ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

হিমালয়ার কাছে শেয়ার বিক্রি করে বাংলাদেশ ছাড়ছে শেভরন

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৫ এপ্রিল ২০১৭

হিমালয়ার কাছে শেয়ার বিক্রি করে বাংলাদেশ ছাড়ছে শেভরন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পেট্রোবাংলার অনুমতি না নিয়েই মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন তিন গ্যাস ক্ষেত্রের সকল শেয়ার বিক্রির চুক্তি করেছে চীনা কোম্পানি হিমালয়া এনার্জি কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে। হিমালয়া চীনের জিং হুয়া কোম্পানির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। অথচ এই গ্যাস ক্ষেত্রের সম্পদ যাচাই করছে পেট্রোবাংলা। বাংলাদেশ গ্যাস ক্ষেত্রগুলোতে শেভরনের অংশ ক্রয়ের আগ্রহও দেখিয়েছে। কিন্তু হিমালয়ার সঙ্গে চুক্তি করার আগে পেট্রোবাংলার অনুমতি তো দূরের কথা জানানোর প্রয়োজনই মনে করেনি বহুজাতিক কোম্পানিটি। উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি অনুযায়ি শেভরন গ্যাস ক্ষেত্রের শেয়ার বিক্রি করতে পারলেও পেট্রোবাংলার পূর্বানুমোদন প্রয়োজন হয়। অনুমোদন দেয়ার আগে গ্যাস ক্ষেত্রগুলো কিনতে আসা কোম্পানিটির আর্থিক এবং কারিগরি যোগ্যতা যাচাই করে পেট্রোবাংলা। কিন্তু শেভরন সম্প্রতি চীনা প্রতিনিধি দলকে নিয়ে এসে গ্যাস ক্ষেত্রগুলো দেখায়। সে ক্ষেত্রেও পেট্রোবাংলার অনুমোদন নেয়া প্রয়োজন থাকলেও তোয়াক্কাই করেনি মার্কিন এই কোম্পানিটি। পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, আমরা এ বিষয়ে শেভরনের বক্তব্য জানার জন্য কড়া ভাষায় চিঠিও দেয়া হয়েছে। তবে এর মধ্যেই শেভরন খনিগুলোর শেয়ার বিক্রি করার জন্য চুক্তি করেছে। শেভরন থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো একটি বার্তায় বলা হয়েছে শেভরন বাংলাদেশের ব্লক-১২ তে থাকা বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র এবং ব্লক ১৩ এবং ১৪ তে থাকা জালালাবাদ এবং মৌলভীবাজার গ্যাস ক্ষেত্রের শেয়ার বিক্রি করছে। দেশের সব থেকে বেশি গ্যাস সরবরাহ আসে বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে। বিবিয়ানা থেকে গত রবিবার ১ হাজার ১২৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়া মৌলভীবাজার থেকে একই দিন ৩২ মিলিয়ন এবং জালালাবাদ থেকে ২৬৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। জানতে চাইলে বিদ্যুত জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু জনকণ্ঠকে জানান, বিষয়টি জানি। আমরা পেট্রোবাংলাকেও বলেছি। এ ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলার অনুমোদন নেয়া প্রয়োজন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটি তো চুক্তিতেই বলা আছে। পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে গ্যাস সঙ্কটের কথা বলে বিদ্যমান খনি থেকে গ্যাস উত্তোলন বৃদ্ধির চেষ্টা করা হয়। এর মধ্যে শেভরন বিবিয়ানাতে সাড়ে চার ট্রিলিয়ন ঘনফুটের (টিসিএফ) ওপরে মজুদ থাকার দাবি করে। পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানি মন্ত্রণালয় শেভরনের দাবি মানতে না চাইলে পিএসসির শর্তানুযায়ী তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে মজুদ নির্ধারণ করা হয়। সেখানেও একটি মার্কিন কোম্পানিকে দিয়ে মজুদ নির্ধারণ করে শেভরন তাদের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করে। এরপর শেভরন বিবিয়ানাতে ৫০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে নতুন কূপ খননের পাশাপাশি প্রসেস প্ল্যান্ট এবং অন্য অবকাঠামো নির্মাণ করে। পরবর্তীতে শেভরন গ্যাস ক্ষেত্রটিতে কম্প্রেসার স্থাপন করতে চাইলে পেট্রোবাংলা পুনঃবিনিয়োগের অনুমতি দেয়নি। বেশি মজুদ দেখিয়ে অতিরিক্ত গ্যাস তোলার ফলে দেশের একমাত্র সাগর বক্ষের গ্যাস ক্ষেত্র সাঙ্গু পরিত্যক্ত হয়েছে। অনেক দিন ধরেই শেভরনের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিবিয়ানার ক্ষেত্রের পরিণতিও একই দিকে