ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অরুণ কুমার বিশ্বাস

রম্যকথন ॥ মধ্যবিত্ত-শুদ্ধ চিত্ত বাঙালী

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২৫ এপ্রিল ২০১৭

রম্যকথন ॥ মধ্যবিত্ত-শুদ্ধ চিত্ত বাঙালী

বিশেষ অন্ত্যমিলযুক্ত শব্দত্রয় ‘মধ্যবিত্ত শুদ্ধ চিত্ত’ কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্র বেশ খানিকটা সিম্ফোনি সৃষ্টি করে, মানে শুনতে ভাল শোনায়। কিন্তু আমরা যা দেখি তা যেমন সব সময় সঠিক নয়, তেমনি মধ্যবিত্ত মাত্রই শুদ্ধ চিত্তের অধিকারী এমন কথা বোধ করি পাগলেও আস্থায় নেবে না। অর্থাৎ মধ্যবিত্তের কথায় ও কাজে মেলা ফারাক বিদ্যমান। অথচ এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠীর সিংহাংশ মধ্যবিত্ততার শিকার। শিকার বললাম এই জন্য যে, মধ্যবিত্তের দলে নাম লিখিয়ে আমরা কেউ খুব একটা সুস্থির কিংবা স্বস্তিবোধ করি না। মধ্যবিত্ত মানেই যার শান্তি বা স্বস্তি বলে কিছু নেই, শুধু ‘নাই আর আনো’ আছে। অনেকটা সেই লাস্যময়ী প্রেমিকার মতো, যে কি না বিয়ের পরপরই মেলা ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান করে বেচারা প্রেমিক-স্বামীর কানের পোকা নাড়িয়ে দিচ্ছে। সোজা কথায় মধ্যবিত্তের বিষয়জ্ঞান টনটনে, জীবনে রোম্যান্স আছে, আছে কাউকে ল্যাং মেরে উপরে উঠে যাবার প্রয়াসও। এই প্রয়াসে সাফল্য খুব একটা আসে না, শুধু চেষ্টাটাই সার। মধ্যবিত্তের ঘরে বিত্তের টানাটানি, এই নিয়ে তার বিস্তর চিত্তচাঞ্চল্য থাকলেও মুখে তা স্বীকার করবে না। লোকসমক্ষে চেহারায় বেশ খানিকটা সুখী সুখী ভাব এনে বলবে, ঘরে-বাইরে যা আছে তাই নিয়ে বেশ আছি। এই ‘বেশ আছি’ টা যে ঠিক কেমন থাকা, সে ব্যাখ্যায় আর না-ইবা গেলাম। বস্তুত মধ্যবিত্তের জীবনে প্রচুর সাধ আছে; কিন্তু সেই তুলনায় সাধ্য বড়ই অপ্রতুল। জীবনটাকে এরা নুন-তেঁতুলের মতো মেখে-চটকে টাকরায় জিভ ঠেকিয়ে উপভোগ করতে চায়। অথচ ভোগ, উপভোগ বা সম্ভোগ যাই বলুন, তার জন্য যথেষ্ট উপকরণ ও প্রস্তুতি দরকার। টাকার টাটকা গন্ধ মধ্যবিত্তের জীবনে খুব একটা মেলে না। মাসকাবারি খরচ-খরচায় দিনদশেক যেতে না যেতেই সেই ‘নাই আর আনো’র ধাক্কায় বেচারা গৃহকর্তার অক্কা পাবার যোগাড়। যদিও বলা হয়, মনে বড় হলে সে ধনে বড় হয়; কিন্তু আদতে হয় এর উল্টোটা। মন আপনার যট্টুকই হোক, ভরপেট খাইয়ে ভাল একখানা উপঢৌকন ধরিয়ে দিতে পারলেই লোকে আপনার নামে ধন্য ধন্য করবে। বলা বাহুল্য, মধ্যবিত্তরা বেশ (ইতিবাচক অর্থে) রিএ্যাকশনারি বা প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের হয়ে থাকে। কিছু একটা অনিয়ম দেখলেই অমনি রে রে করে তেড়ে ওঠে। যারা নাকি বুর্জোয়া শ্রেণীর, তারা সহজে প্রটেস্টের দিকে যায় না। বিপদ বুঝে ওরা শামুকের মতো খোলস গুটিয়ে নেয়। আর যারা একেবারেই প্রলেতারিয়েত মানে ভুখানাঙ্গা মানুষ, তারাও প্রতিবাদী হবার মতো তাকত খুঁজে পায় না। ল্যাংটার যেমন বাটপাড়ের ভয় নেই, প্রান্তিক মানুষও তেমনি ঘাড় গুঁজে কাজ করতেই বেশি আগ্রহী। বিনিময়ে দুবেলা দুমুঠো খেতে পেলেই হয়। এরা কোন ব্যাপারে খুব একটা ইন্টারেস্ট নেয় না। যত আব্দার-আহ্লাদ বায়নাক্কা- সব এই স্বপ্নভুক মধ্যবিত্তের। এবার একটু প্রেম-ভালবাসার কথা বলি। বাঙালী আবেগি জাতি এ কথা নতুন নয়। এদের সর্বাঙ্গ থেকে আবেগ যেন একেবারে চুইয়ে নামছে। বাঙালীর হুজুগ কথাটাও বুঝি এবম্বিধ আবেগসঞ্জাত বিষয়। এরা স্বভাবেও ভাবুক। কিন্তু সহিষ্ণুতা সীমিত। একটু ভেবে দেখুন, বঙ্গদেশে যত রকম ‘পাবলিক নুইসেন্স’, তার বেশিরভাগ কিন্তু পারস্পরিক অসহনশীলতার অবদান। মধ্যবিত্তরা স্বভাবতই