ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পশ্চিমা-পূবালী লঘুচাপের সংঘাতে দেশজুড়ে ভারি বর্ষণ

এপ্রিল শেষের বৃষ্টি ৪০ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গেছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৫ এপ্রিল ২০১৭

এপ্রিল শেষের বৃষ্টি ৪০ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গেছে

শাহীন রহমান ॥ এবারের এপ্রিল মাসের শেষ সময়ের এই বৃষ্টিপাত প্রায় ৪০ বছরের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, এর আগে ১৯৮১ সালে এপ্রিলের এই সময়ে এর চেয়ে বেশি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছিল। সে সময় এপ্রিলে স্বাভাবিকের চেয়ে ১৬৮ পার্সেন্ট বৃষ্টিপাত বেশি হয়েছিল। আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ রুহুল কুদ্দুস জানান, ’৮১ সালের পরে এবার ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত স্বাভাবিকের চেয়ে ১১৯ পার্সেন্ট বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তিনি জানান ’৮১ সালের পরে এপ্রিল মাসে এত পরিমাণ বৃষ্টিপাত আর রেকর্ড করা হয়নি। আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা জানান, এবারে এপ্রিলে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ধরা হয়েছে ১৩০.২ মিলিমিটার। অথচ ইতোমধ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে এবারের বৃষ্টির পরিমাণ রেকর্ড করা হয়েছে, যা অতীতের চার দশকের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। গত ৫ দিন ধরে সারাদেশে ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে অবিরাম বর্ষণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত আষাঢ় মাসে যখন মৌসুমি বায়ুর আধিক্য থাকে তখনই মূলত মুষলধারে বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এর বাইরে বৈশাখের এই সময়ে এত বৃষ্টিপাত হয় না। বিশেষ করে আবহাওয়া অফিসের হিসাব অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে জুলাই মাসে। ওই মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৫২৩ মিলিমিটার। এর বাইরে জুন মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪৫৯ মিলিমিটার ও আগস্টে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে ৪২০.৪ মিলিমিটার। এছাড়াও তাদের হিসাব মতে, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও মে মাসেও বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। তবে কয়েক দিন ধরে অব্যাহত ভারি বর্ষণের কারণে একদিকে যেমন ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। অন্যদিকে মানুষের ভোগান্তিও কম নয়। ইতোমধ্যে এই সময়ে প্রধান ফসল বোরো ধানের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেয়া দিয়েছে। এছাড়া কাঁচা ঘরবাড়ি রাস্তাঘাটের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া সারাদেশে ভারি বর্ষষের পাশাপাশি কালবৈশাখী ও বজ্রপাতের ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। পাবনায় কালবৈশাখীতে ১ জন নিহত ও ২ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এদিকে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আজ মঙ্গলবারও ভারি বৃষ্টিপাতে অব্যাহত থাকবে। এরপরেই বুধবার থেকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে আসবে। তারা জানায়, উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় বায়ু চাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় এবং সমুদ্র বন্দরসমূহের ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এ কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা, ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরের অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারসমূহকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থাকতে বলা হয়েছ। তাদের দেয়া ভারি বর্ষণের সতর্কবাণীতে বলা হয়েছে বজ্রঝড়ের ঘন ঘটা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ময়মনসিংহ, সিলেট, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারি থেকে অতিভারি বর্ষণ হতে পারে। অতি ভারি বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের পাহাড়ী এলাকার কোথাও কোথাও ভূমি ধসের আশঙ্কাও রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে ঝড়ো হাওয়ার কারণে সারা দেশে ৬৫ ফুটের কম দৈর্ঘ্যরে নৌযান চলাচল বন্ধ রেখেছে বিআইডব্লিউটিএ। দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী এ সংস্থার জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবারক হোসেন মজুমদার বলেন, আবহাওয়া খারাপ থাকায় নদী বন্দরগুলোতে দুই নম্বর সতর্কতা সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে ঝড়ো হাওয়ার কারণে সোমবার সকাল দশটা থেকে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেয় বিআইডব্লিউটিএ। আবহাওয়ার কিছুটা উন্নতি হলে ৬৫ ফুটের বেশি দৈর্ঘ্যরে নৌযান চলাচলের অনুমতি দেয়া হয় বলে জানান তিনি। বলেন, ২ নম্বর সঙ্কেত বহাল আছে, তবে ঝড়ো বাতাস নেই বলে বড় নৌযানগুলো চলাচল করতে পারবে। ঢাকা সদরঘাটে বিআইডব্লিউটিএর পরিবহন পরিদর্শক (টিআই) মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির জানান, সোমবার সকালে সব নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেয়ার আগে সদরঘাট থেকে পাঁচটি লঞ্চ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, এবারে শুধু এপ্রিলেই বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে তা নয়। গত মার্চ মাসেও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তারা জানায়, এবারে মার্চ মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ধরা হয়েছে ৫২.৪ মিলিমিটার। অথচ রেকর্ডকৃত বৃষ্টিপাতের পরিমাণে দেখা গেছে স্বাভাবিকের চেয়ে ১৫২ পার্সেন্ট বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, মূলত আবহাওয় জলবায়ুর পরিবর্তের কারণে বৃষ্টিপাতের পরিমাণের এই তারতম্য ঘটছে। তিনি জানান কোন বছর এপ্রিল মাসেই বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। গত বছর এই সময়েও বৃষ্টিপাতের দেখা মেলেনি। অথচ এবারে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক বৃষ্টিপাত মূলত জলবায়ু পরিবর্তের কারণেই হচ্ছে। আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা জানান, একদিকে পশ্চিমা, অন্যদিকে পূবালী লঘুচাপের সংঘাতে কয়েক দিন ধরে সারা দেশে আবহাওয়ার বিচিত্র আচরণের কারণেই সারাদেশের ওপর দিয়ে ভারি বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান জানান, মঙ্গলবারও সারাদেশে ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকবে। এরপর বুধবার থেকে সারাদেশে বৃষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হবে। এ সময় পূবালী ও পশ্চিমা লঘুচাপের সংমিশ্রণ কেটে যাবে। ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কমে আসবে। এদিকে অন্যদিনের মতো রাজধানী ঢাকাতে সকাল থেকে আকাশ মেঘে ঢাকা রয়েছে। ক্ষণিক সময়ের জন্য একটু রোদের দেখা মিললেও কিছুক্ষণ পরে আবার তা মেঘে ঢেকে যায়। সকাল সাড়ে ১০টা দিকে মুষলধারে শুরু হয় বৃষ্টিপাত। তা থেকে থেমে প্রায় সারাদিনই চলে। সকাল থেকে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে অফিসগামী লোকজন চরম বিপদে পড়ে যায়। বৃষ্টির মধ্যে কাক ভেজা হয়েই অফিসে যেতে দেখা যায়। এদিকে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সোমবার দুপুর পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাতে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ২২ মিলিমিটার। পাশাপাশি এ সময় দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে পটুয়াখালী ও কুতুবদিয়ায়, ৬২ মিলিমিটার। আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান বলেন, পূবালী ও পশ্চিমা লঘুচাপের মিশেলে মৌসুমের আগেই একটু বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। এটা ব্যতিক্রম হলেও অস্বাভাবিক বলা যাবে না। অনেক বছর পর পর এমন আবহাওয়ার দেখা মেলে। চট্টগ্রাম অফিস জানান, আগাম বর্ষায় প্লাবিত হয়েছে চট্টগ্রাম নগরীর নিচু এলাকা এবং জেলার গ্রামাঞ্চল। নগরীর সড়কগুলো পানির নিচে চলে যাওয়ায় বেড়েছে জনদুর্ভোগ। অপরদিকে, প্লাবনে নষ্ট হয়েছে গ্রামের সবজি ক্ষেত। এতে মাথায় হাত পড়েছে চাষীদের। সোমবার সকাল থেকে আকাশ পরিষ্কার দেখা গেলেও দুপুরের পর ফের অঝোর ধারায় বর্ষণ। এতে করে বন্দর নগরীর অনেক এলাকা পানিতে ডুবে যায়। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আরও অন্তত দুদিন বৃষ্টিপাত হতে পারে। দেশের সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। সোমবার দুপুরের পর থেকে বৃষ্টি শুরু হয়। বিকেল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ১৯ দশমিক ২ মিলিমিটার। অল্প সময়ের মধ্যে বেশি বৃষ্টি হওয়ায় এদিনও চট্টগ্রাম নগরীতে জলজটের সৃষ্টি হয়। নগরীর বাদুরতলা, কাপাসগোলা, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, ছোটপুল, শুলকবহর, হালিশহরসহ নিচু এলাকাগুলোর রাস্তা পানিতে ডুবে যায়। এতে করে ভোগান্তির সৃষ্টি হয়। তবে বৃষ্টি থামার পর অল্প সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়। বরিশাল গত পাঁচদিনের টানা প্রবল বর্ষণে জেলার বিভিন্ন উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে হাজার হাজার একর জমির পাকা ও আধা পাকা বোরো জমির ধান, তিল, মুগডাল, মরিচ, ফুট, তরমুজসহ বিভিন্ন ফসল। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে কোনভাবেই ক্ষেতের ফসল ঘরে তোলা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন কৃষকেরা। টানা বর্ষণে শুধু বোরো জমির ধানই নয়; ক্ষতি হয়েছে তিল, মুগডাল, মরিচ, ফুট, তরমুজসহ বিভিন্ন শস্যের। পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এসব ফসল এখন পুরোপুরি নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তবে টানা বৃষ্টিতে এসব ফসলের কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা জানাতে পারেননি জেলা কৃষি বিভাগ। ভোলা টানা কয়েক দিনের বৃষ্টিতে ভোলায় ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে কৃষকের আবাদ করা রবি শস্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে করে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ফসল বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছে কৃষি বিভাগ। এদিকে ফসল নষ্ট হওয়ায় আর্থিকভাবে লোকসানের মুখে পড়ায় কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এনজিও এবং ব্যাংকের ঋণের টাকা কিভাবে শোধ করবে তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে কৃষকরা। সিরাজগঞ্জ সোমবার সকালে কালবৈশাখী ঝড়ে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গাছপালা, ঘরবাড়ি ল-ভ- হয়েছে পড়েছে। এছাড়াও প্রবল বর্ষণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় কৃষকের পাকা-আধাপাকা ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কয়েক হাজার জমি আধাপাকা ও কাঁচা ধান পানির নিচে ডুবে গেছে। অধিকাংশ কৃষক আধাপাকা ধান কাটতে বাধ্য হচ্ছেন। এদিকে গত পাঁচদিনের প্রবল বর্ষণে তাড়াশ উপজেলার বিনসাড়া, কোহিত, কাজিপুরসহ বিভিন্ন মাঠে ব্যাপক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বাগেরহাট ধানের বাম্পার ফলন হলেও অসময়ে গত ৪-৫ দিনে লাগাতার ঝড়বৃষ্টিতে বাগেরহাটের কৃষকেরা মহাবিপাকে পড়েছেন। ধান কাটার বা ঘরে তোলার মৌসুমে অতি ঝড়বৃষ্টিতে ফসলহানির শঙ্কা তৈরি হয়েছে। গত কয়েক দিনের ভারি বর্ষণে নিচু জমির ধানের মাঠ তলিয়ে যাওয়ায় চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষতির আশঙ্কায় অনেক কৃষক আধাপাকা ধান বাধ্য হয়ে কেটে ফেলছেন। তরমুজ-বাঙ্গি, সবজি ক্ষেতেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কক্সবাজার কক্সবাজারের আট উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে সোমবার পর্যন্ত প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বৃষ্টিতে ঝড়ে পড়েছে অনেক বিলের পাকা ধান। রবিবার ও সোমবার সকালে রোদের দেখা মেলে। তবে বিকেলে ও রাতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে।
×