এগুচ্ছে বলে সতর্ক করা হচ্ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, সক্ষমতার অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলন করা হলে ভূ-অভ্যন্তরের গ্যাস কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে করে গ্যাস ক্ষেত্রের আয়ুষ্কাল কমে যায়। পেট্রোবাংলার তথ্য মতে, জালালাবাদের দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ২৬০ মিলিয়ন ঘনফুট। গত বছর পর্যন্ত গড়ে তোলা হয় ২৭০ মিলিয়ন ঘনফুটের ওপরে। বিবিয়ানা ক্ষেত্রের দৈনিক উত্তোলন সক্ষমতা ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। বিপরীতে শেভরন গত বছর পর্যন্ত উত্তোলন করছে ১ হাজার ২৩০ থেকে ১ হাজার ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। এখন বিবিয়ানায় গ্যাসের গড় চাপ এক হাজার ৫০ পিএসআই (পাউন্ড প্রতি বর্গ ইঞ্চি) থেকে এক হাজার ৪০০ পিএসআইয়ের মধ্যে। কিন্তু চালু হওয়ার সময় এই গ্যাস ক্ষেত্রের গড় চাপ ছিল তিন হাজার পিএসআই। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, অতিরিক্ত মজুদ দেখিয়ে বেশি মাত্রায় গ্যাস উত্তোলনের ফলে গ্যাস ক্ষেত্রটির অভ্যন্তরীণ কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ জন্যই চাপ কমছে। এতে বিবিয়ানাও সাঙ্গুর পথে হাঁটছে বলে অনেক দিন ধরেই আলোচিত হচ্ছিল। এর আগে ২০০০ সালে বিবিয়ানার মজুদ বলা হয়েছিল ২ দশমিক ৪ টিসিএফের বেশি। ২০০৮ সালের পর শেভরন মজুদ পুনঃমূল্যায়ন করে বিবিয়ানায় ৪ দশমিক ৫৩ টিসিএফ গ্যাস রয়েছে বলে দাবি করে। শেভরনের শেয়ার বিক্রি সম্পর্কে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মোঃ ফয়জুল্লাহ এনডিসি-জনকণ্ঠকে বলেন, শেভরন তাদের শেয়ার বিক্রি সম্পর্কে আমাদের কিছুই জানায়নি। আমাদের অনুমতি না নিয়ে তারা চুক্তি করতেই পারে না। তিনি বলেন, পেট্রোবাংলা তাদের শেয়ার ক্রয়ের জন্য আগ্রহ দেখিয়েছি এবং সম্পদ পর্যালোচনার জন্য একটি কোম্পানিকে দায়িত্বও দিয়েছি। সেখানে শেভরনের এ ধরনের কাজ করা মোটেই যৌক্তিক নয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সম্প্রতি তারা চীনা প্রতিনিধি দলকে এনে গ্যাস ক্ষেত্রগুলো দেখেয়িছে। এই কাজেও আমাদের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু শেভরন তা করেনি। এ বিষয়ে তাদের কাছে জবাব চেয়ে আমরা কড়া ভাষায় চিঠিও দিয়েছি। গ্যাস ক্ষেত্রের শেয়ার বিক্রির আগেই যে কোম্পানির কাছে শেয়ার বিক্রি করা হচ্ছে ওই কোম্পানিটির সক্ষমতা যাচাই করে পেট্রোবাংলা। ওই কোম্পানিটি বাংলাদেশে এসে কাজ করলে পেট্রোবাংলা এবং সরকারের কোন সমস্যা রয়েছে কি না, তাও যাচাই-বাছাই করা হয়। কিন্তু শেভরন এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কোন সুযোগই দেয়নি। পেট্রোবাংলাকে পাশ কাটিয়ে উচ্চ মহলের কারও কারও সঙ্গে আলোচনা করে তাদের বিষয়টি চূড়ান্ত করেছে বলে জানা গেছে। জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হোসেন মনসুর জনকণ্ঠকে বলেন, প্রথমে শেভরন মজুদ নির্ধারণের সময় অতিরিক্ত দেখিয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত সেই মজুদের বিষয়ে মন্ত্রণালয় একমত ছিল না। পরবর্তীতে পিএসসির শর্তানুযায়ী তৃতীয়পক্ষকে দিয়ে মজুদ নির্ধারণ করা হয়। ওই পরিমাণও পেট্রোবাংলার কাছে অতিরিক্ত বলে মনে হয়েছে। কাজেই তারা যে পরিমাণ মজুদের দাবি করেছে তা তুলতে পারবে না। সঙ্গত কারণেই আগাম খনি বিক্রি করে বাংলাদেশ ছাড়ছে। তিনি বলেন, অবশ্যই পেট্রোবাংলার কাছ থেকে শেয়ার বিক্রির আগে অনুমোদন নিতে হবে। আদৌ সেই কোম্পানি গ্যাস ক্ষেত্র পরিচালনা করতে পারে কি না, তা পেট্রোবাংলা দেখবে। না হলে গ্যাস ক্ষেত্রের শেয়ার হস্তান্তর বৈধ হবে না। কোম্পানিটি নামও পরিবর্তন করতে পারবে না। শেভরন বাংলাদেশের একজন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, শেভরন থেকে রবিবার বিকেল ৩টার দিকে জানানো হয়েছে বাংলাদেশে তাদের অংশ বিক্রির জন্য চুক্তি করা হয়েছে। তবে যত দিন পূর্ণাঙ্গ হস্তান্তর হচ্ছে না তত দিন ক্ষেত্রটি থেকে গ্যাস তুলবে শেভরন।
×