ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি

শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা, প্রদীপ প্রজ্বালন ও সমাবেশ

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৫ এপ্রিল ২০১৭

শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা, প্রদীপ প্রজ্বালন ও সমাবেশ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ নিহতদের স্মরণে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা, মানববন্ধন, প্রদীপ প্রজ্বালন ও সমাবেশের মধ্য দিয়ে স্মরণ করা হয়েছে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির হতাহতদের। সোমবার সকাল থেকেই বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও ক্ষতিগ্রস্তদের পরিজনরা ভিড় জমায় বিশ্বের ইতিহাসের ভয়াবহতম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে পরিচিত রানা প্লাজার সামনে। তারা সেখানে নির্মিত বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। একই সঙ্গে নিখোঁজ শ্রমিকদের সন্ধান, ক্ষতিপূরণ ও দায়ীদের বিচারের দাবি তোলেন। দুর্ঘটনার চার বছর পরও নিখোঁজ শ্রমিকদের ছবি হাতে নিয়ে বৃষ্টি উপেক্ষা করে অভিশপ্ত রানা প্লাজার সামনে ভিড় করছেন স্বজনরা। এদিন জুরাইন কবরস্থানে রানা প্লাজা ধসে নিহত শ্রমিকদের কবরে শ্রদ্ধা জানান আহত, নিখোঁজ ও নিহত শ্রমিকদের স্বজন, পোশাক মালিক ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা । দোষীদের বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা ভবন মালিক রানার ফাঁসির দাবি করেন। ভবন ধসের চতুর্থ বার্ষিকী উপলক্ষে সোমবার সকাল থেকে প্রচ- বৃষ্টি উপেক্ষা করে স্থানীয় পোশাক কারখানার শ্রমিক, শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মী, নিহতদের স্বজন ও সাধারণ মানুষ ভিড় করেন সাভারে অবস্থিত রানা প্লাজার শহীদ বেদিতে। এরপর শ্রদ্ধা নিবেদন করে নিহত শ্রমিকদের প্রতি সম্মান জানান তারা। এ সময় উপস্থিত শ্রমিকরা অবিলম্বে ভবন মালিক রানাসহ দোষীদের ফাঁসি ও সরকারকে ভবন ধসে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানান। শ্রদ্ধা নিবেদনের পরপরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেন। শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসা শ্রমিকরা অভিযোগ করে বলেন, সোমবার রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় সাভার ও আশুলিয়ায় পোশাক কারখানাগুলো বন্ধের দাবি জানালেও কারখানাগুলো খোলা রয়েছে। পরে দিনটিকে সরকারীভাবে ছুটি ঘোষণা করারও দাবি জানান শ্রমিকরা। শ্রমিকদের স্বজনরা বলেন, ভবন ধসের চার বছর পার হয়ে গেছে। এখনও অনেক নিহত শ্রমিকের স্বজন ও আহত শ্রমিকরা ক্ষতিপূরণ পাননি। ফলে অর্থাভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিতে না পারায় অনেক আহত শ্রমিক স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। এদিকে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের স্মরণে রাজধানীর জুরাইন কবরস্থানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ও কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবার প্রতি আহ্বান জানান নেতারা। নেতৃবৃন্দ তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ও সচেতনতা জোরদারে বারবার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। টাম্পাকো ফয়েল ফ্যাক্টরির অগ্নিকা-, বিভিন্ন কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণ এবং অন্যান্য দুর্ঘটনায় শ্রমিক নিহত হচ্ছেন। তারা কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পরিদর্শন ব্যবস্থা জোরদার এবং শ্রম আইনের যথাযথ প্রয়োগের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এদিকে দিনটিকে স্মরণ করতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ আর মানববন্ধন করে বেশ কয়েকটি সংগঠন। নিহত শ্রমিকদের স্মরণ করল ৫০ এতিম শিশু প্রদীপ প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে রানা প্লাজায় নিহত শ্রমিকদের স্মরণ করেছে ৫০ এতিম শিশু। সোমবার সকালে এ কর্মসূচীতে অংশ নেয় ওই সব শিশুসহ শ্রমিকরা। