ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নির্বাচনী বৈতরণী -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ২৭ এপ্রিল ২০১৭

নির্বাচনী বৈতরণী -স্বদেশ রায়

তিন দিন হলো কোন প্লেন উড়ছে না নিউইয়র্ক জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্ট থেকে। আকাশ মেঘে ঢাকা। নিচে বরফের স্তূপ। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে এসে আটকা পড়েছেন নানান দেশের সাংবাদিকরা। প্রথম দুই দিন যার যার নিজ নিজ কাজ, লেখাপড়ার ভেতর দিয়েই হোটেলে সময় কেটেছে। তৃতীয় দিনে সবাই বোর। কিন্তু কেউ কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। এর ভেতর ছিলেন দু’জন বাঙালী সাংবাদিক। এই দুই সাংবাদিক লাঞ্চের পরেই কীভাবে যেন সব সাংবাদিককে জড়ো করে ফেললেন লবিতে, কিছুক্ষণের ভেতর শুরু হয়ে গেল আড্ডা। বাঙালী দু’জনের কণ্ঠস্বর একটু উঁচু। বাদবাকিকেও তারা অতি অল্প সময়ে আড্ডায় রপ্ত করে ফেললেন। শুধু আড্ডায় রপ্ত করে ক্ষান্ত দিলেন না, তাদের সকলকে জলবায়ু রেখে রীতিমতো রাজনৈতিক বায়ুম-লে নিয়ে এলেন। আর যখনই রাজনৈতিক বায়ুম-লে ঢুকে গেল তখনই রকেটের চালকের আসনে বসে পড়লেন দুই বাঙালী, পাক্কা চালকের মতো নিজেদের ইচ্ছে অনুযায়ী রকেট চালিয়ে পারফেক্ট ল্যান্ড করলেন নির্বাচনী এলাকায়। প্রথম বাঙালী ভারতীয়, তিনি তার দেখা এক জনপ্রতিনিধির নির্বাচনী রাজনীতির কাহিনী শোনার জন্য সকলকে অনুরোধ করলেন। এই জনপ্রতিনিধির প্রথমবার নির্বাচনে আসার আগে রাজনীতি ও নির্বাচন সম্পর্কে তার কোন ধারণা ছিল না। তার দেশের একটি নিষিদ্ধ মাংস রফতানি করে তিনি বহু টাকা রোজগার করেন। ভাল রুচিকর হওয়ায় সবার যেমন ক্ষুধার উদ্রেক হয়, এই টাকা রোজগারের পরে গড়গড়িয়া মহাশয়েরও জনসেবার উদ্রেক হয়। জনসেবা করার জন্য তিনি প্রথমে কয়েক দরিদ্র ছাত্রকে পড়ার খরচ দিলেন। আর কয়েকজনকে বই কিনে দিলেন। এটা দেয়ার পরে তিনি জানতে পারলেন– যারা নাকি তার মতো এত অঢেল টাকা রোজগার করেননি, টেনেটুনে সংসার চালান তারাও এ কাজ করেন। গড়গড়িয়া মহাশয় পাকা ব্যবসায়ী। তিনি ঘ্রাণ পেলেই রান্নার স্বাদ বুঝতে পারেন। ভাল-মন্দের কারণও বলে দিতে পারেন। এখানেও তিনি ভুল করলেন না। তিনি বুঝে ফেললেন, আর দশজনে যা করে তা সাধারণ কাজ। এই পথ ধরে জনসেবা করা যাবে না। গড়গড়িয়া মহাশয় কয়েকদিন নিশ্চুপ হলেন। তারপরে তিনি বন্ধু-বান্ধবদের জানিয়ে দিলেন, এতদিন তিনি অন্ধ ছিলেন। মায়ের কৃপায় তার চোখ খুলেছে, তাই তিনি এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, এই জনদের যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই মহান স্রষ্টাকে সেবা করতে হবে আগে। এবার গড়গড়িয়া মহাশয় ওই এলাকার যত পুরনো মঠ ও মন্দির আছে সব পরিদর্শনে বের হলেন। বেশ লম্বা সময় গেল এ পরিদর্শনে। পরিদর্শন শেষে তিনি জানালেন, জনসেবার জন্য এখন তার আত্মশুদ্ধি প্রয়োজন। এতদিন ব্যবসায়ে ব্যস্ত থাকার ফলে আত্মশুদ্ধি না করে তিনি মহাপাতকি হয়েছেন। যদিও তিনি কোন পাপ করেননি। তবে আত্মশুদ্ধি করেননি ঋতু অন্তে বা বছরান্তে, গ্রহ নক্ষত্রের চলার পথ দেখে। অতএব এখন তার বহু বাদ পড়ে যাওয়া শুদ্ধির কাজ অল্প দিনেই সারতে হবে। অর্থাৎ গভীর সাধনার বিষয়। গড়গড়িয়া মহাশয় কালক্ষেপণ না করে নিরম্বু উপবাসসহ নানা