ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কলাপাড়ায় সবুজ উপকূল হচ্ছে বিরানভূমি

প্রকাশিত: ২১:৩৩, ২৪ এপ্রিল ২০১৭

কলাপাড়ায় সবুজ উপকূল হচ্ছে বিরানভূমি

মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া ॥ ভূমিগ্রাসীর আগ্রাসী থাবায় কলাপাড়ার উপকূলীয় সবুজ জনপদ এখন বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। হয়ে যাচ্ছে বিরাণভূমি। সবুজ আস্তরণের কৃষিজমি চাপা পড়ছে বালুর নিচে। হাজার হাজার একর কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। স্থায়ীভাবে এসব জমি কৃষকের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ জীবন-যাত্রার নির্মল দৃশ্য। আগ্রাসী থাবা থেকে বাদ পড়ছেনা বাড়ি-ঘর থেকে গ্রামীণ প্রকৃতি। যেন সবকিছুই ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। বালুতে ভরাট হয়ে বিলীন হচ্ছে পুকুর, গোয়ালঘর থেকে বাপ-দাদার কবর পর্যন্ত। বনবিভাগের সংরক্ষিত বাগানের গাছপালাসহ বাগান পর্যন্ত আগ্রাসী হানায় বালুর নিচে চাপা পড়ছে। রক্ষা পাচ্ছে না নদী-খাল থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক লেক পর্যন্ত। কখনও অধিগ্রহণ। কখনও আগ্রাসী থাবায় জবরদখল চলছে। সব যেন চলছে ফ্রি-স্টাইলে। কোন নিয়ম কানুনের বালাই নেই। এক কথায় পর্যটন সমৃদ্ধ কলাপাড়ায় এখন বালুর নিচে চাপা পড়ছে সবুজের সুন্দর আচ্ছাদন। হয়ে যাচ্ছে কৃত্তিম মরুভূমি। অধিগ্রহন প্রক্রিয়ায় যেসব স্থাপনার জন্য সবুজ তিন ফসলী কৃষিজমিসহ বসতভিটা এলাকা বালুতে ভরাট করা হয়েছে তা নিয়েও রয়েছে এন্তার অভিযোগ। কারণ বিদ্যুত প্লান্ট করতে কী পরিমান জমির দরকার। আর কী পরিমাণ অধিগ্রহণ করা হয়েছে এ নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন। একই অবস্থা পায়রা বন্দর নির্মাণ নিয়ে। নৌঘাটি নির্মাণসহ বিভিন্ন সরকারি উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সবুজে ঘেরা কৃষি উৎপাদনের তিন ফসলী জমি অধিগ্রহণের বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্নের যেন শেষ নেই। ধানখালীতে ১৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য ১০০২ একর তিন ফসলী কৃষিজমিসহ বসতভিটা অধিগ্রহণ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত প্ল্যান্ট করতে কতটুকু জমির প্রয়োজন তা নিয়ে এখন সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যাদের জমি-জমা, বসতভিটা গেছে তাদের মনে প্রচন্ড ক্ষোভের জন্ম নিয়েছে। এসব মানুষের জমি বুঝে নেয়ার দুই বছর পরেও পুনর্বাসনের আওতায় আনা হয়নি। অধিগ্রহণের টাকা আজও পায়নি প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ। সুখে-স্বাচ্ছন্দে থাকা গেরস্ত পরিবারগুলো এখন বেড়িবাঁধের রিভার সাইটের স্লোপে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। তাদের চোখের সামনেই সবুজে ঘেরা মাঠে এখন কৃত্তিম বালুর পাহাড় দাড়িয়ে আছে। গত সাত বছরে অন্তত দশ হাজার একর কৃষি জমির ধরন পাল্টে এখন অনাবাদী হয়ে গেছে। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এভাবে সরকারি বেসরকারি উদ্যোক্তা কিংবা ভূমি ব্যবসায়ীরা শিল্প প্রতিষ্ঠান করার নামে বেড়িবাঁধের বাইরের সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় করে বালুতে ঢেকে দিয়েছে। শত শত গাছপালা কেটে সাবাড় করে দেয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিগ্রহন করা জমি-জমা দখল ও ভরাট করে নেয়া হয়েছে। স্লুইসসংযুক্ত খাল পর্যন্ত ভরাট করা হয়েছে। মিলিয়ে গেছে রাখাইনদের শ্মশানসহ ভূমিহীনদের জমি-জমা। পায়রা বন্দর প্রকল্প এলাকার উত্তর ও দক্ষিণ দিকে এ চিত্র বিরাজমান। নাচনাপাড়া চৌরাস্তা এলাকায় চাকামইয়া-টিয়াখালী দোন নদীর তীর দখল করে বনাঞ্চল কেটে সাফ করে দোকানপাটসহ বাড়িঘর করা হয়েছে। চাকামইয় ব্রিজ থেকে রজপাড়া পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। কুয়াকাটা মহাসড়ক লাগোয়া আলীপুর-কুয়াকাটা সড়কের মাঝ বরাবর প্রায় ৮০ বিঘা জমি তিন ফসলী কৃষিজমি এক ব্যক্তি কিনে রাখেন অন্তত ১৫ বছর আগে। এ জমিতে এখনও কিছু ধানের আবাদ হয়। সব জমি আবাদ করলে ফি বছল অন্তত দেড় হাজার মণ ধান উৎপন্ন হতো। কিন্তু এ জমি পড়ে আছে অনাবাদী। অথচ মূল মালিক কৃষকের হাতছাড়া হয়ে গেছে কৃষি জমি । এখন বালুতে ঢেকে গেছে সবুজের এই বির্স্তীণ এলাকা। এমন দৃশ্য কুয়াকাটা পৌর এলাকাসহ খাজুরা, আলীপুর, গঙ্গামতি, লতাচাপলী, কাউয়ারচর, গঙ্গামতিসহ সর্বত্র। পর্যটন এলাকা কুয়াকাটার দশ বর্গকিলোমিটার এলাকার সবুজে ঘেরা জমি বালুতে ঢেকে দেয়া হচ্ছে। অধিকাংশই কৃষকের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এসব এলাকার অন্তত পাঁচ হাজার একর জমি যুগ ধরে অনাবাদী পড়ে আছে। মহাসড়কের পাশে তিনফসলী কৃষিজমিতে কোন বাধা ছাড়া গড়ে উঠেছে আটভাটা। আর বেড়িবাঁধের বাইরের বনাঞ্চলসহ পাউবোর খাস জমি দখল করে গাছপালা উজাড় করে গড়ে তোলা হচ্ছে হাজার হাজার বাড়িঘর। এমনদৃশ্য সবক’টি বেড়িবাঁধের বাইরে। মাইলের পর মাইল জুড়ে সবুজের আচ্ছাদন উজাড় করে বিরানভূমিতে পরিণত করার যেন তান্ডব চলছে। ভূমিগ্রাসীচক্র এমনসব আগ্রাসী তান্ডব চালালেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব বন্ধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয় না। ফলে কলাপাড়া উপকূলের সবুজ বনায়ন, সবুজ কৃষিজমি এখন পরিণত হচ্ছে বিরানভূমিতে। বালুর আস্তরণে স্থায়ীভাবে ঢাকা পড়ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। উপজেলা প্রশাসন, কৃষিবিভাগ, পানিউন্নয়ন বোর্ড, বনবিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্তা ব্যক্তিরা এসব নিয়ে তেমন তৎপর নয়। ফলে ভূক্তভোগীরা হতাশ হয়ে পড়ছে। দ্রুত কমে যাচ্ছে কৃষিকাজে ব্যবহারের জমিসহ বনাঞ্চল। ধানসহ কৃষিউৎপাদন দ্রুত কমে যাওয়ায় কৃষকসহ ভূমির মালিকরা হতাশ হয়ে পড়ছেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মসিউর রহমান জানান, সারা দেশে বছরে মোট ভূমির ০.৭২ ভাগ কৃষি ভূমি কমে যাচ্ছে। কিন্তু কলাপাড়ায় এর পরিমান আরও বেশি। বর্তমানে যা উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌছেছে। তবে কী পরিমান জমি অনাবাদী হয়ে শ্রেণি পরিবর্তন হয়েছে তার সঠিক পরিস্যংখ্যান তিনি দিতে পারেন নি। সাধারণ সচেতন মানুষের দাবি তিন ফসলী কৃষি জমি রক্ষায় এখনই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হোক।
×