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত ‘গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিরাপত্তায় জিরো টলারেন্স’ শীর্ষক ওই সমাবেশে গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিরাপত্তায় জিরো টলারেন্স নীতি মানার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংঠনের নেতারা। এ সময় শ্রমিক নেতারা বলেন, আমরা বাংলাদেশে রানা প্লাজার মতো কোন দুর্ঘটনা আর ঘটতে দেব না। এজন্য গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিরাপত্তায় আমরা জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করব। নিরাপত্তার প্রশ্নে কোন ছাড় দেয়া হবে না, কোন আপোস ও সমঝোতা চলবে না। উপস্থিত শ্রমিক নেতা আমিরুল হক আমিন দাবি করে বলেন, রানা প্লাজায় ওই দিন কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি, সাধারণ শ্রমিকদের হত্যা করা হয়েছে। সরকারের কাছে বিচার দাবি করে তিনি বলেন, মামলাটি এখনও বিচারাধীন, এ দুর্ঘটনায় যারা দায়ী তাদের সবাইকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হোক। দুর্ঘটনায় আহত শাহানারা বেগম সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, আমরা সবাই একসঙ্গে বয়েলিংয়ের কাজ করছিলাম। এমন সময় আমাদের ইনচার্জ এসে বের হয়ে যেতে বললেন। ওই সময় তিনিসহ আরও চারজন বাইরে বেরিয়ে আসায় বেঁচে যেতে পেরেছিলেন বলে জানান শাহানারা। তিনি বলেন, আমরা পাঁচজন বাদে অধিকাংশই ওই দিন মারা যান। ওই দিন নিহত সহকর্মীদের স্মরণে অশ্রুসজল হয়ে পড়েন শাহানারা। ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি শ্রমিকরা জুরাইন কবরস্থানে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন বলেন, শ্রমিকরা যে টাকা পেয়েছিলেন, তা মোটেও ক্ষতিপূরণের টাকা নয়। এটা আদালতে এখনও আটকে আছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই চার বছরে আদালত কেন বসছে না? একটি কমিটি করা হয়েছিল ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত আদালত থেকে পাওয়া যায়নি। সিদ্ধান্ত এলেই ক্ষতিপূরণ পেতেন শ্রমিকরা। এ সময় রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের দাবি জানান তিনি। সোমবার সকালে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেই বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা নিহত শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যান। এ সময় দোষী ব্যক্তিদের অবিলম্বে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে তারা বিভিন্ন সেøাগান দেন। এছাড়া ২৪ এপ্রিল গার্মেন্টস শ্রমিক শোক দিবস ঘোষণা করার দাবি জানান তারা। রানা প্লাজার কোন শ্রমিক বেকার নেই, দাবি বিজিএমইএ’র বেসরকারী সংস্থা এ্যাকশন এইডের গবেষণায় উঠে এসেছে, চার বছর আগে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় যেসব শ্রমিক আহত হয়েছিলেন, তাদের ৪২ শতাংশ এখনও বেকার। এ সম্পর্কে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করে বলেন, গত দেড় বছরে একটি লোকও বিজিএমইএতে এসে বলেননি যে চাকরি পাননি বা আহত। আমাদের কাছে আনা হলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। এ ধরনের প্রতিবেদন আমাদের দেশের জন্য ক্ষতিকর। আমি মনে করি, ১৮ তারিখে কমপ্যাক্টের মিটিং আছে, জুনে আইএলসির মিটিং আছে। দেশে যদি আমরা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়াই, তাহলে ক্ষতিটা হবে আমাদের। সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর জুরাইন কবরস্থানে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। রান প্লাজা দুর্ঘটনায় কারখানার মালিকদের কোন অপরাধ নেই বলে মন্তব্য করেন বিজিএমইএ সভাপতি। তিনি বলেন, এর জন্য দায়ী ভবনের মালিক সোহেল রানা। যারা ভবনের বাড়তি অংশ করতে অনুমোদন দিয়েছে বা করেছে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। সিদ্দিকুর রহমান বলেন, সরকার ও শ্রম মন্ত্রণালয় মিলে যে ট্রাস্ট ফান্ড আছে, তাতে এখনও টাকা আছে। যদি কেউ কাজ না পেয়ে থাকেন, কেউ চিকিৎসা না পেয়ে থাকেন, বিজিএমইএ’র কাছে এলে সরকার ও বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে সহায়তা দেয়া হবে। তিনি বলেন, রানা প্লাজায় যে বিল্ডিং ছিল তা শতভাগ কমপ্লায়েন্স ছিল। তা দেখেই ফ্যাক্টরি মালিকরা ভাড়া নিয়েছিলেন। ভবনের নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের দেখার বিষয় কিন্তু ওই ভবনের স্ট্রাকচার আমাদের দেখার কথা নয়। বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ভবনটি হওয়ার কথা ছিল ছয়তলা। অথচ দশতলা করা হয়েছিল। এই দশতলা যাদের চোখের সামনে করেছে তারা এর জন্য দায়ী। কিন্তু কারখানা মালিকদের তো কোন অপরাধ নেই। যারা ভবনের বাড়তি অংশ করেছে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। যে ভবনটি করেছে এবং যারা ভবন তৈরিতে অনুমোদন দিয়েছে, এটা তাদের দায়। নিহতদের প্রতি ফায়ার সার্ভিসের শ্রদ্ধা সাভারের রানা প্লাজা ধসের চতুর্থ বার্ষিকীতে সেখানে নিহতদের স্মরণে নির্মিত অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। সোমবার সকালে বাহিনীটির উপ-সহকারী পরিচালক মামুন মাহমুদের নেতৃত্বে এ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এ সময় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং রানা প্লাজা ধসে উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেয়া প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবকরা উপস্থিত ছিলেন।
×