চিন্তাশীল, তবে ক্ষমাশীল নয়। আদিকালে দান-ধ্যানে এদের খানিক সুখ্যাতি থাকলেও এখন তা চুকেবুকে গেছে। বরং স্বার্থপর হিসেবে ক্রমশ অভিহিতি পাচ্ছে আমাদের রাজা-উজির মারা মধ্যবিত্তরা। সমাজে যারা উঁচুতলার মানুষ তারা কর্মপটু, নিজের কোলে ঝোল টানায় সদা তৎপর। মধ্যবিত্ত চেল্লাতে ওস্তাদ। কাজের কাজ কিছু হোক বা না হোক, নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে হলেও এরা সমানে শব্দদূষণ করে থাকে। এরা পরচর্চা, পরনিন্দা ও অহেতুক সমালোচনায় বিশেষ পারদর্শী। শুধু কি তাই, মধ্যবিত্ত বাঙালী প্রায়শ পরশ্রীকাতরতা নামক অসুখে ভোগে, কখনওবা পরস্ত্রীর দিকেও এদের বিশেষ নেকনজর পরিলক্ষিত হয়। বিত্তশালীরা চুপিচুপি একাধিক বিয়ে বা বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক বজায় রাখে। তাতে কিছু এসে যায় না, ওটা একটা আর্ট। মধ্যবিত্তরা মন চাইলেও তা পারে না, কারণ সেক্ষেত্রে মেলা গাঁটের টাকা খসাতে হয়। মধ্যবিত্তের অত বিত্ত কোথায় যে খসাবে! তবে এ কথা স্বীকার্য, বিত্ত আর চিত্তের মাঝে যে সম্পর্ক তা সমানুপাতিক নয়। সুখী হতে গেলে বেশুমার ধন-সম্পত্তি থাকতে হয় এমন ধারণা সঠিক নয়। আবার অভাব-অনটনের সংসারেও সুখপাখি ঠিক তিষ্ঠাতে চায় না। কেবলই ফুড়–ত ফাড়–ত করে, ডানা ঝাপটায়। পক্ষান্তরে, উঁচুতলাবাসী তার ঘরে বিত্তের পাহাড় জমালেও অন্তরে সুখের পসরা সেভাবে সাজাতে পারে না বলেই অনুমান। আতিশয্যজনিত ক্লান্তি এসে যায়, সবকিছু কেমন বিস্বাদ ম্যাড়মেড়ে মনে হয়। নিত্য পোলাও-কোর্মা খেতে কার ভাল লাগে! তারচেয়ে বরং মধ্যবিত্তের লঙ্কাপোড়াসহযোগে ডাল-ভাত অধিক রুচিকর মর্মে প্রতীয়মান। এবার আসুন ফ্যামিলি টাইজ ও ভ্যালুজ নিয়ে কিছু বলি। মানুষ দ্বীপবাসিণী নয়, নয় সে নিঃসঙ্গ গিরিপাহাড়। মানুষ স্বভাবতই আসঙ্গপ্রিয়। সে একা থাকতে পারে না। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পারিবারিক বন্ধন, অভাবের তাড়নায় হোক বা অন্যবিধ কারণে, খুব অটুট নয়। দশ পেরোলেই লেখাপড়া শিকেয় তুলে ছেলেপুলে নিজের মতো করে কাম-ধান্ধায় নেমে পড়ে। বাপ-মার খোঁজ নেবার ফুরসত পায় না, কারণ তাদেরকেও কিছু করে খেতে হয়। এর ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যায় উঁচু ক্লাসে। সেখানে পয়সার পাহাড় আছে; কিন্তু আবেগের বড়ই হাহাকার। নানারকম উল্টা-সিধা সম্পর্কে জড়িয়ে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ পুরো পারিবারিক বন্ধনে ধ্বংস নামিয়ে দেয়। ছেলেপুলে ভাঙ্গনের কবলে পড়ে জীবনের প্রতি ক্রমশ আস্থা হারিয়ে ফেলে, সাময়িক উপশম হিসেবে বেছে নেয় ভয়ঙ্কর ইয়াবা সাম্রাজ্য। অর্থাৎ এইক্ষেত্রেও পারিবারিক বন্ধন যথেষ্ট স্খলিত। সেই তুলনায় আমরা মধ্যবিত্তরা খুব ভাল আছি। বাবা-বাছা বলে বুকের সবটুকু ভালবাসা নিংড়ে দিয়ে ছেলেপুলে মানুষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারের মা-বাবা। বিত্তের বদলে চিত্তসুখে আমাদের আগ্রহ বেশি। টানাপোড়েনের জীবনে হয়ত প্রশান্তি তেমন নেই, তবে কিছুটা হলেও স্বস্তিবোধ আছে। নিগূঢ় সত্যিটা হলো, আগের মতো যৌথভাবে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেবার অবকাশ আর হয় না এখন। আর্থিক উন্নতির সিঁড়ি খুঁজতে গিয়ে আমরা একান্নবর্তী হয়ে পড়েছি, একাত্ম হতে পারিনি। তাই চিত্তশুদ্ধির পথে অনেকটাই বিচ্যুত আমাদের বাঙালী মধ্যবিত্ত। আসুন না ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ ও পারিবারিক বন্ধন ফিরিয়ে আনতে সবাই মিলে একাত্ম হয়ে কাজ করি। নিছক বিত্তের বদলে একটি চিত্তসুখকর সমাজ গড়ি। লেখক : কথাসাহিত্যিক, রম্যলেখক
×