ক্রিয়ার ভেতর দিয়ে অন্ধকার প্রকোষ্ঠের ভেতর বসে আত্মশুদ্ধির জন্য যত পারেন দেহ ও মনসহ ষড়রিপুকে কষ্ট দিতে শুরু করলেন। সপ্তম দিবসে গড়গড়িয়া মহাশয় জীর্ণশীর্ণ শরীর নিয়ে বের হয়ে এলেন অন্ধ প্রকোষ্ঠ থেকে এবং খোদ গঙ্গা থেকে আনা সাত ঘড়া গঙ্গাজলে তিনি স্নান করলেন। স্নান সেরে গড়গড়িয়া মহাশয় তার এতদিনের কুর্তা ও ইজের আর পরলেন না। পরলেন পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত যাওয়ার আগের রঙের দুই খ- কাপড়। কাপড় পরা শেষ হতেই ওই ক্ষুধার্ত দেহ নিয়ে পই পই করে হাঁটতে শুরু করলেন গড়গড়িয়া মহাশয়। তার এভাবে দ্রুত হাঁটা দেখে রাস্তার দুই পাশের ছেলে-বউসহ অনেকেই তার পিছু নিলেন। না গড়গড়িয়া মহাশয় এবার কোন মন্দিরে গেলেন না, তিনি সোজা গোয়ালাপাড়ার বড় একটি গোশালায় গিয়ে ঢুকলেন। গোশালার সামনের দিকেই বাঁধা ছিল সাদা ও কালো রং মিশানো বড় একটি গাভী। গড়গড়িয়া মহাশয় একেবারে ভূমিতে প্রণিপাত হয়ে ওই গাভীর সম্মুখ পায়ে পড়লেন। গাভীটি সযতেœ আপন বাছুরের মতো মনে করে গড়গড়িয়া মহাশয়ের মাথার চুল জিহ্বা দিয়ে চেটেপুটে ভিজিয়ে দেয়। গাভীর চাটার কাজটি শেষ হতেই গড়গড়িয়া মহাশয় হু হু করে কেঁদে ওঠেন। আর কান্নার ভেতর বলতে থাকেন, গো-মাতা তাকে আপন সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেছে। চারপাশে যারা কৌতূহলী তারাও গভীর বিশ্বাসে রুদ্ধশ্বাস হয়ে গেলেন। তারা তো নিজ চোখে দেখলেন, গো-মাতা কীভাবে তার বাছুরটিকে আদর করলেন। ঝড়ের বাতাসের বেগে নিজ কনসিটিউন্সিতে এই বার্তা রটে গেল। না, এরপরে আর কী রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন ও ভোটের বাক্স ভর্তি হওয়া ভোটের জন্য গড়গড়িয়া মহাশয়কে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তবে পার্লামেন্টে বসার আগের দিন তিনি স্বপ্ন দেখেন, গো-মাতা তাকে বলছে, বাপুরে তোকে এখন দেশ-বিদেশে যেতে হবে, তুই ওই দুই খ- কাপড় ছেড়ে যখন যেমন কাপড় দরকার হয় তখন তেমন কাপড় পরিস। ভারতীয় ওই বাঙালী সাংবাদিক এরপরেও কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ছয় ফুট লম্বা এক পাকিস্তানী পাঞ্জাবী সাংবাদিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এ জন্যই তো ভারতের এ দুর্দশা, যুদ্ধ হলেই পাকিস্তানের কাছে হেরে যায়... ভারতীয় সাংবাদিক তার তীব্র প্রতিবাদ জানাতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু পাঞ্জাবী তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে জড়িয়ে চুমু খেয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, শোন, আমার এক বন্ধুর বড় ভাই আর্মি থেকে রিটায়ার্ড করার পরে হঠাৎ তার কিছুটা বায়ুরোগ দেখা দিল। যে রোগের প্রভাবে তিনি বলে বসলেন, তিনি রাজনৈতিক দল থেকে নির্বাচন করবেন। বাড়ির সবাই তো শুনে অবাক, এতদিন রাষ্ট্র চালিয়ে এখন আবার বলে কিনা, নির্বাচন করে রাষ্ট্র চালানোর কাজে লাগবে। বাড়ির লোকেরা প্রথম প্রথম এই বায়ুরোগগ্রস্ত লোকটিকে খুব বেশি পাত্তা দিলেন না। কিন্তু জেনারেল সাহেব বাড়িতে থাকেন না। সারাদিন রাস্তা ধরে, গমের ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটেন। এই হাঁটার পথে তার সঙ্গে পরিচয় হয় আরেক রিটায়ার্ড জেনারেলের। তিনিও হাঁটছেন। একদিন দুজন মুখোমুখি