গ্রুপগুলোর হামলার আশঙ্কার বিষয়টিও জড়িত। এলাকা সূত্রে জানা গেছে, শব্দমালা ও আরিফের মধ্যে দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। একপর্যায়ে তারা পালিয়ে গিয়ে বিয়েও করে ফেলেছে। শব্দমালার পুরো পরিবারকে সন্ত্রাসীরা তুলে নিয়ে গেছে। মা, বাবা, ভাইবোন সকলেই এখন জিম্মিদশায় রয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ফটিকছড়ি এলাকায় যে সকল চা বাগান রয়েছে সেখানকার অধিকাংশ শ্রমিক ত্রিপুরা জাতির সদস্য। এদের পূর্বপুরুষ এসেছে নেপাল থেকে সেই ব্রিটিশ আমলে। বংশ পরম্পরায় এরা চা বাগানে কাজ করে আসছে। প্রসঙ্গত, রামগড়ের উত্তর দিকে দক্ষিণ ত্রিপুরা, ফটিকছড়ির পূর্বদিকে সিমুতাং গ্যাসক্ষেত্র অবস্থিত। সেখান থেকে ভারত সীমান্ত ১০ থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে। এরপরই সাবরুম। শব্দমালা ও আরিফ পালিয়ে গিয়ে কোথায় অবস্থান করছে তা কারও জানা নেই। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী পাহাড়ি সন্ত্রাসী এ ৭৮ জনকে রামগড়ের গুজাপাড়া, মরা কয়লা, গরুকাটা, মাঝিরপাড়াসহ গহিন অরণ্যের বিভিন্ন স্থানে পৃথক পৃথকভাবে আটকে রেখেছে। তাদের অনিয়মিত খাদ্য সামগ্রী দেয়া হচ্ছে। কিন্তু স্বাভাবিক খাদ্য সামগ্রী না পাওয়ার কারণে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছে বলে স্থানীয় সূত্র জানতে পেরেছে। সেনাবাহিনী সূত্রে বিষয়টি নিয়ে কোন বক্তব্য দেয়া হয়নি। বলেছে, এলাকাটি বিজিবির অধীনে। যা করার তারাই করার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যেই প্রাথমিক প্রস্তুতির অভিযান শুরু হয়েছে। প্রয়োজনে বড় ধরনের অভিযান শুরু করা হবে।
×