ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রুমেল খান

‘বাংলার মোহাম্মদ আলী’ খ্যাত বক্সার হালিমের প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ২৬ এপ্রিল ২০১৭

‘বাংলার মোহাম্মদ আলী’ খ্যাত বক্সার হালিমের প্রত্যাশা

পৃথিবীর জনপ্রিয় খেলাধুলার একটি বক্সিং। এর জন্মলগ্ন প্রাচীন গ্রিসে, খ্রিস্টপূর্ব ৬৮৮ অব্দে অলিম্পিক গেমসে। ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে গ্রেট ব্রিটেনে অনুষ্ঠিত ‘প্রাইজফাইটস’-ই মূলত আধুনিক বক্সিংয়ের অগ্রদূত। খেলাটি মধ্যবর্তী উনিশ শতাব্দীর মধ্যে গ্রেট ব্রিটেন এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো বিশে^ ছড়িয়ে পড়ে। এ খেলাটিতে অসংখ্য গ্রেট বক্সার এসেছেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে সেরা বক্সার ধরা হয় যুক্তরাষ্ট্রের মোহাম্মদ আলীকে (১৯৪২-২০১৬)। জানেন কি, বাংলাদেশেও একবার এসেছিলেন এই ‘গ্রেটেস্ট’? একটি ছবি উঠিয়েছিলেন আবদুল হালিমের সঙ্গে, যাকে বলা হতো ‘বাংলার মোহাম্মদ আলী’। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে যিনি সর্ব প্রথম পদক জিতেছিলেন, তিনি হচ্ছেন এই হালিম। ১৯৭৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় অনুষ্ঠিত ‘এশিয়ান বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপ’-এ অংশ নিয়ে হালিম জিতেছিলেন তাম্রপদক। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন ক্রীড়াবিদকে সংবর্ধনা ও পুরস্কার দেন তাদের অতীত ও বর্তমান সাফল্যের জন্য। কিন্তু বিস্ময়করভাবে এই তালিকায় ছিল না হালিমের নামটি। কেন? জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপনে বর্ষীয়ান হালিম জানান, ‘কদিন আগেই প্রধানমন্ত্রী ৩৩৯ ক্রীড়াবিদকে, যারা বিভিন্ন সময়ে দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য পেয়েছেন, তাদের সংবর্ধনা ও আর্থিক পুরস্কার দিলেন। এদের মধ্যে তিন ক্রীড়াবিদকে ফ্ল্যাটের চাবিও বুঝিয়ে দিলেন। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ফুটবল ম্যাচ খেলে দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে, তেমনি আমি বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রথম পদক এনে দিয়েছি অথচ এর কোন মূল্যায়ন পেলাম না ওই তিন জনের মতো, এটা আমাকে খুবই ব্যথিত করেছে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে।’ হালিম এর আগে দু’বার (একবার সরকারী কর্মকর্তা ও আরেকবার ক্রীড়াবিদ হিসেবে) রাজউকের প্লটের জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু কোনবারই প্লট পাননি। এবার আশা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী হয়ত তাকে বাংলাদেশের প্রথম পদকজয়ী ক্রীড়াবিদ হিসেবে সংবর্ধনার পাশাপাশি শিলা-সীমান্ত-শাকিলের মতো একটি ফ্ল্যাটও দেবেন। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপারÑ তাঁর নাম তালিকাতেই ছিল না! হালিমের আক্ষেপ, ‘যখন টাকা ছিল, তখন আবেদন করেও প্লট পাইনি আর এখন টাকা নেই, তাহলে কিভাবে পাব?’ হালিম আরও যোগ করেন, ‘আমার আমলের দাবাড়ু রানী হামিদ যদি তালিকায় থেকে সংবর্ধনা পেতে পারেন, তাহলে আমি কেন পাব না? যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন চাকরি করেছি, সেই সুবাদে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মভূমি গোপালগঞ্জেও চাকরি করার সৌভাগ্য হয়েছে। যার জন্য আজও আমি গর্বিত। যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়, যিনি একজন সাবেক ক্রীড়াবিদও বটে, সেই সুবাদে আমাকে চেনেন। তিনি ইচ্ছা করলেই আমার নামটা প্রস্তাব করতে পারতেন। আমি এখন রিটায়ার্ড মানুষ। ভাড়া বাড়িতে থাকি। পেনশন যা পাই, তা দিয়ে কোনমতে সংসার চালাই। ছেলেমেয়ের পড়াশোনার প্রচুর খরচ যোগাতে হিমশিম খাই। ওদের পড়াশোনার খরচ যোগাতে বিভিন্ন সার্ভিসেস সংস্থায় বক্সিংয়ের খ-কালীন কোচ হিসেবে কাজ করি (হালিমের অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়ে বহু বক্সারই জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ-রৌপ্য ও তাম্রপদক জিতেছেন)। ছেলে-মেয়ে এখনও পড়ছে, তারা এখনও উপার্জনক্ষম হয়নি। প্রধানমন্ত্রী যদি আমাকে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতেন!!’ হালিমের সন্তানরা তাঁকে অনুযোগ করে, ‘বাবা, তুমি এত বছর বক্সিং করে কি পেলে! আলু-পটলের ব্যবসা করলেও তো এতদিনে ফ্ল্যাটের মালিক হতে পারতে!’ চাকরি জীবনে যেভাবে সততা বজায় রেখে চলেছেন, এখন বাকি জীবনটাতেও সততা বজায় রেখে চলতে চান হালিম। বাংলাদেশের অনেক ক্রীড়াবিদ বর্তমানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্রীড়ায় অনেক পদক পাচ্ছে। ভবিষ্যতেও পাবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রীড়ায় বাংলাদেশের প্রথম পদকজয়ী ক্রীড়াবিদ হিসেবে হালিমের নামটি স্বমহিমায় থেকে যাবে চিরকাল। ১৯৭৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার জার্কাতায় অনুষ্ঠিত ‘এশিয়ান বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপ’-এর অষ্টম আসরে লাইট ফ্লাইওয়েটে ১০৫ পাউন্ড (তখন কেজির চল ছিল না) ওজন শ্রেণীতে সেমিতে ইন্দোনেশিয়ার হেরি মাইতিমুর কাছে মাত্র ১ পয়েন্টে (‘আমাকে ইচ্ছা করেই হারিয়ে দেয়া হয়, নইলে কমপক্ষে রৌপ্য জিততে পারতামÑ হালিমের খেদোক্তি) হেরে তাম্রপদক লাভ করেন হালিম (যুগ্মভাবে তাম্রপদক পান ইরাকের ফরিদ মাহদী সালমান-ও)। আন্তর্জাতিক যে কোন ক্রীড়ায় ওটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম কোন পদক জয়ের ঘটনা। আন্তর্জাতিক কোন খেলায় সফল হওয়ায় বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখে সেদিন তার যা অনুভূতি হয়েছিল, তা কোনদিনও ভুলবেন না। ওই সময় গ্যালারিতে উপস্থিত বাংলাদেশী অসংখ্য দর্শক এবং বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত আবেগে কেঁদে ফেলার দৃশ্য আজও মনে আছে তাঁর। হালিমের স্মৃতিচারণ, ‘মজার ব্যাপারÑ আমাকে পুকুরচুরি নয়, ‘সাগরচুরি’ করে হারানো ওই ইন্দোনেশিয়ার বক্সার কিন্তু ফাইনালে জিততে পারেনি! তাকে হারিয়ে স্বর্ণপদক জেতে জাপানের কোইচি কোবা।’ পরে দেশে ফিরে হালিম শোনেন, তাঁর বাবা পদক জয়ের খবর শুনে আনন্দে একমণ মিষ্টি কিনে সবাইকে খাইয়েছেন। আর বন্ধু ও এলাকাবাসী আধমণ মিষ্টি কিনে এলাকার সবাইকে খাইয়েছেন! বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সব পুরস্কারই পেয়েছেন হালিম। যেমন : ১৯৭৬ সালে বক্সিং ফেডারেশনের বর্ষসেরা বক্সার পুরস্কার, ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি পুরস্কার, ১৯৭৭ সালে জগন্নাথ কলেজের ‘ব্লু’, ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ‘ব্লু’, ২০০৪ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার এবং ২০১৬ সালে ‘আমাদের প্রথম’ প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার। জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। মোট কথা, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট এবং গর্বিতই হালিম। ১৯৬৮ সালে বক্সিং শুরু করে অবসর নেন ১৯৮০ সালে। এই সময়ে ঘরোয়াভাবে খেলেছেন যথাক্রমে বস্ত্রশিল্প সংস্থা, মেট্রোপলিশ (বর্তমানে মহানগর), বিওএম (বক্সার অব মতিন) এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের হয়ে। মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে সেই ছবি তোলার গল্পটা কেমন? ১৯৭৮ সাল। লিওন স্পিংকসের কাছে বিশ^ চ্যাম্পিয়নশিপের খেতাব হারিয়েছেন কিছুদিন আগেই। পেয়েছেন চোটও। বাংলাদেশে আসবেন কি না সন্দেহ ছিল। তারপরও এলেন কিংবদন্তি সেই মোহাম্মদ আলী। প্রথমে ঠিক ছিল, আলী হালিমের সঙ্গেই লড়বেন। কিন্তু আলীর ম্যানেজার জানান, আলী যেহেতু চোটগ্রস্ত, তাই তিনি ফাইট করবেন না, তবে ফাইট করার ছলে মজা করবেন এবং সেটা কোন বাচ্চা ছেলের সঙ্গে হলে ভাল হয়। এভাবেই ১২ বছর বয়সী গিয়াসউদ্দিন আলীর সঙ্গে লড়াই করার সুযোগ পান। হালিম ফিরে তাকান সেই সময়ে, ‘তবে আলীর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ আমিও পেলাম। লড়াই শেষে আলী তখনও স্টেজে। তখন উপস্থিত সব ক্যামেরাম্যান, সাংবাদিক এবং কর্মকর্তারা আমাকে বললেন স্টেজে গিয়ে আলীর সঙ্গে ছবি ওঠাতে। আলীর অনুমতি চাইতেই আলী আমাকে এক হাত দিয়ে বগলদাবা করে আরেক হাত দিয়ে আমার মুখে ঘুষি মারার ভান করলেন, আমিও ভয় পাওয়ার ভান করলাম। এভাবেই ছবিটি উঠল। এটা আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা। তাছাড়া ওনার অটোগ্রাফও নিয়েছিলাম। সেটা এখনও সযতেœ রেখে দিয়েছি।’ নিজের জন্ম প্রসঙ্গে হালিমের রসিকতা, ‘বাঙালীদের আসলে দু’বার জন্ম হয়। একবার মায়ের পেটে, আরেকবার স্কুলে। আমার জন্ম পুরান ঢাকার নয়াবাজারে। স্কুলের সার্টিফিকেট অনুযায়ী আমার জন্ম তারিখ ১৫ জানুয়ারি, ১৯৫৫। আর প্রকৃত জন্ম তারিখ ২ মার্চ, ১৯৫৩। সার্টিফিকেট অনুযায়ী আমার বয়স এখন ৬৩ চলছে।’ বাবা শেখ ফৈজদ্দিন (পরিবহন ব্যবসায়ী), মা বেগম হাজেরা খাতুন (গৃহিণী)। হালিমরা চার ভাই, এক বোন। হালিমের স্ত্রী বেগম তাহেরা। এক ছেলে, এক মেয়ে আছে। ছেলে আবুল বাশার (তমাল) ফার্মেসিতে মাস্টার্সে পড়ছে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক বিশ^বিদ্যালয়ে। মেয়ে রিফাহ্ তাসনিম (তন্দ্রা) উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞানে পড়ছে ভিকারুননিসা নূনে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্টে ১৯৮০ সালে মাস্টার্স করা হালিম বক্সার হিসেবে অবসর নেয়ার পর ১৯৮৪ সালে বিয়ে করেন। সেজন্য তার স্ত্রী এবং সন্তানরা কেউই হালিমের খেলা দেখেনি! এজন্য আক্ষেপ হয় হালিমের। বক্সিং বেছে নেয়ার কারণ কি? হালিমের বাবা ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় সেনাবাহিনীর এক কর্নেলের কাছে কাজ করতেন। সেই কর্নেল কুস্তি অনুশীলন করতেন আখড়ায়। বাবাও করতেন। ঢাকা ফিরে বাবা হালিমকে একটি আখড়ায় নিয়ে গেলেন। সেটা ১৯৬৭ সাল। সদরঘাটের কায়েদে আযম ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার। স্বাধীনতার পরে পরবর্তীতে নাম পাল্টে হয় নবযুগ। হালিম ফিরে যান সেই সময়ে, ‘বাবা বললেন, তুমি রেসলিং কর। রাজি হলাম না। একইভাবে ভারোত্তোলন খেলার প্রস্তাবেও সম্মত হলাম না। বেছে নিলাম বক্সিং। বাবা একটু অবাক হলেও আমার সিদ্ধান্ত মেনে নেন।’ আসলে বিশ^ব্যাপী তখন বক্সার মোহাম্মদ আলীর ক্রেজ চলছে। হালিম তাঁর অন্ধভক্ত। তখন টিভিতে মাঝে মধ্যে আলীর ফাইট লাইভ দেখেছেন। ১৯৬৮ সালে বক্সার হিসেবে অংশ নেন জুনিয়র ইস্ট পাকিস্তান কম্পিটিশনে। সেখানে অবশ্য ভাল ফল করতে পারেননি। তবে সেখান থেকেই হালিমের বক্সিং ক্যারিয়ারের সূচনা। মোহাম্মদ আলী বক্সিংয়ে আসার আগে খেলাটি ছিল মূলত মারামারির এবং শক্তির। বর্তমানেও তাই। কিন্তু আলী খেলাটিকে নিয়ে যান শিল্পের পর্যায়ে। যোগ করেন টেকনিক-ট্যাকটিক্স-স্টাইলসহ আরও অনেক কিছু। ফলে খেলাটি হয়ে ওঠে আকর্ষণীয়। এজন্যই হালিম আলীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। তাঁর খেলার অনেক কিছুই তিনি শিখেছেন। তাঁর হুক, স্টেপিং, ক্রস... এগুলো কার্বন কপি করেছেন এবং উচ্চতায় (৫ ফুট ২ ইঞ্চি) খাটো হওয়ার পরও অনেক সাফল্য পেয়েছেন। এমনও হয়েছে নিজের চেয়ে লম্বা এবং ওজনে বেশি বহু প্রতিপক্ষকে এই টেকনিকগুলো প্রয়োগ করে ধরাশায়ী করেছেন। সত্তরের দশকে যে সময়টায় বক্সিং করেছেন, তখন টিভি চ্যানেল ছিল মাত্র একটি। দৈনিক পত্রিকাও ছিল হাতেগোনা। অন্য খেলাগুলোতে ফটোগ্রাফারদের উপস্থিতি থাকত নগণ্য। কিন্তু বিস্ময়করভাবে হালিমের খেলাগুলোতে ১৫-২০ ফটোগ্রাফার নিয়মিতই তাদের ক্যামেরা নিয়ে হাজির থাকতেন। তারা হালিমের খেলার দৃশ্যগুলো বিভিন্ন এ্যাঙ্গেলে ক্যামেরাবন্দী করে পত্রিকায় ছাপানোর ব্যবস্থা করতেন এবং প্রচুর ছবি তাঁকে উপহারও দিতেন। তাদের কারণেই তারকাখ্যাতি পান হালিম। তাদের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তাদের যে কজনের নাম মনে পড়ে হালিমের, তারা হলেন : আব্দুর রশীদ তালুকদার, আল মাজি, এনামুল হক বাবলু প্রমুখ। তাছাড়া তখনকার অনেক ক্রীড়া সাংবাদিক যেমন : কামরুজ্জামান, আতাউল হক মল্লিক, তওফিক আজিজ খান, বদি-উজ-জামান, আবদুল হামিদ... এরা হালিমকে অনেক ¯েœহ করতেন, ভালবাসতেন এবং তাঁকে নিয়ে লিখতেন। তাদের ঋণ কোনদিনও শোধ করতে পারবেন না হালিম। হালিমের বিনম্র শ্রদ্ধা, ‘তাঁরাই আমাকে ‘বাংলার মোহাম্মদ আলী’ হিসেবে পত্রিকায় প্রতিষ্ঠা করান। তাদের অনবদ্য লেখা পড়ে আরও ভাল খেলার তাগিদ পেতাম।’ কারা ছিলেন হালিমের কোচ? ‘শুরুর দিকে নবযুগে অনেক সিনিয়ররাই আমাকে খুঁটিনাটি দেখিয়ে দিতেন। আমাকে সত্যিকারের কোচিং যিনি করান, সেই ‘পিতৃতুল্য’ কোচ প্রয়াত এমএ মতিনের কাছে আমি চির ঋণী।’ এখন যদি বক্সিং করতেন, তাহলে কেমন করতেন? হালিমের জবাব, ‘এখন যদি বক্সিং করতাম, তাহলে আরও বেশি জনপ্রিয়, সফল হতাম এবং আরও বেশি মিডিয়া কভারেজ পেতাম।’ অন্য ক্রীড়াবিদরা যা সচরাচর করেন না, সেটাই করেছেন হালিম। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে চাকরি করেছেন (১৯৮৯-২০১৪) জেলা ক্রীড়া অফিসার হিসেবে। শুধু তাই নয়, অন্যরা বদলি এড়াতে সুপারিশ করে যেখানে ঢাকাতেই থাকতে আগ্রহী, সেখানে কখনও সুপারিশ না করে স্বেচ্ছায়-সানন্দে ঢাকার বাইরে বহু বছর চাকরি করেছেন। তার পোস্টিং ছিল গোপালগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, খাগড়াছড়ি, চাঁদপুর, শেরপুর, জামালপুর এবং গাজীপুরে। এছাড়া বক্সিং ফেডারেশনেও যুগ্ম সম্পাদক, নির্বাচক কমিটির সদস্য, বক্সিং রেফারিজ-জাজ এ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক, বাংলাদেশ পাঞ্জা ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক হিসেবেও বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছেন। সরকারী চাকরিতে যোগ দেয়ার আগে কিছুদিন কন্সট্রাকশনের ব্যবসাও করেছেন হালিম। তাদের বংশে কেউ কখনও সরকারী চাকরি করেনি, এ বিষয়টা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বাবা হালিমকে সরকারী চাকরি করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। জাতীয় বক্সিং কোচ হিসেবেও হালিমের কাজ করার অভিজ্ঞতা ব্যাপক। জার্মানিতে থেকে বক্সিং কোচেস কোর্সও করেছেন। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জীবনের একটা স্মরণীয় অধ্যায় আছে হালিমের। তাঁর সৌভাগ্য হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ভাষণটি একেবারে মঞ্চের সামনে বসে শোনার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে না গিয়ে অন্যভাবে যুদ্ধ করেন। সেটা মুক্তিবাহিনীর ‘ইনফর্মার’ হিসেবে। পুরান ঢাকায় তখন প্রচুর অবাঙালী-পাকিস্তানী বাস করত, তারা কুস্তি ও বক্সিং খেলত। যুদ্ধের সময় তারা সবাই ‘রাজাকার’ হয়ে যায়। শুরু থেকেই তাদের সঙ্গে হালিমের সখ্যতা ছিল। তারা হালিমকে সরল বিশ^াসে তাদের পরবর্তী অপারেশনের দিনক্ষণ এবং স্থান বলে দিত। হালিম তখন সেই খবর বুড়িগঙ্গায় নৌকার মাঝিদের (তারাও ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ইনফর্মার) গোপনে জানিয়ে দিতেন। ফলে সেই খবর শুনে মুক্তিযোদ্ধারা সতর্ক হতো। ‘তবে আমার কাজটা ছিল ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। ওরা যদি একবার সন্দেহ করত তাহলে আমি নিশ্চিত মারা পড়তাম। তবে দেশের স্বাধীনতার জন্য তখন এই ঝুঁকিকে ঝুঁকি বলে মনে করিনি। তবে নিজে কখনও কোনদিনও মুক্তিযুদ্ধে আমার এই ভূমিকার কথা মিডিয়াকে জানাইনি, আজ শুধু জনকণ্ঠের মাধ্যমেই জানালাম।’ হালিমের আবেগী কথন। এখন দেখার বিষয়, প্রধানমন্ত্রী হালিমের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁকে সংবর্ধনার পাশাপাশি একটি ফ্ল্যাটও উপহার দেন কি না।
×