হওয়াতে ওই জেনারেল সাহেব বললেন, তিনি নির্বাচন করতে চান কিন্তু ঠিক হালে পানি পাচ্ছেন না। অপর জেনারেল তখন উৎসুক মুখ নিয়ে তাকালেন। তখন ওই জেনারেল উত্তর দিলেন, আরে এতদিন পাঞ্জাবে বাস করেন আর বোঝেন না, ভোট পেতে গেলে কী করতে হয়? আমি তো রিটায়ার্ড, ছোট ভাই কেবল মেজর। লোকে গুনছে না আমাকে। বায়ুরোগগ্রস্ত জেনারেল আর এগুলেন না ওই জেনারেলের সঙ্গে। বরং বেশ দ্রুতই বাড়ি ফিরে এসে সটান ঘুম দিলেন। বাড়ির সকলে মনে করলেন, যাহোক এবার মনে হয় তিনি ঠা-া হয়েছেন। সত্যি সত্যি রাতের খাবারের সময় তিনি আর তার সারাদিনের হাঁটা বা হাঁটার রাজনীতি নিয়ে কোন কথা বললেন না। পরদিন খুব ভোরে উঠে তিনি টেইলরকে ডেকে আনলেন। তার কথামতো টেইলর বাড়ির পাঁচ বছরের বালক থেকে যত পুরুষ আছে সবার মাপ নিলেন। মাপ নেয়া শেষ হলে তিনি টেইলরকে টাকা বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় দিলেন। এরপরে খোদ শিয়ালকোট থেকে মুচি নিয়ে এলেন। চলতে লাগল বাড়ির সকল পুরুষদের পায়ের মাপ নেয়া। সকলে এবার ধরে নিল ওই যে সটান ঘুম আর রাজনীতি নিয়ে কোন আলোচনা না করা এ ছিল ঝড়ের আগের থমথমে অবস্থা আর কি? এদিকে জেনারেল সাহেব এখন আর বাড়ি থেকে বেশি বের না হলেও টেইলর ও মুচির মুখে মুখে রটে গেছে, জেনারেল সাহেবের বাড়ির পাঁচ বছরের বাচ্চা থেকে আশি বছরের বুড়ো পর্যন্ত সবার জন্য বুট তৈরি হচ্ছে ও সামরিক পোশাক তৈরি হচ্ছে। এগুলো তৈরি হয়ে আসতেই জেনারেল সাহেবের কড়া অর্ডার এখন থেকে এ বাড়ির পোশাক এই। সকল পুরুষকে এটা পরেই বাইরে যেতে হবে। না, বেশিদিন লাগেনি হপ্তাখানেক যেতেই গোটা কনস্টিটিউন্সিতে রটে গেল জেনারেল মিঠাই খানের বাড়ির পাঁচ বছরের বাচ্চা থেকে আশি বছরের বুড়ো পর্যন্ত সকলে এখন সামরিক বাহিনীতে চাকরি করে। ওদিকে জেনারেল কুবলাই যতই হেঁটে হেঁটে মানুষকে বোঝাতে চান, এটা হতেই পারে না। সামরিক বাহিনীতে চাকরি করার নির্দিষ্ট বয়স আছে। তখন লোকে তাকে পাগল মনে করে। তারা কি এতই বোকা যে নিজের চোখে যা দেখছে তা বাদ দিয়ে কুবলাইয়ের গুবলেট শুনবে। মিঠাই খানের থেকে ক্ষমতাবান এখন যে ওই এলাকায় আর কেউ নেই সে কথা আর বোঝাতে সময় লাগল না। মানুষ নিজেই বুঝে নিল। রাজনৈতিক দলও দেখল ভোটে জিততে হলে মিঠাই খানের দরকার। তারা নমিনেশন দিল, মানুষও ছাপ্পর দিয়ে বাক্স ভরে... এ সময় পাকিস্তানী সাংবাদিককে থামিয়ে বাংলাদেশের বাঙালী সাংবাদিক বলতে গিয়েছিল, আরে আপনার ওটা তো পুরনো। আমার কথা শুনুন, পাকিস্তান সাংবাদিক জিরাফের মতো উঁচু গলা দিয়ে বাংলাদেশী সাংবাদিকের মাথার ওপর হাসির তুবড়ি ছুটিয়ে বললেন, ছোট ভাই, বড় ভাইকে মানতে শেখ। তোমার গল্প এখনও পাকেনি, সবে তো মাদ্রাসা আর হেফাজত। ওগুলো তো আমাদেরই আন্ডা-বাচ্চা। দেখ নাÑ গল্প কোথায় যায়! আগে ঘটতে দেও। এর মাঝে একেবারে বেসুরো বীণা নিয়ে এলেন ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক ওয়াচ ডগ এ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। তিনি বললেন, গণতন্ত্র নিয়ে এ ধরনের উদাহরণের বিরুদ্ধে তিনি তীব্র নিন্দা জানাচ্ছেন। তাঁর নিন্দা প্রস্তাব সম্পূর্ণ না শুনেই... ততক্ষণে সব সাংবাদিক উঠে পড়ছেন। তাদের ক্ষুধা তাদেরকে ডিনারে ডাকছে। এর ভেতর এক বেরসিক জার্মান সাংবাদিক বললেন, আজ কোন কাজ করলাম না কিন্তু খিদে পেল কেন?
×